এ কথাটি মারাত্নক ভুল কথা বলেছেন এই মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন নারী নীতি ২০১১ এ রাষ্ট্রীয় ও গনজীবনে নারী ও পুরুষের সম অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই আইন ব্যক্তিগত জীবনে কার্যকর কোন আইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। এখানে মন্ত্রীর বক্তব্যই এদেশের নারীর জীবন-যাপন ও অধিকারের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এদেশের নারীদের ভবিষ্যতে যে আরো কঠিন, আরো ভয়াবহ ও আরো খারাপ জীবন-যাপন করতে হবে মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে সেই প্রমাণই পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেছেন, নারীর রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনে নারী ও পুরুষের সম অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
হায় রে বাংলাদেশের হত্যভাগ্য নারীদের শাসকগোষ্ঠী।
হায় এদেশের নারী সমাজ! হায়, এদেশের সরকার!
যদি নারীর ব্যক্তিজীবন নারী রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হবে তাহলে কেন সন্তান প্রসবের সময় কোন নারী মারা গেলে সেটা মাতৃস্বাস্থ্যের অবনতি হিসেবে ধরা হয়?
কেন স্কুলে যাওয়া মেয়ে শিশুর সংখ্যার হিসাব করে নির্ধারণ করা হয় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি-অবনতির চিত্র?
কেন শিশু মৃত্যু কমানো এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার কাজ করে?
কেন রাস্তায় ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে কোন মেয়ে শিশু বা নারী আত্নহত্যা করলে দেশের আইন শৃক্সখলা পরিস্থিতির অবনতির কথা চিন্তা করা হয়?
কেন নারীর চলাফেরা নিশ্চিত করতে রাস্তায় ভ্রাম্যমান আদালত নামিয়ে ইভটিজার বখাটেদের শায়েস্তা করা হয়?
কেন তাহলে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন আছে?
কেন দেশে শিশুর জীবনমান উন্নয়নে শিশু নীতি তৈরি করা হয়েছে?
কেন তাহলে দেশে যৌতুক বিরোধী আইন আছে?
কেন এদেশে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন আছে?
কেন দেশের নারীর জীবনমান উন্নয়নে নারী নীতি ২০১১ অনুমোদন দেয়া হলো?
কেন এদেশের সরকার নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ ( সিডও) কয়েকটি ধারায় আপত্তি রেখে সাক্ষর করেছে?
কেন এদেশের সরকার দেশে এতকিছু থাকতে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন ২০১১ তৈরি করল?
নারীর জন্ম, বিয়ে, বেড়ে উঠা, তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন সবকিছুই তো নারীর একান্ত ব্যক্তিগত, তবে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সরকারেরই বা কেন এত মাথা ব্যথা! আর নারীর জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় তবে কেন তৈরি করা হলো!
আসলে এদেশের নারীদেরই দূর্ভাগ্য। নারীদের জন্য যাকে এবং যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। তারা জানে না আসলে ঠিক কি করলে নারীর জন্য সত্যিকারের উপকার হবে। ঠিক কি করলে নারীর কাজে আসবে। এই ইভজিটিং, যৌতুকের কারণে হত্যা, বাল্যবিয়ে, নারীর অশিক্ষা এসবের মূলে রয়েছে নারীর সম্পত্তিতে অধিকার না থাকা। বাবা-মায়ের পরিবারে ঠিক যেমন ছেলে সন্তান উত্তরাধিকারী হচ্ছে একইভাবে যদি মেয়ে সন্তানও পরিবারের উত্তরাধিকারি হবার সুযোগ পেত তাহলে নারীর প্রতি বৈষম্য ৫০ শতাংশ জন্মের আগেই কমে যেত। বাকি ৫০ শতাংশ কমানোর জন্য রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সচেতনতামুলক কার্যক্রমের প্রয়োজন। এরমধ্যে ১০ শতাংশ শিক্ষার মাধ্যমে, ১০ শতাংশ দেশের, পরিবারের, সমাজে সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বিভেদের প্রচলিত সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে রাষ্ট্র ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সচেতনতামুলক কার্যক্রম গ্রহণ, ১০ শতাংশ কন্যাশিশুর পরিবারের মানসিকতার পরিবর্তন, ১০ শতাংশ কন্যাশিশুর জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্রের সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং ১০ শতাংশ যে নিজে নারী, মা, কন্যাশিশু এবং দেশের নারী সম্প্রদায় সে নিজে এগিয়ে আসার মাধ্যমে। এভাবে দেশের নারীদের জীবনমান উন্নয়নে মোট ১০০ শতাংশ সফলতা আনা সম্ভব এবং নারী-পুরুষ বৈষম্যরোধ করা সম্ভব। কিন্তু মূল যে ৫০ শতাংশ কাজ রাষ্ট্রকে করতে হবে। সেখানেই রাষ্ট্র ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আমাদের মাননীয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নারীরা তাদের স¤পত্তির ভাগ পাবে তেমনি হিন্দুদের েেত্র তাদের ধর্মীয় আইন কার্যকর থাকবে। বিবাহ বন্দনের েেত্র ও সকলে ¯^ ¯^ ধর্মীয় আইন মেনে চলবে।কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো কেন? কেন এই বাংলাদেশের নারীদের ধর্মীয় আইন মেনে চলার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এই দেশটি কি শরীয়া ল মেনে চলে যে এদেশের নারীদের শরীয়া ল অনুযায়ী চলতে হবে? এই দেশটি কি সংবিধানের আইন মেনে চলে না? সংবিধানে তো নারী পুরুষ উভয়ের সমান সুযোগ ও অধিকারের কথা বলা হয়েছে তাহলে এখানে দ্বিমত পোষণ কেন করা হলো। আমাদের রাষ্ট্রের পরিচালকরা কি জানে না কন্যাশিশু ভ্রæণ হত্যার পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ নারীর উত্তরাধিকারে বিশেষ করে সম্পত্তিতে সমানাধিকার না থাকা। এর পরেই রয়েছে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। অভিভাবকের শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। এতকিছুর পরও কেন আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানদের ঘুম ভাঙেনা? আর তারা বিশ্বের বড় বড় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে যখন নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে বড় বড় বক্তৃতা দেয় তখন তারা কিভাবে বছরের পর বছর ধরে মিথ্যে কথা বলে যায়? তারা পারে কিভাবে? মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, আপনার বক্তব্য দেখে এদেশের সচেতন নারী সমাজ সত্যিই হতাশ হয়। আপনি কেন ঐ মোল্লাদের পক্ষে দিনরাত কথা বলে যান। আপনার কি ধারণা মোল্লারা আপনাকে সাহায্য করবে?
প্রতিমন্ত্রী মহাশয়, আপনার মতো একজন মানুষ হয়েই রাজা রামমোহন রায় তখনকার কট্টর হিন্দুসমাজের পিছনে লড়াই করে সতিদাহ প্রথা বন্ধ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু নারীর বিধবা বিবাহ আইন প্রতিষ্ঠা করেন। আর এই ২০১১ সালে এসে যখন দেশের দুই দুই জন নারী প্রধান মন্ত্রী হয়ে এদেশ শাসন করেছেন এবং করছেন। চারবার। এদেশের ¯^রাষ্ট্রমন্ত্রী নারী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারী, কৃষি মন্ত্রী নারী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী নারী, জজ নারী, আইনজীবী নারী, পুলিশ কর্মকর্তা নারী, ডাক্তার আর নার্সের কথা বাদই দিলাম। পার্লামেন্টেই আছে ১৯ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য। অনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কথা বাদই দিলাম। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী শুনেছি আপনি নাকি ভয় পান যে, এদেশের নারীরা বিয়েতে যে মোহরানা পায় সেটা ছেলেরা দেয়া বন্ধ করে দেবে। তাই আপনি সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ভয় পাচ্ছেন। যদি পুরুষেরা নারীকে মোহরানা না দেয় তখন নারীর কি হবে! মাননীয় নেত্রী, বিশ্বের যে সব রাষ্ট্র খ্রিস্টান ধর্মের নিয়ম মেনে চলে তারা কি বিয়েতে মোহরানা দেয় না একটু খোঁজ নিয়ে দেখেছেন কি! সেখানে নারীর সম্পত্তির পূর্ণ অধিকারের বিষয়ে কোথায় কোথায় বাধা এসেছে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন কি!
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আপনি যখন নারীদের জন্য কোন উদাহরণ দেখতে চান তখন নারীর জন্য উন্নয়নমূলক আইনগুলোর দিকেই দেখুন প্লিজ। এতে করে আপনার আমার আমাদের সবার উপকার হবে।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আপনার হাতে খুবই অল্প সময় আছে। আপনার নেত্রীই সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেছেন এদেশের নারীদের বিদ্রোহী হতে হবে। আপনার হাতে সেই শক্তি আছে। আপনি সত্যিকারের বিদ্রোহীর পরিচয় দিন।
মন্ত্রীসভার মিটিংয়ে টেবিল চাপড়ে সবার সামনে আপনার নেতাকে বলুন, আমাকে যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন সে মন্ত্রণালয়ের নারীদের পায়ের তলা শক্ত মাটি লাগবে। মেয়ে শিশূর জীবন রক্ষা করতে চাইলে অবশ্যই তাদেরকে পিতা-মাতার সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার দিতে হবে। তাদের যদি সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার দিতে না পারি কোন ভাবেই কন্যা শিশু হত্যা, ইভটিজিং, যৌতুক এগুলো আমি বন্ধ করতে পারবনা।
আপনি বলুন, দাম্পত্য জীবনে অশান্তির বড় একটি কারণ নারীর সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার না থাকা। আজ নারীর সম্পত্তিতে পুর্ণ অধিকার নেই বলেই ¯^ামী যখন-তখন তাকে পিটিয়ে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে। যখন ¯^ামী-স্ত্রীর দুজনের সম্পদে পূর্ন অধিকার চলে আসবে তখন চাইলেই ¯^ামী স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারবে না।
আপনিই পারেন দেশ প্রধান শেখ হাসিনাকে বোঝাতে। আমার বিশ্বাস অন্তত নারীর সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকারের বিষয়ে আপনাদের প্রধান অপজিশন বেগম খালেদা জিয়া বিরুদ্ধাচারণ করবেন না। কারণ উনি সম্প্রতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন নারীর হাত সম্পদ চলে গেলে কি ভয়াবহ যন্ত্রণা হয়। উনি তো একজন নারী। উনি দলীয় প্রয়োজনে আপনাদের পাশে দাঁড়াবেন না ঠিকই। কিন্তু মনে মনে আপনাদের ধন্যবাদ দেবেন। কারণ এতে করে তার, তার ছেলের বউ, প্রাণপ্রিয় নাতনীটিরও জীবন সুন্দর হয়ে উঠবে।
আপনি যখন আপনার নেতার সঙ্গে কথা বলতে যান ভাবেন ঐ সেই হরতাল করা ব্যক্তিটি বুঝি আপনাদের পথ রোধ করে দাঁড়াবে! কিন্তু আপনি কি জানেন এই দেশের কত লক্ষ লক্ষ বাবা প্রতিদিন আশা করেন আপনাদের সেই ঘোষণার যেখানে মেয়ে সন্তানকেও পিতার সন্তানের মতোই উত্তরাধিকারী একইভাবে করা হয়েছে। কারণ যে বাবার মেয়ে সন্তান আছে, ছেলে নেই তার মৃত্যুর পরে সে মেয়েকে অসহায় অবস্থায় দেখতে চায় না। বাবা টা সাহস করে সন্তানকে সম্পত্তি লিখে দিতেও পারেনা। কিন্তু রাষ্ট্র যদি ঐ বাবাটির বা ঐ ধরণের বাবাগুলোর পাশে দাঁড়াতো তাহলে আর তাদের কোন ভয় থাকত না।
রাষ্ট্রই তো পারে একজন মানুষ সুন্দর ¯^াভাবিক ও সুষ্ঠু জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দিতে।
প্লিজ মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কতকাল আর চোখ খুলে চোখ বুজে থাকবেন। দয়া করে একজন নারীর চোখে, একজন মন্ত্রীর চোখে, একজন মানবতাবাদীর চোখে এদেশের নারীদের দিকে তাকান। এদেশের নারীদের সত্যিকারের সমস্যা সমাধানে কাজ করুন। ওই সব ভুয়া গালগল্প দিয়ে নারীর অধিকার আর কত! দয়া করে নারীর প্রতি বৈষম্য মূলক বক্তৃতাও বাদ দিন।
তাসকিনা ইয়াসমিন
২০.০৭.২০১১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




