যুদ্ধ পৃথিবীর আদিম অন্ত্র। বাঁচার তাগিদে মানুষ নানাভাবে যুদ্ধ করে। তবে যুদ্ধ অনেক ধরনেরই হয়। নিজের সাথে যুদ্ধ, আরেকজনের সাথে যুদ্ধ, খাবারের জন্য যুদ্ধ, ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ, ভূমির জন্য যুদ্ধ, ভালোর জন্য যুদ্ধ, খারাপের জন্য যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের জন্যই যুদ্ধ। অনল্প কারনেই মানব জাতিকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যেতে হয়। যুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্র রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে সিনেমাগুলোর প্রতি দর্শকের আকর্ষণ হরবখত বেশী থাকে। পৃথিবীর বৃহত্তম এই যুদ্ধ নিয়ে আমরা পেয়েছি অসাধারণ কিছু সিনেমা। তবে ‘অসাধারণের মধ্যে অসাধারন’ কথাটা আর একটু জটিল। আর অসাধারণ শব্দের অর্থ হচ্ছে- যা সাধারণ নয়, অসামান্য। ‘ডানকার্ক’ আমার কাছে ‘অসাধারণের মধ্যে অসাধারণ’। বিখ্যাত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের মাথায় প্রথম এই সিনেমা বানানোর ধারনা ১৯৯২ সালে তার বন্ধু এমা থোমাস(বর্তমান স্ত্রী) এর সাথে ডানকার্ক পাড়ি দেয়ার সময় আসে। তার থেকে প্রায় ২৩ বছর পর তিনি ডানকার্ক সিনেমার নির্মান কাজ শুরু করে।
প্রথমে এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটা কথা বলে রাখা দরকার, সেটি হল এটি আভা-গার্দ বা নিরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র। ক্রিস্টোফার নোলান তার এই চলচ্চিত্র খানিকটা ভিন্ন-ভাবে গঠন করেছেন। অর্থাৎ, চলচ্চিত্রের গড়ন সাধারণ নয়। কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে কাহিনী তৈরি নয়। প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ঘটনাস্থল এবং সময়কে। তিনটি ভিন্ন যায়গায় যথাক্রমে- সমুদ্রতীরে, সমুদ্রে এবং আকাশপথে কাহিনীচিত্র চলবে সমান্তরালে। আবার, তিনটি ভিন্ন সময় ও তার প্রেক্ষাপট। অর্থাৎ, একটি প্রেক্ষাপটের সাথে আরেকটির কোন তেমন মিল নেই কিন্তু তারা একই পরিস্থিতিতে বাধা। কোন চরিত্রের অতীত দেখা যায়না। কোন প্রতিপক্ষ দেখা যায়না (শেষের অংশে ঐ তিন সেকেন্ড বাদে)। সিনেমায় সংলাপ খুবই কম। আর তিনটি প্রেক্ষাপট বা সময় একটি সময়ের কেন্দ্রতে এসে মিলে যায়। সেই কেন্দ্রটি হল তিন লক্ষ ব্রিটিশ যোদ্ধাদের সর্বশেষ উদ্ধার প্রক্রিয়ার অন্তিম মুহূর্ত। চলচ্চিত্রটি সিনেমা হলে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরীর এক ব্যঞ্জনা। চিত্রনাট্যের জটিলতা, সমুদ্রের কলরব ও মৃত্যু -ফাদ, লোমহর্ষক আবহসঙ্গীত, নির্ভীক নাবিকের অপ্রত্যাশিত দায়িত্ব এবং আকাশপথে যুদ্ধ বিমানের সুকৌশলী গুলির দাগা দর্শকের ধমনীতে তীব্র উত্তেজনা উৎপাদন করারই কথা। ইতিহাসকে যেন পুনরায় মনে করিয়ে দেয়া। এই যুদ্ধের আসল জয় হল ‘বেচে থাকা’ বা ‘উদ্ধার করা’। এই বেঁচে থাকাই পরবর্তীতে পৃথিবীর ইতিহাসকে পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে। সাধারনত, ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমায় গল্পকে মৌখিক ব্যাখ্যায় সাজানোর প্রয়াস লক্ষণীয়। তবে, এই চলচ্চিত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটল। কাহিনিকে দৃষ্টিগোচর এবং সক্রিয় রাখাই ছিল তার মূল আয়োজন। হঠাৎ, দর্শককে যুদ্ধের মধ্যে ফেলে দেয়া হল। যুদ্ধের ময়দান থেকেই দর্শককে দৃষ্টিপাত করতে হবে।
ক্রিস্টোফার নোলান এককভাবে অনেকদিন পর কোন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন। অরৈখিকভাবে চিত্রনাট্যেকে নকশা করা তার পুরানো কৌশল। যদিও সংলাপ কম রেখে মাত্র ৭৬ পৃষ্ঠার গল্প তিনি এইবার ফেঁদেছেন। প্রতিটি সিকুয়েন্সে চোখ আটকে রাখার সময় তিনি দর্শককে দিয়েছেন। হ্যান্স জিমারের গভীর আবহসঙ্গীত অনুভূতিকে আরও বেশী যেন পীড়া দেয়। তিনটি সময়কেই একের পর এক টান-টান উত্তেজনায় সঙ্গীত দিয়ে আবদ্ধ করেছেন তিনি। ‘শেফার্ড টোন’ এর ইফেক্ট দর্শককে মনস্তাত্ত্বিকভাবে উদ্বিগ্ন ও চাপা উত্তেজনাকে ধীরে-ধীরে বাড়িয়ে তোলে। আর ‘টিক-টক’ শব্দ নোলানের পকেট ঘড়ি থেকে নিয়ে সিন্থেসাইজ করা হয়েছে। ভেন হোতেমার চাঞ্চল্যকর সিনেমাটোগ্রাফি চলচ্চিত্রকে আরও প্রানবন্ত করে তোলে। আইমেক্স প্রদর্শনীকে আরও উপযুক্ত ও সংগতিপূর্ণ করার জন্য নোলান আইমেক্স ক্যামেরা ব্যবহার করে থাকে। সিনেমাটোগ্রাফার আইমেক্স ৬৫মি.মি এবং ৭০ মি.মি বড় ফিল্ম স্টোক ব্যবহার করেছেন। আইমেক্স প্রজেকশনে ৭০ মি.মি ফিল্ম ফ্রেমে তুলে ধরা কাহিনীচিত্র অত্যন্ত নিখুঁত ও বাস্তব তা প্রেক্ষাগৃহে না যেয়ে হয়ত বোঝা যায়না। আইমেক্স ক্যামেরাকে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা বা গো-প্রোর বিকল্প হিসেবেও যে ব্যবহার করা যায় তা নোলানের পক্ষেই প্রমান করা সম্ভব হয়েছে। সিনেমার প্রোডাকশন ডিজাইন নিয়ে কিছু যায়গায় আপত্তি ছিল বটে যেমন- ডানকার্ক শহরের ধ্বংসস্তূপ তেমন দেখা যায়নি। কিন্ত, সমুদ্রের বেলাভূমিতে অসংখ্য আতংকিত প্রাইভেটদের জমায়েত হওয়া আর তাদের আর্তনাদ দেখে এই খুটিনাটি ব্যাপারগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ন মনে হয়নি অথবা অন্য কোন লজিক আছে যা আমার মাথার ঠিক উপর দিয়ে গিয়েছে। ফাইটার থেকে স্পিটফায়ারের এরিয়াল দৃশ্য অনুভব করার জন্য ক্রিস্টোফার নোলান নিজে ফাইটারে চড়েছে। শুধু তাতেই নয়, নোলান, এমা থমাস এবং আরেক বন্ধু ইংল্যান্ড থেকে ডানকার্কে পাড়ি দেয় শুধু সিভিলিয়ানরা কিভাবে সেই সময়ে এই যাত্রা শেষ করেছিল তা অনুভব করার জন্য।
টম হার্ডির সম্ভবত ১০ থেকে ১২ টি বাক্য চলচ্চিত্রে শোনা যায়। তার চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না। সেই অগ্নিচক্ষু যে কত কথা বলে দিতে পারে সে আমরা ‘ডার্ক নাইট রাইজেস’ সিনেমায় ভালই উপলব্ধি করেছিলাম। ব্রিটিশ অভিনেতা মার্ক রাইলেন্সের চোখে যখন পানি আসে আর বলে ‘মে বি এ লাইফ’ তখন নিজের চোখেই কিছু অনুভূতি হয়ত ঝিলিক দিয়ে উঠে আর প্রশংসায় মুখরিত হয়ে বলা যায় ‘দিস ইজ কলড দ্য পাওয়ার অফ সিনেমা’। কিলিয়ান মার্ফি আর কেনেথ বার্নাঘের অভিনয় প্রশংসনীয়। আর চলচ্চিত্রে নতুন পদার্পন হিসেবে সবচেয়ে যার অভিনয় ভালো লেগেছে তার নাম ফিওন ওয়াইটহেড। তার সেই শ্বাস্রুদ্ধকর দৌড়ের সিকুয়েন্স মগজে এবং ধমনীতে ভালই নাড়া দিয়েছিল। অসাধারন লেগেছে এই তরুন অভিনেতাকে।
ক্রিস্টোফার নোলান বলেছেন এই সিনেমার টোন ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ এর থেকে ভিন্ন। প্রায় সব ধরনের সংকট দেখানো হয়েছে এই সিনেমায়। উচ্চতা-ভীতি, ডুবে যাওয়ার ভয়, আগুনের ভয়, বদ্ধ যায়গার ভীতি ইত্যাদি সংকটের শেষ নেই। হায়েনার মতন উপর থেকে প্রতিপক্ষরা যখন প্লেন নিয়ে আসে তখন হৃত়্স্পন্দন কিছুটা বেড়ে যায়। এত নিপুণতা আর প্রত্যয় নিয়ে চলচ্চিত্র বানাতে অনেকদিন পর কাউকে দেখলাম। হঠাৎ, কোন এক সময় আকাশ অন্ধকার হয়, কোন এক প্রাইভেট...অথবা মানুষ এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তির জন্য সমুদ্র পাড়ি দিবে বলে ডানকার্কের বিশাল সেই স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়।
ডানকার্ক ট্রেইলার