'চলচ্চিত্র' এই আধুনিক শিল্পটির বয়স আজ প্রায় হল ১২০ বছর। এই এক শতাব্দীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কত মানুষেরই অবদান রয়েছে নতুন এই শিল্পটিকে উন্নত থেকে উন্নততর করার লক্ষ্যে। যার ঋণ এখনও অনেকে স্বীকার করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। কিছু ব্যক্তি আছে, যাদের নাম 'চলচ্চিত্র' শব্দটি নিলে এবং তা নিয়ে যদি ঘন্টা খানেক আলাপ বা আড্ডা দেয়া হয়, তাহলে ঘুরে ফিরে আসবেই। আকিরা কুরোসাওয়া তেমনি একজন যার তৈরি শিল্প আজও মানুষের মনে গেথে আছে। আর তার তৈরি শিল্পগুলোর মধ্যে 'রাশোমন' অন্যতম যা জাপানের চলচ্চিত্র শিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে এক নতুন দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে অনেক প্রভাব ফেলেছিল। আজ এতদিন পর সিনেমাটি দেখার পর মনে হল কিছু লিখি।
কাহিনী সংক্ষেপ -----
এ্ক কাঠুরে, ধর্মযাজক এবং একজন সাধারন লোক রাশোমন গেইটে প্রবল বৃষ্টির দিনে আশ্রয় নেয়। কাঠুরে এবং ধর্মযাজক ফ্ল্যশব্যকে ঐ গ্রামের এক খুনের গল্প বলা শুরু করেন যার প্রেক্ষাপটে কাঠুরে নিজেও সাক্ষী ছিলেন(শ্রোতা- সাধারন লোকটি)। কাঠুরে একদিন জঙ্গলের ভেতর হাটতে গিয়ে দেখে একটি লাশ এবং লাশের সাথে কিছু প্রয়োজনীয় সাক্ষী। কাঠুরে ঐ এলাকার কোর্ট হাউসে খুনের তদন্তের দাবিতে উপস্থিত থাকেন। সেখানে তিনি তিনটি গল্প শুনে যেই গল্পগুলির ক্ষুদ্রতর মিল হল এরকম- 'একটি দম্পতী জংগলের মধ্যে দিয়ে ভ্রমন করছিল এবং এক দস্যু তাদেরকে অনুসরন করে। মেয়েটি নির্যাতিত হয় ঐ দস্যুর হাতে এবং তার স্বামী সেখানে খুন হয়'...। কাঠুরে ও ধর্মযাজক ঐ তিনটি গল্পই সেখানে উপস্থিত থাকা সেই তিনজন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছ থেকে ঐ কোর্ট হাউসে শুনেছিল। প্রথম গল্পটি বলে দস্যূ, দ্বিতীয় গল্প মেয়েটি এবং তিন নম্বর গল্প ঐ মেয়েটির মৃত স্বামীর আত্মার। তিনটি গল্পেই একটি ব্যপার লক্ষ্য করার আছে তা হল, তিনজনই তার নিজের গল্পে বলছে যে খুনটা সে নিজেই করেছে। আবার, তিনটি গল্পেই তারা খুনটি কেন করেছে তার উদ্দেশ্য ও পরিবেশ উল্লেখ করেছে। প্রত্যেকের গল্পেই সে নিজে খুন করেও তার দোষ অস্বীকার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কাঠুরের দাবি- তিনটি গল্পই এক সাথে সত্য হতে পারে না এবং তা অবিশ্বাসযোগ্য। ধর্মযাজকের দাবি- তিনজনের গল্প অবিশ্বাস করার মতন নয়। তারপর কাঠুরে নিজের গল্পটি বলা শুরু করে । নতুন এই গল্পে, সে নিজে তার চোখের সামনে খুনটি হতে দেখে যা হতে পারে সত্য গল্প। যেহেতু, তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ। কিন্তু আসলেই কি তাই ?
কুরোসাওয়া সম্পর্কিত -----
সিনেমাটির নির্মান কাজ শুরুর আগে কুরোসাওয়ার তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট তার কাছে মন গোমড়া করে এসেছিল। তারা আসলে কুরোসাওয়ার গল্পটি বোঝেননি তো কি দিয়ে কাজ করবে। কুরোসাওয়া জবাব দিয়েছিল এমন ' তুমি যদি গভিরভাবে গল্পটি পড় , তাহলে তুমি বুঝবে যে এটা আসলে তোমাকে বোধগম্য করার জন্য লেখা'। তারপরও তার তিন সহকর্মি এই গল্পের উদ্দেশ্য শুরুতে বোঝেননি। কুরোসাওয়া এই সিনেমার মুক্তির অনেকদিন পর ব্যখা করার সময় তার দুইজন সহকর্মিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন এবং তারা বুঝে খুশিও হয়েছেন। আর আরেকজন বুজেছিল ঠিকই কিন্তু তার এক্টাই কথা তা হল ' সিনেমাতে ৪ টি গল্প বলা হল কিন্তু, আসলে কোন গল্পটি সত্যি তা মিমাংসা দেয়া উচিৎ ছিল।
কুরোসাওয়ার এই গল্পে মিমাংসাটা আসলে জরুরি নয়। প্রতিটি চরিত্র তার নিজের দোষগুলোকে কিভাবে ঢেকে রাখে এবং আরেকজনের উপর দোষ চাপিয়ে দেয় তাই সিনেমার মূল লক্ষ্য ছিল। সিনেমার আসল যন্ত্র বা মেসেজ হচ্ছে, মানুষ কখনো নিজেকে আরেকজনের কাছে অলংকার ছাড়া উপস্থাপিত করে না। সে তার নিজের সাথেও প্রতারনা করে। মানুষ যা দেখায় আসলে তা তার আসল রুপ নয়। আর এর ফলে, মানুষ প্রায়ই প্রতারনার স্বীকার হচ্ছে। সমাজ থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। কিন্তু, বিশ্বাস সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ন একটি অদৃশ্যমান উপাদান। এই সিনেমার সেই ধর্মযাজক তার বিশ্বাস প্রবলভাবে ধরে রেখেছিল। যদিও তার এই বিশ্বাস ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তা আবার পুনরায় সিনেমার শেষে গঠন করা হয়েছে।
অন্যান্য -----
সিনেমাটির প্রথম দৃশ্যটি ছিল কাঠুরে ও ধর্মযাজককে প্রতিষ্ঠিত করা। কুরোসাওয়া ৫টি শটে অর্থাৎ, সিনেমাটি লং শট থেকে শুরু করে ক্লোজ আপ শটে যেয়ে তাদের দুজনকে দর্শকের খুব কাছে নিয়ে আসেন এবং তার সিনেমার আলোচনায় লিপ্ত করেন যা খুবই দৃষ্টিগম্য। কাজু মিওয়াগাওয়ার সিনেমাটোগ্রাফি ছিল অনবদ্য। সিনেমাটি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে 'গোল্ডেন লায়ন' পুরস্কার পেয়েছিল। কিছুদিন আগে অক্সফর্ড ডিকশনারিতে 'রাশোমন' একটি নতুন ইংরেজি শব্দ যুক্ত হল। সিনেমার জঙ্গলের শটগুলো হ্যন্ড হেল্ডের কাজ রয়েছে প্রচুর যা ঐ সময়ে কেউ ব্যবহার করত না। বলতে গেলে, কুরোসাওয়াই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলেন।
### রাশোমন সিনেমার অনেক গল্পই আছে। যা কিছু আছে জানা আর বেসিরভাগই অজানা। প্রতিবারই নতুন কিছু তথ্য পাই সিনেমাটির দেখার পর।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:১০