তিউনিসিয়ার বংশোদ্ভূত নির্মাতা Abdellatif Kechiche চলচ্চিত্রে পদার্পন খুব বেশি দিনের নয়। তার চলচ্চিত্র ‘নীল একটি আরামদায়ক রঙ’ চলচ্চিত্রটির নাম যেদিন প্রথম পড়লাম সেদিন তেমন গুরুত্ব দেইনি। তার কোন সিনেমাও দেখা নেই তখন পর্যন্ত। নামটা যদিও অবচেতন মনের সুতোয় গিট্টু দিয়ে রেখেছিল। একদিন খবর আসে চলচ্চিত্রটি ‘পাম দোর’ পুরুস্কার পেয়েছে যা কিনা কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বোচ্চ সম্নান জিতে নিয়েছিল।
প্রেম ভালোবাসার সিনেমা। খুবই সাধারণ প্রেম কাহিনী। কিন্তু, তবুও কেন এত প্রশংসা এই সিনেমাতে? ব্যাপার তো আছেই। সমকামি প্রেম কাহিনীর উপর গড়া একটি প্লট। মুলত, ‘সমকামী’ শব্দটি এখানে উল্লেখ করার কোন প্রশ্নই আসে না। কারন এই চলচ্চিত্রটি দেখার পর ব্যাপারটা ‘সমকামী’ নামক কোন শব্দে আটকে থাকেনি। একজন মানুষ, অপর একজন মানুষকে ভালবাসবে এটাই স্বাভাবিক। ভালোবাসার তীব্রতা কতটা প্রখর সেটা সিনেমাতে প্রকাশ করাটা খুবই জটিল প্রক্রিয়া। মানুষের আবেগকে ভিজ্যুয়াল দেয়ার কাজটা অত্যন্ত কঠিন একটি চেষ্টা। আর সেই চেষ্টা সমকামিদের দিয়ে দেখানো প্রায় টুথপেস্ট বের করে- সেটা উল্টা ঢোকানোর সমান একটি অপচেস্টাই আমি বলব। সেই দুঃসাহস নিয়েই আব্দুল লাতিফ মাঠে নেমেছিলেন।
এডেল আর ইমার প্রেমের গল্প সমাজের সাধারন গল্পের মতনি। এই প্রেমে হিংসা, হাঁসি-কান্না, ব্যার্থতা, প্রতারনা, যৌনতা, হতাশা আবার সততা সব মসলাই আছে। একজন মানুষ কত সুন্দর করে হাসে প্রেমে পরলে সেটা এডেলের হাঁসি না দেখলে হয়ত জানা হত না। হয়ত আমরাও প্রেমে পড়লে এডেলের মতই হাঁসি। এডেলের চোখ দিয়েই দর্শককে দেখানো হয় এডেলের দুনিয়া। এডেলের প্রথম ভালোবাসার কাহিনী। এখানে তার মুগ্ধতা, সরলতা এবং মৌনতা স্পষ্ট হয়েছে। ‘প্রথম ভালোবাসা’ আসলেই কতটা নিষ্পাপ। পৃথিবীর প্রথম দিন থেকে অদ্যাবধি কত মানুষের ‘প্রথম ভালোবাসা’।
এই সিনেমার চিত্রনাট্য নির্মাতা অনেকাংশেই ইম্প্রোভাইজ করা হয়েছিল। এডেল মাত্র একবারই সুযোগ পায় চিত্রনাট্য পড়ার। আব্দুল লাতিফ কেশিস প্রচুর সময় নেন সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে। তিনি চিত্রনাট্যে হুবহু না দেখিয়ে অভিনয়শিল্পীদের মাঝে থাকা অটো ইমোশনের ডিটেলই পছন্দ করেন। এই সিনেমাতে এডেলের অভিনয় আরও রিয়েলিস্টিক করার জন্য তাকে সারাদিন মনিটর করা হয়েছে। এমনকি এডেল যখন গোছল করে বাঁ ঘুমায় তখনো তাকে মনিটর করা হয়েছে। এই সিনেমার অনেক দৃশ্যে এডেল সত্যি-সত্যি ঘুমায়। একটা যৌন দৃশ্য নিতে নির্মাতা দশ দিন সময় লাগিয়েছেন। দশ দিন যৌন কর্ম দৃশ্যায়নের প্রাকটিসের পর নির্মাতা বলেছেন ‘ওকে’। একটা ছোট্ট হাটার দৃশ্যে নিতে একশটি টেক নিতে হয়েছিল। লং টেক যে এক ধরনের রিয়েলিটি তৈরী করে মোটামুটি তা আবার প্রমানিত। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার Yasujiro Ozu এর দ্বারা প্রভাবিত এই নির্মাতা। তিনি বলতে গেলে একজন হার্ডকোর নির্মাতা হিসেবেই প্রমানিত হলেন।
এই সিনেমাটি খুব দারুণ উপভোগ করেছি বললে ভুল হবে। এই সিনেমাটা দেখে মনে হয়েছে, আমিও সিনেমার প্লটের সাথে এগিয়ে যাচ্ছি। বাস্তবিক ছোয়া আছে চলচ্চিত্রে। মনে-মনে কত কিছু ভাবিয়েছিল দেখার সময়। অসাধারণ এক প্রেম কাব্যের ভিজ্যুয়াল রুপ দেয়া। এই সিনেমার সবচেয়ে বড় যেই দিকটা আমি বলব তা হল, এই সিনেমা সমকামীদের নিয়ে হলেও মনে হবে এটা আমাদেরই কারও একজনের সাধারণ গল্প। অর্থাৎ, সমকামী শব্দটি দর্শকের মনেই পরবে না। যৌন দৃশ্যগুলোর মধ্যেও কিছু লুকিয়ে রাখা এলিমেন্ট দেয়া আছে যা হয়ত মানুষের অন্ধকার দিকগুলোকে দর্শকদের খুব কাছে নিয়ে এসে আরও গভীরভাবে ভাবাতে সক্ষম।
জানা রাখা ভালোঃ কান উৎসবের প্রথম কোন চলচ্চিত্র যেখানে নির্মাতার সাথে দুজন প্রটাগনিষ্টকেও ‘পাম দোর’ পুরুস্কার দেয়া হয়। যিনি এই উৎসবের চিরাচরিত নিয়ম ভাংগার এই উদ্দ্যেগ নিয়েছিলেন সেই ব্যাক্তির নাম ‘স্টিভেন স্পিলবার্গ ’।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:২৪