#জোহা_স্যার_আপনি_কোথায়ঃ
আমি লোপা।বাবার একমাত্র আদুরে মেয়ে। স্কুল কলেজের গন্ডি পার করে একসময় ভর্তি হলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবার স্বপ্ন ছিল আমি মেডেকেলে ভর্তি হবো, কিন্তু বাবার সেই স্বপ্ন আমি পুরণ করতে পারিনি। তাতে আমার খুব একটা আফসোস নেই। রাবিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েই আমি খুশি। আর আমার খুশিতে আমার বাবাও খুশি। তবে বাড়ি থেকে দূরে এসে বাবাকে বড্ড মিস করি। এই বয়সেও বাবা আর আমি একপ্লেটে খাই। এতদিন বাবা সর্বদাই আমাকে আগলে রাখেছেন, কিন্তু এখন আমি বাবার কাছ থেকে অনেক দুরের একটা শহরে একাএকা থাকি।
ক্লাশ পড়াশোনা বেশ ভালই চলছিল। ক্লাস টেস্টগুলোতেও আমার রেজাল্ট বেশ ভাল হচ্ছিল। ভর্তির পর থেকেই অনেক ছেলেরাই আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে থাকে। একসময় বুঝলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পড়াশোনার জন্য নয় জীবন সঙ্গী পছন্দেরও জায়গা। অন্য বান্ধবীদের দেখে আমিও বুঝলাম ভালবাসাবিহীন ক্যাম্পাস জীবন একেবারেই পানসে। শত ছেলের মাঝে ক্লাসমেট রনিকে আমার ব্যতিক্রম মনে হল। রনি পড়াশোনায় ভাল আবার ওর কিছু মানবিক গুনও আছে, এই যেমন ও স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। বন্যার সময় সময় ওকে দেখেছি নাওয়া খাওয়া ভুলে ভার্সিটির হলে হলে গিয়ে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে কাপড় সংগ্রহ করতে এবং পুরো এক সপ্তাহ ক্লাস মিস দিয়ে সেগুলো বন্যার্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। ওর এই মানবিক গুণগুলো আমাকে আকর্ষণ করলো। তাই রানিকে আমি ফেরাতে পারলাম না। এরপর থেকে ৭৫০ একরের বিশাল ক্যাম্পাসে আমি আর রনি দুজন যেন ডানামেলা দুটি পাখি। ক্লাশের বিরতির সময়গুলো আমরা একান্তে কাটাই পরম ভাললাগা নিয়ে।
একদিন বাবা আমাকে দেখতে ক্যাম্পাসে এলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরুপ সৌন্দর্যে বাবা মুগ্ধ হলেন। রাবির বদ্ধভুমি, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা এবং সবশেষে শহীদ শামছুজ্জোহা স্যারের স্মৃতিস্তম্ভের কাছে এসে বাবা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। আমিই বাবাকে জোহা স্যারের গল্প শোনাই, জোহা স্যার কিভাবে নিজের বুকের রক্ত দিয়ে তার ছাত্র/ছাত্রীদের সেদিন বাচিঁয়েছিলেন, শুনে বাবার চোখে পানি এসে যায়। বাবা শুধু একটা কথাই বলেন
-এমন শিক্ষক যুগে যুগে বার বার কেন আসে না?
প্রথমে বর্ষের রেজাল্টে রনি ফাস্ট আমি তৃতীয় হই। কিন্তু ২য় বর্ষে গিয়ে আমি ফাস্ট হই রনি পঞ্চম। রনি প্রথম প্রথম পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও পরবর্তীতে সমাজসেবা এবং বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। আমি ওকে বার বার চেষ্টা করি রাজনীতি বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী করতে কিন্তু কে শোনে কার কথা?
তৃতীয় বর্ষে আমাদের একজন নতুন শিক্ষক জয়েন করেন। তিনি আবির স্যার, আসলে নতুন বললে ভুল হবে স্যার গত দুইবছর দেশের বাইরে ছিলেন উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। স্যারের বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি হবে কিন্তু দারুণ স্মার্ট। হয়তো স্যারের বয়স আর বিশ বছর কম হলে আমিই স্যারের প্রেমে পড়ে যেতাম। যেকোনো বিষয়ে বোঝানোর ক্ষমতা স্যারের অপরিসীম। অল্পদিনের আমাদের সবার প্রিয় হয়ে উঠলেন আবির স্যার। সকাল সাতটায় ক্লাস নিলেও স্যারের ক্লাশ কেউই মিস করতে চাইতো না। স্যার যখন ক্লাশ নিতেন ক্লাশে তখন পিনপতন নিরবতা বজায় থাকতো। সবাই শুধু স্যারের কথাগুলো খাতায় তুলতে ব্যস্ত। ক্লাশের ভাল ছাত্রী হিসাবে আমি একসময় স্যারের প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলাম।
ইদানীং রনির সাথে আমার সম্পর্ক ভাল যাচ্ছে না। পড়াশোনায় মন নেই ওর,ক্লাশেও অনিয়মিত। সারাক্ষণ ওর ভাবনায় দেশ এবং রাজনীতি। সেবার হল কর্তৃপক্ষ ডাইনিংয়ের খাবারের দাম দুটাকা বাড়িয়েছিল,
ব্যাস তাই নিয়ে রনিদের সেকি আন্দোলন! দশ বারোটা ছেলেমেয়ে মিলে পুরো ক্যাম্পাসে ধর্মঘট ডেকে বসে। কাজের কাজ কিছুই হল না মাঝখান থেকে আমাদের শিক্ষাজীবনের কয়েকটা দিন নষ্ট হল। ইদানীং এক বাম নেত্রীর সাথে রনিকে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে ক্যাম্পাসে দেখা যায় বলে আমার বান্ধবীদের কাছ থেকে খবর পাই। আসলে ওর ব্যাপারে আমার আর কোন ইন্টারেস্ট নেই তাই ওদের সম্পর্কটা কি সাংগঠনিক নাকি প্রেমের তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই।
অনার্স পরীক্ষার রেজাল্ট আমার বেশ ভাল হল। প্রথম হতে না পারলেও দ্বিতীয় হতে পেরেছি।রনি কোনমতে পাশ করেছে। মাস্টার্সে আবির স্যারের আণ্ডারে থিসিস গ্রুপে ভর্তি হলাম। আমিতো মহাখুশি এমন একজন ভাল শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা করতে পেরে। স্যারের উৎসাহ আর নির্দেশনায় তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে আমার পড়াশোনা। স্যার রাজশাহীতে একাই থাকেন তাই আমি মাঝেমধ্যে হল থেকে স্যারের জন্য মুরগির মাংসের তরকারি রান্না করে বাটিতে করে ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসি। স্যার বাসায় নিয়ে যান এবং পরদিন আমার রান্নার দারুণ প্রশংসা করেন।
আমার থিসিস প্রায় শেষের দিকে, একদিন বিকেল বেলায় স্যার তার ডিপার্টমেন্টের রুমে আমাকে ডাকলেন। গিয়ে দেখি স্যারের রুম তালা দেওয়া। স্যারকে ফোন দিলাম, স্যার ফোন রিসিভ করে বললেন
-একটা জরুরি কাজে বাসায় চলে এসেছি, তুমি এককাজ কর আমার বাসায় চলে আসো।
স্যারকে আমি এতোটাই শ্রদ্ধা করি যে সাত পাচ না ভেবেই স্যারের বাসায় চলে গেলাম। স্যারের দেওয়া ঠিকানামতো স্যারের বাসায় গিয়ে কলিংবেল টিপলাম। দরজা খুলতে একটা সেকেন্ডও দেরি হল না। মনে হল স্যার আমারই অপেক্ষায় বসে ছিলেন। বাসায় স্যার ছাড়া দ্বিতীয় কোন মানুষ ছিল না। প্রথমে আমার পেপারগুলো বেশ ভালভাবেই দেখলেন। দারুণ প্রশংসা করলেন আমার, হঠাৎ বললেন
-দেখ তুমি খুব ভাল ছাত্রী আমি জানি, আমি চাই তুমিও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হও, এবং সে যোগ্যতা তোমার আছে। শুধু যদি আমাকে একটু খুশি করতে পারো তবেই তোমার শিক্ষক হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম,
-স্যার আপনি এসব কি বলছেন?
স্যারকে দেখে বুঝতে বাকী রইলো না স্যার মদ খেয়েছেন।
আমি স্যারের বাসার গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু স্যার তার আসল রুপ মেলে ধরলেন, সব ভদ্রতা আর শিক্ষা যেন ধুলোয় লুটিয়ে পড়লো। স্যারের হিংস্র থাবা থেকে নিজেকে বাচানোর শক্তি আমার ছিল না, একসময় আমাকে পরাস্ত হতেই হল ওই দানবটার কাছে।
সেদিন স্যারের বাসা থেকে বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম শহীদ জোহা স্যারের স্মৃতিস্তম্ভের কাছে আর জোরে জোরে চিৎকার করে বললাম
-জোহা স্যার আপনি কোন কোথায়? আপনার ছাত্রীরা আজ ধর্ষিত হচ্ছে আপনাকে আজ বড্ড প্রয়োজন।
বিঃদ্রঃ গল্পের চরিত্র এবং ঘটনাগুলো সম্পুর্ন কাল্পনিক, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে লেখা , কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে মিলে যাওয়া সম্পূর্ণই কাকতালীয়
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৭