ইন্টারমিডিয়েট ফাষ্ট ইয়ারে পরার সময় মা এবং নানীকে ময়মনসিংহে ছোট খালার বাড়ীতে রেখে আমি বাড়িতে মানে কুড়িগ্রাম যাব। তো ময়মনসিংহ থেকে কুড়িগ্রাম সে সময় কোন বাস ছিল না। আর থাকলেও আমি জানতাম না কেননা আমরা ট্রেনেই যাতায়াত করতাম। তো এর আগে কখনো একা কোথাও জার্নি করি নাই। মা আমাকে একা ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলেন না। তাকে অনেক বলে শেষে রাজী করালাম। সে সময় ঢাকা থেকে একতা ও তিস্তা এক্সপ্রেস নামে দুইটি ট্রেন দিনাজপুর পর্যন্ত যেত। আমি একতা এক্সপ্রেসের রংপুর পর্যন্ত টিকেট কেটে আনলাম। আমার ট্রেনের সময় ছিল সন্ধা ৭টা। যথারিতী ৭ টা বাজার ১০ মিনিট আগে ষ্টেশনে গিয়ে হাজির । তখন পর্যন্ত ঢাকা থেকে একতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি আসেনি। তাই প্লাটফরমে হাটা হাটি করতে লাগলাম। কিন্ত ট্রেন আর আসে না। ১০/১৫ মিনিট পর ঘোষনা দেয়া হলো ট্রেনা আসতে দেরী হবে। তো কি করা যায় ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ দুষ্টুমি চাপলো সিগারেট খাবো। তাই এক প্যাকেট গোল্ডলিফ কিনলাম। একা যখন ভ্রমন করছি তো এর সাধটাও নেই।
অবশেষে ট্রেন আসল কিন্তু আমার কাংখিত একতা ট্রেন আসলনা। আসল যমুনা এক্সপ্রেস নামের আর একটি ট্রেন। কিন্তু আমি সেটা যানতাম না। আর মাইকে যে ঘোষনা দেয়া হয়েছিল তা শুনেছি কিন্তু অতটা খেয়াল করি নাই। তো যমুনা এক্সপ্রেসকে একতা এক্সপ্রেস ভেবে আমার নির্দিষ্ট আসনে বসলাম। আমার পিছে পিছে আরও তিনজন লোক এসে আমার সামনের সিটে বসলো। তারা সম্ভবত দিন মজুর ছিল। কিছুক্ষন পর ট্রেন ছাড়ল তার লম্বা হুইসেল দিয়ে। আস্তে আস্তে ট্রেন গতি বাড়াতে লাগলো আর প্লাটফরম দুরে চলে যেতে লাগল। আমি জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখছিলাম। আমার পাশে বসা লোকটা কিমনে করে যেন তার টিকিটটা বের করে দেখতে লাগলো। দেখলাম তাদের টিকিটের কালার ভিন্ন এবং এটাও দেখলাম যে টিকিটের মধ্যে যমুন এক্সপ্রেস লেখা। মনে মনে ভাবলাম ওরা মনে হয় ভুল করে অন্য ট্রেনে উঠেছে। তাই আমার পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাবেন। উনি বললেন সিরাজগঞ্জ। আমি একটু অবাক হলাম। কারন একতা ট্রেনতো সিরাজগঞ্জ যাবে না। তাই ওনাকে বললাম এটা তো সিরাজগঞ্জ যাবেন না। উনি একটা ঘাটের কথা বললেন। সম্ভবত ঘাটের নাম ফুলছড়ির ঘাট। সেখানে ওনারা নেমে যাবেন।
- ফুলছড়ির ঘাটে নামবেন ? কিন্তু এটাতো বাহাদুরাবাদ ঘাট যাবে।
- না এটা ফূলছড়ির ঘাট যাবে।
এখানে বলে রাখা ভালো তখন যমুনা সেতু তৈরী হয়নাই। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ গেলে ফেরী দিয়ে নদী পার হতে হতো। আর যেহেতু নদী পার হতে হবে সেহেতু আমার কাংখিত একতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি বাহাদুরাবাদ ঘাটে গিয়ে আমাদেরকে ফেরী ধরিয়ে দিবে।
আমি আর কিছু বললাম না। পকেট থেকে গোল্ডলিফের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট লাগিয়ে আরাম করে টানছি আর জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকার দেখছি। মনে মনে ভাবলাম হয়তো রুট চেঞ্জ হতে পারে আবার হাসতেছিলাম এই ভেবে যে লোকগুলো হয়তো ভূল ট্রেনে চড়েছে। কিন্তু আমি যে ভূল ট্রেনে চড়েছি এটা আমার কখনো মনেই হলো না।
যাক বেশ কিছুক্ষন পর টিটি আসল টিকিট চেক করার জন্য। যথারিতি সবাই টিকিট দেখাল। আমি একটু ভাব নিয়ে বাইরে তাকিয়েই আছি। লোকগুলোর টিকিট দেখার পর আমাকে টিটি টিকিট এর কথা বলল আমি বললাম আছে। তো টিটি আর কিছু বললনা। আমিও আর টিকিট দেখালাম না। টিকিট যখন দেখলো না তখন আমার ভাব আর একটু বেশী হয়ে গেল এই ভেবে যে আমার টিকিট দেখতে চায় নাই। কিছুক্ষন পর জামালপুর আসলাম। জামালপুরে ট্রেন ৫ মিনিট দাড়ালো আর লোকজন হুড়মুর করে ওঠা নামা শুরু করল। কিছুক্ষন পর আবার ট্রেন চলতে লাগলো।
জামালপুরে ট্রেন যখন থামল তখন রাত ১০ টা বাজে। জামালপুর থেকে ট্রেন ছাড়ার পর আমার পাশের লোকটা ওর সাথের জনকে বলল যে ফুলছড়ি পৌছাতে ১২টা বেজে যাবে অত রাতে নৌকা পাওয়া যাবে কিনা। ফুলছড়ির ঘাট কথাটা আমার কানে একটু বেশীই বাজলো। আমি পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা ভাই আপনি সুধু ফুলছড়ি ঘাট করছেন। এটাতো ফুলছড়ি ঘাট যাবে না। বাহাদুরাবাদ ঘাট যাবে। আপনি মনে হয় ভূল করে অন্য ট্রেনে উঠেছেন। লোকটা একটু থতমত খেয়ে গেল। সে তার পাশের জনকে বলল- যমুনা এক্সপ্রেস বাহাদুরাবাদ ঘাট যায় নাকি। জবাব দিল না।
আমার মনে একটা অজানা আতঙ্ক দেখা দিল। আমি নিজেই কি ভূল ট্রেনে উঠে বসলাম? না সেটা কিভাবে হয়। ভূল ট্রেনে বসলে তো আমার সিটে অন্য লোক এসে বসত। পাশের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করবো..... এটা একতা এক্সপ্রেস ট্রেন কিনা... লজ্জা করতে লাগলো। বেচারা আমাকে কি ভাববে। শেষে লজ্জা ভুলে আমার পাশের বসা লোকটাকেই জিজ্ঞাসা করলাম- আচ্ছা এটাতো একতা এক্সপ্রেস ট্রেন, না ?
- না। এটাতো যমুনা এক্সপ্রেস।
- কি বলছেন। এটা যমুনা এক্সপ্রেস !
ততোক্ষনে আমার কাপুনি ধরে গেছে। একটা হিমশীতল স্পর্শ আমার শরীর দিয়ে বয়ে যেতে লাগলো। হায় হায় এখন কি হবে..... আমি ভূল ট্রেনে উঠে বসলাম। এখন কি করবো ..... কোথায যাই ...... কিভাবে ফিরবো..... বিভিন্ন চিন্তা মাধায় ঢুকে আমার অবস্থা কাহিল। আমার মনে হলো এই পৃথিবিতে আমি একা... আমার কেউ নেই।
তো সেই সময় আমার ঐ জ্যাঠাতো ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো। জ্যাঠাতো ভাইকে দেখেছি বেশী টেনশনে থাকলে সিগারেট খেতো। আমিও একটা সিগারেট লাগালাম। কিন্তু টেনশন তো কমলোই না বরং কাশতে লাগলাম। না এভাবেতো থাকা যাবে না। একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কি করা যায়।
পাশের লোকটাকেই সব বললাম যে আমি তো ভূল করে অন্য ট্রেনে উঠেছি। তো এখন কি করা যাবে। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে আমাকে হা করে দেখে হাসতে লাগল। মনে হয় আমি একটা সার্কাস পার্টির জোকার। তো কি আর করি... দেখুক... বিপদে যখন পড়েছি। করার কিছুই নেই।
শেষে পাশের জনই বললেন ফুলছড়ির ঘাটে গিয়ে নামতে। সেখান থেকে একটা মালগাড়ী আবার ঢাকা ফিরবে ওতেই যেন আমি ফিরে আসি।
তো কি আর করা। ওদের কথা মত ফুলছরির ঘাটের দিকে চললাম। চললাম ঠিক নয় আমি যেতে বাধ্য হলাম। আর মনের মধ্যে ভয় না জানি সেখানে গিয়ে কোন বিপদে পরি। তাছাড়া পকেটে হাজার দুইয়েক টাকা ছিল। টাকাটার জন্য ভয় হলো যদি আবার কেউ কেড়ে নেয়। তাহলে আমি বাড়ী ফিরে যাবো কিভাবে। এসব চিন্তা করতে করতে ফুলছরির ঘাটে এসে পৌছিলাম রাত প্রায় সাড়ে বারটার দিকে। নেমে দেখি চারিদিক অন্ধকার। বেশ ঠান্ডা পরেছে। নদীর ওপাশ থেকে হু হু করে বাতাশ আসছে। মনে হচ্ছে যেন নাদীটা আমার বুকের ব্যাথাটাই হু হু করে ছাড়ছে। কোথায় যাই ..... কোন ট্রেন টাই বা ফিরে যাবে। আমার সাথের লোকটাকে বললাম। উনি আমাকে একটা মালগাড়ি দেখিয়ে বললেন ওটাই আবার ঢাকা ফিরে যাবে। দেখলাম প্যাসেঞ্জার বগিও আছে, তো আমি একটা বগিতে উঠলাম। উঠে কয়েকজন লোককে দেখলামা মম জ্বালিয়ে তাস খেলছে। আর কেমন যেন একটা গন্ধ পেলাম। মনে হচ্ছিল গাঁজা খাচ্ছিল। আমার ভিতরে ভয় ধরে গেলো। এরা যদি আমাকে মেরে ফেলে টাকাগুলো নিয়ে নেয়। ঐ বগি থেকে আর এক বগিতে গেলাম। সেখানেও একই অবস্থা। আর এক বগিতে গেলাম সেখানে তিনজন লোক গল্প করছে। চিন্তা করছি এই বগিতে থাকব না অন্য বগিতে যাব। এমন সময় তিনজনের একজন আমাকে ডাক দিয়ে বলল আমার কাছে দিয়াশলাই আছে কিনা। লোকগুলোর ভাব আমার কাছে ভাল ঠেকল না। ওদেরকে না বলে বগি থকে নেমে জনবহুল বগি খুজতে খুজতে পেয়ে গেলাম। ওখানে উঠে দেখি ১০/১২ জন লোক বসে আছে। তার মধ্যে একজন বয়স্ক লোককেও দেখে তার পাশে দিয়ে বসলাম। তাকে আমার সমস্যার কথা বললে তিনি জামালপুর ষ্টেশনে নামতে বললেন। সম্ভবত রাত ৪/৫ টার দিকে জামালপুর ষ্টেশনে এসে নামলাম। দেখি প্রচুর লোক প্লাটফরমে দাড়িয়ে আছে। টিকেট কাউন্টারের সামনে গিয়ে টিকিট কেনার জন্য টাকা বার করছি এসময় লক্ষ করলাম তিন/চার জন্য লোক খুব আক্ষেপ করছে...... এজন্যই মানুষ ট্রেনে যেতে চায় না..... রেলওয়ের কর্মচারিরা সব চোর..... এদের জন্যই এই প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাবে। আর একজন বলছেন ফেরি নদীতে আটকে গেলে কি করবে ? ফেরি নদীতে আটকে যাওয়ার কথা শুনে আরও বেশী করে কান দিলাম ওদের কথায়। আসল ঘটনা কি। শেষে ওদের কথা থেকে বুঝতে পারলাম ফেরি মাঝ নদিতে আটকে যাওয়ার জন্য একতা এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা পৌছাতে দেরী করেছে। আর এ কারনেই একতা এক্সপ্রেস ট্রেনটি গতকাল সন্ধায় ময়মনসিংহে সময় মত পৌছাতে পারে নাই। আর এই কারনে আমি ভূল করে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে ফুলছরি ঘাট থেকে ঘুরে আসতে পারলাম। ষ্টেশন মাষ্টারের কাছ থেকে শিওর হয়ে বসে থাকলাম একতা এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য। অবশেষে সকাল ৯ টায় একতা এক্সপ্রেস টেন এসে জামালপুর ষ্টেশনের প্লাটফরমে এসে থামল আর আমিও আমার নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লাম। কিছুক্ষন পর হেলে দুরে একতা এক্সপ্রেস চলতে শুরু করল।