মানুষ হইয়া জন্মাইছেন আর ইগো থাকবো না সেইটা হইতেই পারে না। কেউ ইগোর চর্চা করে প্রকাশ্যে, কেউ ইগোকে দমন কইরা রাখে, কেউ পুষে রাখে সময় হইলে প্রতিশোধ নিবে বইলা। পশুজাতের মধ্যে ইগো মনে হয় নাই। মানুষের মধ্যেও একসময় ছিল না আমার ধারণা। গুহাবাসীরা ইগো নিয়া চলতে পারতো না। তারা দিনে খাবার সংগ্রহ করতো আর রাতে ঘুমাইতে যেত অন্য পশুদের মতোই। কি জানি হয়তো মানুষের মধ্যে তখন ইগো থাকতেও পারে; সেই আদি জিন আমরা বহন কইরা আসছি বইলাই হয়তো আমাদের মধ্যে ইগোর বিবর্তন হইয়া ফুইলা-ফাঁইপা উঠে। এই আদি মানব নিয়া ইউভাল নোয়াহ হারারি হয়তো ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। আবার সাইকোলজিস্টরা এই ব্যাপারে নিশ্চয়ই অনেক গুরুগম্ভীর তত্ব জারি করে রাখছিলেন।
আমার মতে, ইগোর শুরু হয় মনে হয় স্কুল জীবন থেইকাই। আর এর বীজ রোপিত হয় পরীক্ষার ফলাফল থেইকা। এই ইগোএ বীজ আমাগো মস্তিষ্কে পিতা-মাতা এবং শিক্ষকরা সূক্ষ্ম কইরা ঢুকাইয়া দেয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
এই ইগোর জগতের বাইরে আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও না। বা যাদেরকে আমরা বুদ্ধিজীবীর তালিকা থেকে পরিত্যাগ কইরা নতুন তালিকা তৈরি করি তারাও না। উদাহরণস্বরুপ বলা যাইতে পারে আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদের গল্প। দুইজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক যারা বাংলা সাহিত্যের সীমানাকে আরও প্রশস্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা কইরা গেছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ এমন একজন লেখক ছিলেন যাকে সবাই চাঁচাছোলা হিসেবে জানতো। অন্যান্য লেখকদের জন্য তিনি ছিলেন এক তিক্ত যন্ত্রণা। তিনি হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন এমনকি জাতীয় বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফাকেও ছাড়তেন না।
'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' এই নামধারী কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে তিনি হুমায়ুন আহমেদ এবং ইমদাদুল হক মিলন-এর নাম দিছিলেন স্যাটায়ার কইরা। কারণ, হুমায়ুন-মিলন ছিলেন হুমায়ুন আজাদের কাছে বাজারে লেখক। এটি দেখে হুমায়ুন আহমেদ খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখাননি তবে ইমদাদুল হক মিলন ঠিকই এর জবাব দিছিলেন। মিলন একটি বই লিখছিলেন যার নাম 'বনমানুষ', সেই বইটি উৎসর্গ করছিলেন হুমায়ুন আজাদকে। সাহিত্যের ইগো সাহিত্য দিয়াই দেখানো হইছে।
বনমানুষ না হইলেও পশু হিসেবে হুমায়ুন আজাদ যোগ্য প্রার্থী আহমদ ছফার মতে। আহমদ ছফা একবার বলছিলেন, 'হুমায়ুন আজাদ হচ্ছে সজারুর মতো, দেখতে ভয় লাগে কিন্তু ক্ষতি করে না'। আহমদ ছফাকে নিয়া আজাদ অনেক কটুক্তি করেছিলেন। আজাদ কাউরেই তার যন্ত্রণার বাইরে থাকতে দিতেন না। বাক্য দিয়া একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব নষ্ট করার অভিনব এই কৌশলটি আজাদ খুব ভালো কইরাই রপ্ত করছিলেন।
একবার বইমেলায় হুমায়ুন আজাদ-এর স্ত্রীকে দেখতে পাইয়া আহমদ ছফা লেখক মহলের মধ্যেই কদমবুসি করতে চাইছিলেন। আজাদের স্ত্রী লজ্জায় বলে ফেললেন 'সেকি আপনি একি করছেন, থামুন, আশ্চর্য '। ছফা বললেন যার ভাবমর্ম ছিল এমন 'আমি আসলে আপনার মতো একজন মহীয়সী নারীকে সম্মান জানাতে চাই, যে কিনা হুমায়ুন আজাদের মতো এমন একজন ব্যক্তির সাথে এত বছর সংসার করতে পারলো'।
'স্বভাবে কবিতা লেখে, পেশায় জল্লাদ,
খিটিমিটি মানবক হুমায়ুন আজাদ।'_ আহমদ ছফা
হুমায়ুন আজাদের 'নারী' গ্রন্থ নিয়া আহমদ ছফা অনেক নেতিবাচক কথা বলছিলেন। বইটি পড়ে ছফা প্রথমে খুশি হইলেও ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। আজাদের দাবি এটি তার মৌলিকগ্রন্থ। কিন্তু পরবর্তীতে ছফা আবিষ্কার করেন, এই বই আসলে ফরাসি লেখক সিময়েন দ্য বোভেয়ার-এর বই থেকে চৌর্যবৃত্তি করছিলেন । কি একটা অবস্থা লেখক সমাজের তাই না। লেখকদের মধ্যেও কত কাদা ছোড়াছুড়ি হয়। আর এই সবই হয় ইগোর কারণেই।
একবার এক সাক্ষাৎকারে আহমদ ছফাকে সাংবাদিক বললেন, হুমায়ুন আজাদ প্রায়ই আপনাকে নিয়া সমালোচনা করেন আপনি কি তা অবগত। তার উত্তরে আহমদ ছফা বললেন-
'শুকোরের বাচ্চার যখন নয়া দাঁত গজায় তখন, বাপের পাছায় কামড় দিয়া পরীক্ষা করে, যে দাঁত শক্ত হইছে নাকি'।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২৩ ভোর ৫:২৪