...কলম্বাস আমেরিকায় পৌছানোর সময়ে আদি আমেরিকানদের যেসব অঞ্চলে সে সময়কার উন্নত সভ্যতা ছিল সেগুলো হলো আন্দাজ-- এর "ইনকা", গুয়েতামালার "মায়া", মধ্য মেক্সিকোর "আজটেক"। বলাই বাহুল্য যে, এসব সভ্যতা ইউরোপ থেকে সম্পুর্ন বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল ও বিকশিত হয়েছিলো। কৃষি উৎপাদন, বস্ত্র উৎপাদন উৎপাদন ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান পশ্চাৎপদ ছিল না।
উদ্ভিদ--এর চারশত প্রজাতি তখন তাদের জানা ছিল যেগুলো সেসময়কার এশিয়া বা ইউরোপে জানা ছিল না। উন্নয়নের মধ্য দিয়ে অনেক ভ্রাম্যমান- যাযাবর গোষ্ঠী ধীরে ধীরে স্থায়ী বসতি শুরু করে এবং সভ্যতা গড়ে উঠতে থাকে। হস্তশিল্প, বস্ত্রশিল্প, মৃৎশিল্প এর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, "মায়া" দের মধ্যে গণিত ও জোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান ছিল অধিকতর উন্নত। ইউরোপীয় বা এশীয়দের মতো তাদের গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ঘোড়া, শুয়োর ছিলনা। তাদের ছিলো কুকুর , টার্কি, এবং গিনিপিগ। তাদের জানা ছিল না লোহার ব্যবহার এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ যে তাদের ছিল না আগ্নেয়াস্ত্র। ঘোড়া এবং আগ্নেয়াস্ত্র ইউরোপীয়দের বিজয় সুনিশ্চিত করবার অন্যতম অবলম্বন ছিল।
কলম্বাস প্রথম যেখানে নামেন তা পুরনো ঐতিহাসিকদের কাছে পরিচিত ছিল "হিস্পাহানীওয়ালা" নামে, এখন যা "হাইতি" এবং "ডোমিনিক্যান প্রজাতি" নামে পরিচিত। ১৫৫২ সালে ডি লাস কেসাস নামে একজন স্পেনীয় "ব্রিফ একাউন্ট অব দ্য ডেস্ট্রাকশন অব ইন্ডিজ" নামে যে পুস্তিকা প্রকাশ করেন তার সুত্র ধরে একজন আদি আমেরিকান হ্যান কলিং ইতিহাসের পুনর্লিখনে সচেষ্ট হয়েছেন এখন। কেসাস লিখেছেন, "স্পেনীয়রা এই ভূখন্ডে নামার সঙ্গে সঙ্গে যেরকম বন্যজন্তুর মত নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল তার সাথে আদিবাসীদের কোন পূর্বপরিচয় ছিল না।"
হ্যান কলিং আরও জানাচ্ছেন, কলম্বাস ইউরোপে স্বর্ণ পাহাড় নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে তিনি এবং তার উত্তরসূরীরা একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। ১৪৯৩ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে হিস্পানীওয়ালা জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায়।
শুধু এই অঞ্চলে ঐ সময়ে নিহত শিশু, বয়স্ক, নারী, পুরুষ মিলে মতান্তরে দেড় লাখ থেকে ৫ লাখ দাঁড়ায়। দ্বীপের জনসংখ্যা মোটামুটি শেষ করার পর অন্যান্য দ্বীপে অভিযান চালান হয়। যেগুলোর মধ্যে প্রথমে আসে কিউবা, জ্যামাইকা, এবং সান জুয়ান (পরে যার নাম হয়েছে পুয়ের্টোরিকো) হত্যাকান্ড এবং দাস সংগ্রহ এক সঙ্গে চলতে থাকে। এক পর্যায়ে ম্যাচাচুচেটস উপত্যকার গভর্ণরের কাছে প্রতি একজন পুরুষের মাথার জন্য ৮০ পাউন্ড এবং নারীর জন্য ২০ পাউন্ড পাওয়া যেত। এছারা ইউরোপীয়দের আনা, আদি আমেরিকানদের অজানা-- বসন্ত, যক্ষা ও সিফিলিস রোগে-মহামারীতে বহু মানুষ মরেছেন।
ইউরোপীয় "সভ্যতা" আমেরিকা "আবিষ্কার" করেই ক্ষান্ত হয়নি। সেখানকার জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ প্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতা ধ্বংস, মানুষকে হত্যা কিংবা দাসে পরিণত করেছে। একজন মার্কিন ছাত্র সঠিকভাবেই সাম্প্রতিক (এই বইটি ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত) উপসাগরীয় যুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেনঃ "এই ঘটনা কলম্বাসের আবিষ্কারেরই ধারাবাহিকতা। এদের কাছে সব আগ্রাসনই আবিষ্কার। সব হত্যাকান্ডই সভ্যতা।"
নিউইয়র্কে প্রাকৃ্তিক ইতিহাস মিউজিয়ামে একটি ছবি আছে, বেশ বড় করে বাঁধানো। ম্যানহাটানে আটলান্টিকের ধারে একজন ইউরোপীয় ক্যাপ্টেন দঁড়ানো, দূরে আটলান্টিকের তীরে জাহাজ নোঙর করা, মালামাল নামাচ্ছে আদি আমেরিকানরা, প্রায় উলংগ নারী-পুরুষ। স্থানে স্থানে সৈ্নিক অস্ত্র হাতে। ক্যাপ্টেনের পেছনে একটি দূর্গের ছবি। একজন আদি আমেরিকান, সর্দার ধরনের, হাত জোড় করে তাকে কর দিচ্ছে। সশস্ত্র সৈনিকদের নিরস্ত্র জনগনের উপর বিজয়ের এই ছবি সৃষ্টি হয়েছে ১৪৯২ এর বেশ কিছু পর, যে ছবিকে মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে "শান্তি প্রতিষ্ঠার" একটি স্মারক হিসেবে ! ...
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ
"কলম্বাসের আমেরিকা "আবিষ্কার" এবং বহুজাতিক মানুষেরা" থেকে নেওয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১২:৩১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




