somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘ছহি রকেট সায়েন্স শিক্ষা’র ছহি অথবা অছহি রিভিউ

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পড়ে শেষ করলাম হাসান মাহবুব-এর দ্বিতীয় উপন্যাস- ‘ছহি রকেট সায়েন্স শিক্ষা’। রকেট সায়েন্স আবার কী? সেটা কোথায় শেখায়? লেখক কিভাবে শিখলেন? কেনইবা রকেট সায়েন্স শিখতে হবে?
আমার পরিচিত একজন তো বলেই ফেললেন, ‘আমি সায়েন্সের বইয়ে ঠিক আগ্রহ বোধ করি না। সায়েন্স আমার কাছে খুব খটোমটো লাগে।’ এটা যে আসলে কোনো সায়েন্সের বই না, সেটা তাকে বোঝাতে আমার দশ মিনিট লেগেছে।
আগ্রহী এবং মোটামুটি মানের পাঠকমাত্রই খুব দ্রুত বুঝে ফেলতে পারবেন, বইটা যা কিছু নিয়েই হোক না কেন, প্রহসনমূলক কিছুই। বহুল চর্চিত শব্দ ‘ছহি’তেই সেই বার্তা নিহিত। এই একই শব্দযুক্ত বইয়ের নাম আপনি শহরের ফুটপাতে, শহরের এবং গ্রাম-মফস্বলের সাধারণ বইয়ের দোকানে অনেক দেখেছেন। দাম্পত্য জীবন সুখী করে তোলার ছহি তরিকা জানাতে অনেক হিতাকাঙ্ক্ষী এবং চিন্তাশীল আত্মীয়কেও এমন বই উপহার দিতে দেখা যায় স্বজনদের বিয়েতে।
‘ছহি রকেট সায়েন্স শিক্ষা’র’ ‘ছহি’ও তার চেয়ে আলাদা কিছু না। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র তাতিন সেসব মানুষদেরই একজন, যে জীবনভর কেবল ‘উপায়’ খুঁজেছে। বাজারে নানা ‘উপায়ে’ সমৃদ্ধ এসব রকমারি বইয়ের আসলে মানুষকে শর্টকাট পথ বাতলে দেয়াই উদ্দেশ্য। ইংরেজি ভাষা থেকে শুরু করে গ্রাফিক্স ডিজাইন, গণিত শিখন থেকে শুরু করে দাম্পত্য জীবনে সুখ অর্জন, সব কিছুই আপনি শর্টকাটে কিভাবে পারবেন বা পাবেন সে বিষয়ে আপনাকে শিক্ষিত করে তোলাই এসব বইয়ের লেখকদের উদ্দেশ্য। কিন্তু কেন? কারণ- আমরা শর্টকাট উপায় খুঁজে বেড়াই। তাতিন আমাদের এই অতি এ্যাভারেজ বৈশিষ্ট্যেরই প্রতিভূ।
কোনো কিছু কতটা সহজ সেই মাত্রা বোঝাতে ইংরেজিতে ‘রকেট সায়েন্স’ একটা প্রচলিত এক্সপ্রেশন। যেমন- ‘Why are you thinking so much? You can do it easily. This is not a rocket science!’ তাতিন মনে করে, আমি যদি রকেট সায়েন্স শিখে ফেলতে পারি, তাহলে আমাকে আর ঠেকায় কে? সবচে’ কঠিন বিষয়টিই যদি আমি রপ্ত করে ফেলি, আর কিছুই তো কঠিন থাকবে না! পুরো বিষয়টিই আসলে এক চরম বিদ্রুপ। শৈশব থেকে শুরু করে যৌবন পর্যন্ত তাতিনকে লেখকের এই বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এক কথায়, প্রতিটি এ্যাভারেজ মানুষের প্রতিই এই বিদ্রুপ; যাদের চিন্তা করার আগ্রহ নেই, ব্যর্থতাকে ভয় করে এবং সব কিছুতে সাফল্য চায় বলে শর্টকাট পথ খোঁজে। ফলাফল, যাবতীয় ক্রাইসিস হতে বঞ্চিত হয়ে আত্মোন্নয়নের সুযোগ হারায়; অথচ তারা সামাজিক মানদন্ডে ‘স্মার্ট’ মানুষ।
কিন্তু কোনো মানুষ কি নিজে থেকেই এ্যাভারেজ হয়? আমার মেন্টর হিমালয় পাই বলেছিলেন- ‘মানুষ আসলে এ্যাভারেজ হয়েই জন্মায়। নিজের চেষ্টায় কেউ কেউ সেই বৃত্ত ভাঙতে পারে।’ আবার কেউ কেউ বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কোন না কোন বিশেষত্ব থাকে, পারিপার্শ্বিকের কারণে সেসব বিকশিত না হতে পেরে এক সময় হারিয়ে যায়।’ লেখক একই সাথে দুটো দিকই দেখিয়েছেন। কুশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ভুলভাল আচার-প্রথার পাঁকে অনেক সম্ভাবনাই নিমজ্জিত হয়ে যায়। তাতিনেরও ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যখনই বৃত্ত ভেঙে একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে তার আত্মপ্রকাশের সুযোগ এসেছে, ততোবারই শৈশবে মস্তিষ্কে প্রথিত হয়ে যাওয়া গোঁড়ামি তাকে বাধ সেধেছে। কিন্তু আত্মোন্নয়নের জন্য তাতিনের তেমন কোনো সদিচ্ছা বা সংগ্রামও চোখে পড়ে না। সংক্ষেপে সাফল্য লাভের চিন্তায় সে পরিশেষে স্রোতেই গা ভাসিয়ে দেয়।
লেখক এমন একটি চরিত্র এঁকেছেন, আশেপাশে একটু তাকান, নয়তো তাকান নিজের দিকে, দেখতে পাবেন এমন অনেক।
তারপরও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। বইয়ের গল্পকথক তাতিন নিজে। সে বর্তমানে বসে তার অতীতকে বর্ণনা করছে। দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে সে বলছে, সে বুঝতে পারছিল সে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। তার মানে, সে জানে সে অন্ধকারেই আছে। যে মানুষ নিজের অন্ধত্ব সম্পর্কে অবগত নয়, সে আলোর সন্ধান পাবে না কখনো। কিন্তু যে বুঝতে পারছে সে অন্ধকারেই আছে, সে সেই জীবন কেন যাপন করছে? সে নিজেই তার স্তর সম্পর্কে অবগত, কিন্তু সংক্ষেপে সাফল্যে লাভের লোভে, সামাজিক মানদন্ডে ‘স্মার্ট’ হওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত নিজেকে উপস্থাপন করছে নিজের বিপরীতে? হতে পারে। কিন্তু যার মধ্যে এই বোধ সারাক্ষণই কাজ করছে যে ‘আমি স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলাম’, ‘আমি অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম’, সে তো আদৌ বোধহীন নয়! গতানুগতিক জীবনাচরণে সে যতই অভ্যস্ত হোক, আলো সে খুঁজে নেবেই। সীমাবদ্ধতা তাকে কতক্ষণ আটকে রাখবে? তাতিনের ভবিষ্যৎ তাহলে কী? লেখক জানেন, অথবা পাঠক নিজ নিজ মতো ব্যাখ্যা করবেন।
আচ্ছা, এ্যাভারেজ মানুষ কেন এ্যাভারেজ হলো? প্রভাবক দেখাতে গিয়ে লেখক সবচে’ বেশি দেখিয়েছেন ধর্মীয় গোঁড়ামিকে। পুরো বইয়েই একজন খারাপ ধরণের হুজুরের তুমুল আধিপত্য। আছে আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাও। এ দুটো মুখ্য হতে পারে। কিন্তু আরও অনেক কিছুই তো আছে। লেখক এই দুটো প্রভাবকে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন বলে সেগুলো কি তার চোখ এড়িয়ে গেল?? আরবি হরফ লিপিবদ্ধ সবুজ পতাকা নিয়ে, গরুর পিঠে চড়ে হুজুরের আক্রমণের মেটাফোরটা সরল লেগেছে। লেখকের ইনটেনশন যাই হোক, এতটা প্রয়োজন ছিল না মনে হয়।
তবে আর কিছুর জন্য না পড়লেও, অসাধারণ রস আস্বাদনের জন্য হলেও বইটি পড়া যায়। তীর্যক প্রকাশে এই বই মর্মান্তিক, আর রসে টই-টম্বুর। দু-একটা জায়গায় অবশ্য তাৎক্ষনিকভাবে রসের হাঁড়ি কাত হয়ে রস পড়ে গেছে বিবৃতিমূলক বাক্য দিয়ে অনুচ্ছেদ শুরু হওয়ার কারণে। অর্থাৎ, পরের প্যারায় আকস্মিক ভাবটা বজায় থাকলে হাসিটা অনেক্ষণ ঠোঁটে ঝুলে থাকত (অন্য সব কিছুর মতো এটাও একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত)। আর গদ্যশৈলীতে হাসান মাহবুবের সেই পরিচিত ছোট গল্পের ঢঙ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।

পুনশ্চ ১- লেখককে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার ছদ্মনাম কী হলে ভালো হত। তিনি বলেছিলেন, ‘নীল প্রহেলিকা’, এবং আমি যে ‘প্রহেলিকা’ নামে চতুর্মাত্রিক ব্লগে একটা আইডি খুলেছিলাম সেই তথ্য তিনি জানতেন না। আমি আমার অপ্রকাশিত কিশোর উপন্যাসের দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ বইয়ের কথা লিখেছি, লেখকও যে একই কান্ড করেছেন, সেই তথ্য বই পড়ার আগে আমিও জানতাম না। দুনিয়া কি নিছকই কাকতালীয় ঘটনার?

পুনশ্চ ২- শাদা আর কালো দেখে অধিকাংশ মন, মধ্যবর্তী শেডগুলো দেখে কত জন??




সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:০১
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×