somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ডাইনী

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ডাইনীদের সম্পর্কে টীকা-ভাষ্য

রূপকথার গল্পে ডাইনীদের কালো হ্যাট আর কালো আলখাল্লার মত হাস্যকর পোশাক পরে থাকতে দেখা যায়। ঝাঁটার হাতলে চড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কিন্তু এটা কোনো রূপকথার গল্প না। এখানে সত্যিকারের ডাইনীদের নিয়েই কথা হচ্ছে।

সত্যিকারের ডাইনীদের সম্পর্কে যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তোমাদের জানা দরকার, সেগুলো হলো—
কী বলছি, মন দিয়ে শোন, ভুলো না কখনো—

তারা সাধারণ মেয়েদের মতই জামা-কাপড় পরে। তাই তাদের সাধারণ মেয়েদের মতই লাগে। তারা সাধারণ বাসা-বাড়িতে থাকে, আর সাধারণ চাকরি করে। এজন্যই তাদের সহজে চেনা যায় না।

একজন সত্যিকারের ডাইনী বাচ্চাদের খুবই ঘৃণা করে। উত্তপ্ত, লাল সিজলিং এর মতো সেই ঘৃণা। এমন ভীষণ ঘৃণা তোমাদের মন কল্পনাও করতে পারবে না।

নিজের এলাকায় কোনো বাচ্চা-কাচ্চা পেলেই কিভাবে তাকে হাপিশ করে দেয়া যায়, সেই পাঁয়তারা করতেই করতেই তার দিন গুজরান হয়। একের পর এক বাচ্চাদের ঘায়েল করাই তার সবচে' প্রিয় কাজ। সে কোনো সুপার মার্কেটের ক্যাশিয়ার, নাকি কোনো ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত চিঠি-লেখক, নাকি কোনো নিউ মডেল গাড়ির ড্রাইভার, (যে কোনো কিছুই সে হতে পারে) এগুলো কোনো ব্যাপারই না। তার মন সারাক্ষণই হাঁউ-মাউ-খাঁউ ধরনের রক্তপিপাসু চিন্তায় ঘুরপাক খেতে থাকে।

নিজের মনে এক কথাই সে দিবানিশি আওড়াবে- “কোনটা? ঠিক কোনটাকে ধরব এবার? কোনটাকে ধরে চপাৎ করে চিপব?”

সত্যিকারের ডাইনীরা বাচ্চাদের চিপে-চাবকে এতই মজা পায়, তা হয়ত তুমি গাঢ় ক্রিমে মাখিয়ে ফুল প্লেট স্ট্রবেরি খেয়ে পাও।

প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটা বাচ্চা তার চাইই। তা না হলে তার মেজাজ খিঁচড়ে যায়। সপ্তাহে একটা মানে, বছরে বায়ান্নটা।

“চিপ, মোচড়াও, আর ভ্যানিশ করে দাও।”—এটাই ডাইনীদের জীবনের মূল মন্ত্র।

শিকার তারা ধরে খুব সাবধানে, যতটা সাবধানে কোনো শিকারী বনের পাখি শিকার করে। সাবধানে পা ফেলে, নিঃশব্দে এগোয়, কাছে যায়, আরেকটু কাছে...তারপর? খপ! ডাইনী লাফিয়ে ওঠে। আগুনের ফুলকি ছোটে। শিখা লকলক করে। তেল ফুটে। ইঁদুর চেঁচায়। চামড়া কুঁচকে আসে। আর? আর বাচ্চাটা ভ্যানিশ হয়ে যায়!
একটা বিষয় বুঝতে হবে তোমাদের—একজন ডাইনী কখনো বাচ্চাদের মাথায় আঘাত করবে না। ছোরা বিঁধে দেবে না। কিংবা পিস্তল দিয়ে গুলিও করবে না। এই ধরনের কাজ করে যে কেউই পুলিশের হাত ধরা পড়ে যায়। কিন্তু ডাইনীরা কখনো ধরা পড়ে না।

ভুলে যেও না, তার আঙুলে জাদু আছে। রক্তে তার শয়তানী নাচন। সে ব্যাঙের মতো পাথরকেও লাফানোর বিদ্যে জানে। পানির ওপর নাচাতে জানে লকলকে আগুনের শিখা। তার এসব জাদুশক্তি খুবই ভয়াবহ।

ভাগ্যিস, পৃথিবীতে খুব বেশি সত্যিকারের ডাইনী নেই। কিন্তু যা আছে, তাও তোমাদের ভয় পাইয়ে দিতে যথেষ্ট। ইংল্যান্ডে সব মিলিয়ে প্রায় একশ’র মতো ডাইনী আছে। কিছু কিছু দেশে আরও বেশি আছে। আবার কিছু দেশে খুব একটা বেশি নেই। তবে কোনো দেশই ডাইনীদের কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।

একজন ডাইনী সব সময়ই হবে স্ত্রী লিঙ্গের।

না, মেয়েদের সম্পর্কে খারাপ কিছু বলার ইচ্ছে আমার নেই। বেশিরভাগ মেয়েই অসাধারণ। কিন্তু তারপরও এটাই সত্য যে, সব ডাইনীই মেয়ে। ছেলে ডাইনী বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

আবার, পিশাচরা সব সময়ই ছেলে। বারগেস্টও*তাই, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এদের কোনটাই ডাইনীদের মতো বিপজ্জনক না।

যতদূর মনে হয়, পৃথিবীতে জীবিত যা কিছু আছে, ডাইনীরাই তার মধ্যে সবচে’ ভয়ঙ্কর। তারা দেখতে আদৌ ভয়ঙ্কর নয়, এটা তাদের আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। এমনকি তোমরা যদি তাদের সব গোপন কথা জেনে ফ্যালো (কিছুক্ষণের মধ্যেই জানবে), তারপরও নিশ্চিত হতে পারবে না, যার দিকে তাকিয়ে আছো সে আসলে কোনো ডাইনী, নাকি কোনো ভদ্র মহিলা। কোনো বাঘ যদি একটা বড়সড় কুকুরের রূপ ধরে লেজ নাড়তে থাকে, তোমরা হয়ত চাইবে তার মাথা চাপড়ে আদর করে দিতে। এরকম হলে কিন্তু সেটাই হবে জীবনের শেষ দিন। ডাইনীদের বেলায়ও ব্যাপার একই। দেখতে তাদের সবাই সুন্দরী আর ভদ্র।

দয়া করে, একটু উল্টো করেও ভাব। কোন মেয়েটা আসলে ডাইনী? কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু বাচ্চাদের ঠিক এই প্রশ্নটারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে হবে।

সবার জানা দরকার, সে তোমাদের প্রতিবেশীও হতে পারে। কিংবা আজ সকালে বাসে তোমার উল্টো দিকে উজ্জ্বল চোখের যে মেয়েটা বসে ছিল, সেও হতে পারে। লাঞ্চের আগে মিষ্টি হেসে ফাঁকা রাস্তায় তোমাকে চকলেট সেধেছিল যে মেয়েটা, হতে পারে সেও।

শুনে লাফিয়ে উঠতে পার, সে এমনকি তোমাদের স্কুলের সুন্দরী মিসও হতে পারে, যে হয়ত এই মুহূর্তে এই লেখা তোমাদের পড়ে শোনাচ্ছে! ভালো করে খেয়াল করো, এরকম একটা অদ্ভুত পরামর্শ পড়তে গিয়ে সে হয়ত হেসে উঠল এখন। গলে যেও না— এটা তার চালাকীর একটা অংশ হতে পারে।

আমি একবারের জন্যেও বলছি না যে, তোমাদের সুন্দরী মিসটি অবশ্যই ডাইনী। আমি বলতে চাচ্ছি, সে তাদের একজন হতে পারে। জোরালো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু, এখানে সবচে’ বড় ‘কিন্তু’ হলো- এটা মোটেও অসম্ভব নয়।


আহা! যদি নিশ্চিত করে বলার উপায় থাকত, কোনটি ডাইনী, আর কোনটি নয়— তবে সব ক’টাকে জড়ো করে মাংসের গ্রিন্ডারে পুরে পিষে ফেলা যেত। আফসোস! তেমন কোনো উপায় নেই। কিন্তু কিছু সংকেত আছে। তাদের সবারই একই রকমের কিছু উদ্ভট স্বভাব আছে। সেগুলো জানলে, মনে রাখতে পারলে, অল্প বয়সে তাদের কারো হাতে পড়ে চিপে ভর্তা হওয়ার আগেই তুমি দৌড়ে পালাতে পারবে।

*বারগেস্ট-(বড় বড় নখ,থাবা আর দাঁতযুক্ত দানবীয় কালো কুকুর। ইংরেজি লোক কথায় এদের উল্লেখ আছে)

আমার দিদা

আমি নিজেই ডাইনীদের সঙ্গে দু’ দু-বার লড়াইয়ে গিয়েছি। তখন আমার ৮ বছর বয়স। প্রথম বার আমি নিরাপদেই পালাতে পেরেছিলাম। কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু দ্বিতীয় বারে আমার ভাগ্য খুব একটা ভালো ছিল না। কী যে ঘটেছিল, সেটা পড়ে তোমরা ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে পার। কিন্তু কিছুই করার নেই আমার। সত্য তো প্রকাশ করতেই হবে। সত্যি বলতে কী, এই যে আমি এখনো বেঁচে আছি, তোমাদের আজ এসব বলতে পারছি (হয়ত খুব অদ্ভুত হয়ে গেছি দেখতে), তার কৃতিত্ব পুরোটাই আমার দিদার। আমার দিদা অসাধারণ ! বিস্ময়কর মহিলা!


দিদা ছিলেন নরওয়ের বাসিন্দা। নরওয়েজিয়ানরা ডাইনীদের সম্পর্কে সবই জানে। গভীর বন আর বরফে ঢাকা পাহাড়ের দেশ নরওয়েতেই ডাইনীদের প্রথম দেখা যায় কিনা। আমার বাবা-মা দু’জনই নরওয়েজিয়ান ছিলেন। কিন্তু বাবার আবার ইংল্যান্ডে ব্যবসা ছিল। আমার তাই সেখানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা, ইংরেজি স্কুলে যেতে শুরু করা। বছরে দুবার আমরা দিদাকে দেখতে নরওয়ে আসতাম— একবার ক্রিসমাসে, আর একবার গরমের ছুটিতে। যতদূর মনে পড়ে, এই একজন মহিলাই আমার মায়ের দিকের একমাত্র জীবিত আত্মীয় ছিলেন। ভীষণ ভালোবাসতাম তাকে আমি। একসাথে থাকলে আমরা নরওয়ের ভাষায় কিংবা ইংরেজিতে কথা বলতাম। ভাষাটা কোনো ব্যাপার না- দুই ভাষাতেই আমরা দিব্যি কথা চালাতে পারতাম। একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, মা’র চেয়েও দিদার বেশি আপন ছিলাম আমি।

৭ম জন্মদিনের অল্প কিছু পরেই বাবা-মা আমাকে নরওয়ে নিয়ে গেলেন। দিদার কাছে। ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে। আর সেটাই ছিল আমাদের শেষ একসাথে থাকা। তুষার ঝরছিল। অসলোর উত্তরে আমরা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম কোথাও। আমার বাবা-মা দু’জনই সেদিন মারা গেলেন। কারণ- আমাদের গাড়ি রাস্তা থেকে ছিটকে একটা সরু পাথুরে খাদে গিয়ে পড়েছিল। আমি পেছনের সিটে ছিলাম, সিটবেল্টে দৃঢ়ভাবে বাঁধা অবস্থায়। কপাল একটু কেটে গিয়েছিল শুধু।

সেই ভয়ঙ্কর দুপুরের ভয়াবহতা আমি নিতে পারিনি। মনে হলে এখনো কাঁপন ধরে শরীরে। আমি দিদার কোলে ফিরে এলাম। দিদা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলেন। সারা রাত আমরা দু’জনে খুব কাঁদলাম।
আমি কাঁদতে কাঁদতে দিদাকে বললাম, “আমরা এখন কী করব?”
দিদা বললেন, “তুই আমার কাছে থাকবি। আমি তোকে দেখে রাখব।“
“আমি কি আর ইংল্যান্ডে ফিরছি না?”
“না, আমি তা করতে পারব না কখনোই। আমার আত্মা স্বর্গে গেলেও আমার হাড্ডি এই নরওয়েতেই পড়ে থাকবে।“


ঠিক তার পরদিনই দিদা আমাকে গল্প শোনাতে শুরু করলেন। কারণ- আমরা দু’জনেই আমাদের এই গভীর শোক ভুলে যেতে চাইছিলাম। দিদা ছিলেন দারুণ এক গল্প বলিয়ে। তিনি যা-ই বলতেন, আমি ছিলাম সবকিছুর মুগ্ধ শ্রোতা। কিন্তু ডাইনীদের প্রসঙ্গ আসার আগ পর্যন্ত সেসব গল্পে আমি খুব একটা উতলা হইনি। স্পষ্ট করে বললে, এই বিষয়ের একজন ওস্তাদ ব্যক্তি ছিলেন দিদা; এবং একটা জিনিস তিনি আমাকে খুব ভালো করেই বুঝিয়ে বলেছিলেন-- তাঁর ডাইনীদের নিয়ে বলা গল্পগুলো অন্যদের বলা গল্পের মতো কাল্পনিক নয় মোটেই। সবগুলোই সত্যি। গসপেলের বাণীর মতো সত্যি। একেকটা গল্প একেকটা ইতিহাস। ডাইনীদের নিয়ে দিদা যা যা বলছিলেন, তার সবকিছুই ঘটেছিল এক কালে—আমি সেটা বিশ্বাস করলেই বরং ভালো করতাম। তারচে’ খারাপ, আরও খারাপ ব্যাপার হলো, দিদা বলছিলেন তারা নাকি আমাদের সঙ্গে এখনো আছে। আমাদের চারপাশেই তারা আছে। সেকথাও বিশ্বাস করাই ভালো ছিল।


“দিদা, তুমি কি ঠিক বলছ? সত্যি সত্যিই সত্যি কথা বলছ?”
দিদা বললেন, “ সোনা দাদুভাই, ডাইনীদের কিভাবে চিনতে হয়, সেটা না জানা থাকলে তুই খুব বেশি দিন পৃথিবীতে টিকতে পারবি না।“
“কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তারা দেখতে সাধারণ মহিলাদের মতই। আমি তাহলে কিভাবে চিনব তাদের?”
দিদা বললেন, “তোর অবশ্যই আমার কথা শোনা উচিত। তারপর বুকে ক্রস আঁকবি, ঈশ্বরের কাছে দোয়া করবি, সব সময় সবচে’ ভালো কিছু যেন ঘটে।“

আমরা অসলোয় দিদার বাড়িতে বড় লিভিং রুমটায় বসে ছিলাম। আমি তখন ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত। জানালার পর্দাগুলো ঐ বাড়িতে কখনোই নামানো থাকত না। বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, আলকাতরার মতো কালো রাত্তিরে ধীরে ধীরে ঝরে পড়ছে তীব্র তুষার! দিদা মারাত্মক বৃদ্ধ ছিলেন। কুঁচকানো চামড়া আর মোটাসোটা দেহের মালিক, ধূসর জরির পোশাকে যে দেহকে প্রায় শ্বাসরোধ করে রাখতেন তিনি। আরাম কেদারায় রাণীর মত বসে ছিলেন দিদা, চেয়ারের প্রতি ইঞ্চি মেরে। এমনকি তার পাশে একটা ইঁদুরেরও সেঁটে থাকার জায়গা ছিল না। আর সাত বছরের আমি, রাতের পোশাক গায়ে চাপিয়ে মেঝেতে তার পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিলাম।


“কসম কেটে বল তো দিদা, তুমি আমার সাথে মজা করছ না? ভান করছ না আমার সাথে?” আমি এ কথাই বলে গেলাম বার বার।
দিদা বললেন, “শোন, আমি এমন অন্তত পাঁচটা বাচ্চার কথা জানি, যারা দুনিয়া থেকে স্রেফ ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল। আর কোনোদিনই তাদের দেখা যায়নি। ডাইনীরা নিয়ে গিয়েছিল ওদের।“
“আমার এখনো মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছ।“
“তোরও যেন একই পরিণতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি। তোকে আদর করি আমি। তাই চাই, তুই আমার সাথেই থাক।“
“হারিয়ে যাওয়া ঐ ছেলে-মেয়েগুলোর কথা বল আমাকে।“

আমি আজ পর্যন্ত যত দিদা দেখেছি, তাদের মধ্যে কেবল আমার দিদাকেই দেখেছি সিগারেট ফুঁকতে। দিদা একটা লম্বা কালো সিগারেট ধরালেন এই পর্যায়ে। জ্বলন্ত রাবারের মতো গন্ধ সিগারেটটার। দিদা বললেন,
“অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বাচ্চাদের মধ্যে প্রথম যার কথা জেনেছিলাম, তার নাম ছিল র‍্যাংহিল্ড হ্যানসেন। র‍্যাংহিল্ডের বয়স তখন প্রায় আট বছর। বাড়ির লনে ছোট বোনের সঙ্গে খেলছিল মেয়েটা। তাদের মা রান্নাঘরে রুটি সেঁকছিল। একটু নিশ্বাঃস নেয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে দেখল, র‍্যাংহিল্ড নেই।
“ ‘কোথায় র‍্যাংহিল্ড?’ মা জানতে চাইল।
র‍্যাংহিল্ডের ছোট বোন বলল, “ ‘দিদি লম্বা মহিলাটার সঙ্গে চলে গেছে। ‘
“ ‘কোন লম্বা মহিলা?’
“ ‘শাদা গ্লাভস পরা লম্বা মহিলাটা। সে দিদির হাত চেপে ধরে তাকে নিয়ে চলে গেছে।‘ ”
দিদা বললেন, “আর কেউ, কোনদিনও, র‍্যাংহিল্ডকে দেখতে পায়নি।“

আমি জানতে চাইলাম, “ তারা কি খোঁজ করে নাই তাকে?”
“তারা আশেপাশে কয়েক মাইল পর্যন্ত খুঁজেছিল। শহরের প্রতিটি মানুষ সাহায্য করেছিল। কিন্তু কখনোই তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।“
“বাকি চারটা ছেলেমেয়ের কী হয়েছিল?”
“তারাও র‍্যাংহিল্ডের মতো ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল।“
“কিভাবে, দিদা? তারা কিভাবে ভ্যানিশ হলো?”
“প্রতি বারই ঘটনা ঘটার আগে বাড়ির বাইরে এক অদ্ভুত মহিলাকে দেখা গিয়েছিল।“
“কিন্তু তারা কিভাবে ভ্যানিশ হলো?” আমি জানতে চাইলাম।
দিদা বললেন, “দ্বিতীয়টা খুবই অদ্ভুত ছিল। ক্রিস্টিয়ানসেন নামে এক পরিবার থাকত হোলমেঙ্কলেন’র দিকে। তাদের লিভিং রুমে একটা তেলচিত্র ছিল। খুব গর্ব করত তারা ওটা নিয়ে। একটা খামারবাড়ির উঠোনে কিছু হাঁস আঁকা ছিল ছবিটায়। সবুজ ঘাসে ঢাকা খামারবাড়ির উঠোনে এক দঙ্গল হাঁস। শুধু এটুকুই। ব্যাকগ্রাউন্ডে খামারবাড়িটা।
“ছবিটা অনেক বড় ছিল, আর তেমনি সুন্দরও। যাই হোক, একদিন সে বাড়ির মেয়ে সলভেগ একটা আপেল খেতে খেতে ফিরল স্কুল থেকে। সলভেগ বলছিল, এক সুন্দরী মহিলা নাকি রাস্তায় তাকে আপেলটা খেতে দিয়েছিল। তার পরদিন সকালে ছোট্ট সলভেগকে আর বিছানায় পাওয়া গেল না। সলভেগ’র বাবা-মা তাকে সব জায়গাতেই খুঁজলেন। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।
“তারপর হঠাৎ সলভেগ’র বাবা চিৎকার করে উঠলেন, ‘ঐ তো সলভেগ! হাঁসগুলোকে খাবার দিচ্ছে!” তিনি আঙুল দিয়ে তেলচিত্রটার দিকে দেখালেন। ছবির ভেতরে সলভেগকে একটা ঝুড়ি থেকে হাঁসগুলোকে রুটি ছিঁড়ে দিতে দেখা যাচ্ছিল। নিঃসন্দেহে ওটা সলভেগই ছিল। সলভেগ’র বাবা তক্ষুণি ছবিটার দিকে ছুটে গেলেন। স্পর্শ করলেন সলভেগকে। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। সলভেগ তখন শুধুই ছবি।“
“মেয়েটাকে সহ ঐ ছবিটা কি তুমি দেখেছ কখনো, দিদা?”
“বহুবার। এবং সবচে’ অদ্ভুত ব্যাপারটা ছিল কী, জানিস? ছোট্ট সলভেগ ছবিটার ভেতরে জায়গা বদল করতে থাকত। কোনদিন হয়ত তাকে দেখা যেত খামারবাড়ির ভেতরে, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বসে আছে; কখনোবা কোলে হাঁস নিয়ে ছবির বাকি অংশে দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে।“
“তুমি কি কখনো তাকে ছবির ভেতরে নড়তে দেখেছ, দিদা?”
“কখনোই না। কেউই দেখেনি। হাঁসকে খাওয়াতে দেখা যাক, কিংবা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেই দেখা যাক, সব সময়ই সে স্থির থাকত। যেন তেলরঙে আঁকা একটা শরীর। পুরো ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক। নিঃসন্দেহে অদ্ভুত! আর সবচে’ অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যত বছর গড়াচ্ছিল, ছবির ভেতরে সলভেগও বড় হচ্ছিল। দশ বছরের মধ্যে সেদিনকার ছোট্ট মেয়েটা রীতিমত যুবতী হয়ে উঠল। ত্রিশ বছরের মধ্যে তাকে মধ্যবয়স্ক দেখা গেল। তারপর চুয়ান্ন বছর পর, হঠাৎ একদিন সে ছবি থেকেও উধাও হয়ে গেল।“
“তুমি বলতে চাচ্ছ, সে মারা গেছে?”
দিদা বললেন, “কে জানে! এই ডাইনীদের দুনিয়ায় কত আজব ঘটনাই না ঘটে!


“এই নিয়ে দু’জনের কথা বলেছ তুমি আমাকে। তৃতীয় জনের কী হয়েছিল?”
“তিন নম্বরটা হলো বিরগিট স্যানসন।“ দিদা বললেন।
“সে আমাদের রোডের ঠিক পরেই থাকত। হঠাৎ করে একদিন তার শরীরে পালক গজাতে শুরু করল। মাসখানেকের মধ্যে সে বিরাট একটা শাদা মুরগী হয়ে গেল! তার বাবা-মা এক বছর পর্যন্ত তাকে বাগানে খোয়াড়ে রাখত। এমনকি ডিমও পাড়ত সে।“
“কী রঙের ডিম?”
“বাদামী। আমার জীবনে দেখা সবচে’ বড় ডিম। তার মা সেগুলো দিয়ে ওমলেট বানাত। মজা হত ওগুলো।“

আমি দিদার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সিংহাসনে বসে থাকা কোনো প্রাচীন যুগের রাণীর মত করে দিদা বসে ছিলেন ওখানে। তাঁর ঘোলাটে ধূসর চোখ দুটো যেন অনেক দূরের কোন কিছুর দিকে তাকিয়ে। সে সময় কেবল হাতের সিগারেটটার জন্যই তাঁকে বাস্তবের কেউ মনে হচ্ছিল। সিগারেটের ধোঁয়া যেন নীল মেঘের মত তাঁর মাথার চারপাশে কুন্ডলী পাকিয়ে ছিল।

আমি বললাম, “কিন্তু মুরগী হয়ে যাওয়া মেয়েটা ভ্যানিশ হয়ে যায়নি?”
“না। বিরগিট অদৃশ্য হয়নি। সে অনেক বছর বেঁচে ছিল। ঐভাবে বাদামী ডিম পাড়ত।“
“কিন্তু তুমি তো বলেছ, সবাই ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল।“
“ভুল হয়েছে। বয়স হয়ে গেছে অনেক। সবকিছু মনে করতে পারি না।“
আমি বললাম, “চার নম্বর বাচ্চাটার কী হয়েছিল?”
“চার নম্বরটা ছিল হ্যারল্ড নামের এক ছেলে। একদিন সকালে তার চামড়া ধূসর হলুদ হয়ে গেল। তারপর হয়ে গেল শক্ত আর চড়চড়ে। যেন বাদামের খোসা। সন্ধ্যার মধ্যে ছেলেটা পাথরে পরিণত হলো।“
“পাথর? তুমি বলতে চাচ্ছ, সত্যি সত্যি পাথর?”
“গ্রানাইট। দেখতে চাস তো নিয়ে যাব তোকে। তারা ওকে এখনো ঘরেই রেখে দিয়েছে। হলঘরে একটা ছোট্ট পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। দেখতে এসে লোকে ওর মাথার ওপরে ছাতা মেলে ধরে।“

খুব ছোট ছিলাম আমি, তারপরও দিদার সব কথা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু তারপরও কন্ঠস্বরে এমন দৃঢ় বিশ্বাস আর গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলছিলেন দিদা—মুখে এক ফোঁটা হাসি নেই, চোখে দুষ্টুমি নেই, আমি অবাক হতে শুরু করেছিলাম।
“বলতে থাক।“, আমি দিদাকে বললাম।
“তুমি বলেছিলে পাঁচটা বাচ্চার কথা। শেষটার কী হয়েছিল?”
“তুই কি আমার সিগারেট থেকে একটা টান দিবি?” দিদা সাধলেন।
“দিদা, আমার বয়স মাত্র সাত বছর!’
“তোর বয়স কত, সেটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। টান দিলে তোকে ঠান্ডায় ধরত না।“
“বলো দিদা, পাঁচ নম্বরটার কী হয়েছিল?”
“নম্বর পাঁচ।“ সিগারেটের শেষ অংশটা এমনভাবে চিবুলেন দিদা, যেন ওটা একটা মজার এ্যাসপ্যারাগাস। বললেন,
“সেটা আরও আচানক ঘটনা। লেইফ নামের নয় বছর বয়সী এক ছেলে গরমের ছুটি কাটাতে গিয়েছিল ফোর্ডে। পুরো পরিবার সেখানে পিকনিকে মেতে উঠেছিল। ছোট্ট দ্বীপটায় তারা কিছু নুড়ি-পাথর জমা করছিল ডুব দিয়ে। ছোট্ট লেইফ জলের তলায় ডুব দিল। তার বাবা দেখছিল তাকে। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন, লেইফ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় ধরে নিচে আছে। শেষে জলের ওপর ভেসে উঠলে দেখা গেল, সে আর লেইফ নেই।“
“সে কী হয়ে গিয়েছিল?”
“শুশুক হয়ে গিয়েছিল।“
“সে মোটেও শুশুক হয়নি। হতেই পারে না!”
“সে একটা ছোট্ট, আদুরে শুশুক হয়ে গিয়েছিল; এবং যতটা বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া যায়, ততটাই।“
“দিদা...”
“বল, সোনা।“
“সে কি আসলেই, সত্যি সত্যিই শুশুক হয়ে গিয়েছিল?”
“অবশ্যই! আমি তার মাকে খুব ভালো করে চিনতাম। তিনিই এ ব্যাপারে সবকিছু বলেছিলেন আমাকে। লেইফ পুরোটা বিকেল কিভাবে তার ভাই-বোনদের পিঠে চড়িয়ে মজা করেছিল, সেকথাও বলেছিলেন। দারুণ সময় কেটেছিল তাদের। তারপর সে তাদের দিকে জলের ঝাঁকুনি দিল একটা, আর সাঁতরে দূরে চলে গেল। আর কোনদিন তাকে দেখা যায়নি।“
“কিন্তু দিদা, তারা কিভাবে বুঝল যে, শুশুকটা আসলেই লেইফ?”
“সে কথা বলেছিল তাদের সঙ্গে। পিঠে চড়ানোর সময় সে সারাক্ষণ হাসছিল আর মজা করছিল।“
“কিন্তু এরকমটা ঘটল বলে তারা কি বিকট হাউকাউ শুরু করেনি?”
“তেমন না। তোর মনে রাখা উচিত, নরওয়েতে এই জাতীয় ঘটনায় মানুষ অভ্যস্ত। এখানে সব জায়গা ডাইনীতে ভরা। হয়ত আমাদের এই স্ট্রিটেও কেউ বাস করছে এখন। তোর ঘুমের সময় হয়ে গেছে।“
“রাতে আমার জানালা দিয়ে কোনো ডাইনী চলে আসবে না তো? আসবে?” আমি একটু শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করলাম।
“না, আসবে না। ডাইনীরা ড্রেইন-পাইপ বেয়ে ওঠার মতো কিংবা মানুষের বাড়িঘর ভেঙে ঢোকার মতো বোকাসোকা কাজ কখনোই করে না। বিছানায় তোর ভয় নেই। আয়, আমি তোর গায়ে কাঁথা দিয়ে দিচ্ছি।

*****************************
ডাইনী যেভাবে চেনা যাবে

পরের সন্ধ্যায় গোসল করিয়ে দেয়ার পর দিদা আমাকে নিয়ে আবার লিভিং রুমে বসলেন। উদ্দেশ্য অন্য কোনো গল্প বলা।
বুড়ি বললেন, “আজ রাতে তোকে ডাইনী চেনার উপায় বলব।“
“সব সময় কি তুমি নিশ্চিত থাকতে পারবে?”
“না। সব সময় পারা যাবে না। সেটাই সমস্যা। তবে তুই খুব ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারবি।“
দিদা তাঁর কোলের উপর সিগারেটের ছাই ফেলছিলেন। আমি আশা করছিলাম, ডাইনী চেনার উপায় বলার আগে তাঁর গায়ে আগুন লেগে যাবে না। দিদা বললেন-
“ প্রথমত, সত্যিকারের ডাইনীর সঙ্গে তোর দেখা হবে তার হাতে দস্তানা পরা অবস্থায়।“
“নিশ্চয়ই সব সময় না? গরমকালে যখন অনেক গরম পড়বে, তখন?”
“গরমের সময়ও। তাকে পরে থাকতে হয়। জানতে চাস, কেন?”
“কেন?”
“কারণ- তার আঙুলে আমাদের নখের মতো নখ নেই। তার বদলে পাতলা বাঁকানো নখ আছে। বিড়ালের মতো। সেগুলো লুকিয়ে রাখতেই তার দস্তানা পরে থাকা। তোকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, অনেক সম্মানিত মহিলাও দস্তানা পরে, বিশেষ করে শীতের সময়। কাজেই, এটা খুব একটা কাজে আসবে না তোর।“
“আম্মুও তো দস্তানা পরত।“
“বাসায় পরত না। ডাইনীরা এমনকি বাসায়ও দস্তানা পরে থাকে। শুধু ঘুমুতে গেলে তখন খুলে রাখে।“
“এই সবকিছু তুমি কিভাবে জানলে, দিদা?”
“কথার মধ্যিখানে কথা বলিস না। শুধু মাথায় ঢুকিয়ে নে সবকিছু। দ্বিতীয়ত মনে রাখতে হবে, ডাইনীরা সব সময় টাক মাথার হয়।“
“টাক?”
“সেদ্ধ ডিমের মতো টাক।“
আমি মনে আঘাত পেলাম। কথাটায় টাক মাথার মহিলাদের জন্য অসম্মানের কিছু একটা যেন ছিল। জিজ্ঞেস করলাম,
“তাদের মাথায় টাক কেন হয়?”
“আমাকে জিজ্ঞেস করিস না, কেন। আমার কাছ থেকে শুধু এটুকু জেনে রাখ, ডাইনীদের মাথায় চুল গজায় না। নট আ সিঙ্গেল হেয়ার।“
“কী ভয়ঙ্কর!”
“বিরক্তিকর!” দিদা বললেন।
“কিন্তু ন্যাড়া মাথার হলে তো তাকে সহজেই চিনে ফেলা যাবে!”
“মৌটেই না! একজন সত্যিকারের ডাইনী তার টাক ঢেকে রাখার জন্য সব সময় পরচুলা পরে থাকবে। উন্নত মানের পরচুলা। উন্নত মানের পরচুলাগুলো সত্যিকারের চুল থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব, যদি না তুই টেনে দেখিস খুলে আসছে কিনা।“
“তাহলে আমাকে সেটাই করতে হবে।“
দিদা বললেন, “বোকা হলে চলবে না। তুই তো প্রত্যেক মহিলার চুল টেনে টেনে দেখতে পারবি না। এমনকি সে দস্তানা পরে থাকলেও না। শুধু যাচাই করবি, আর দেখতে থাকবি কী ঘটে।“
“তাহলে এটাও আমার তেমন কাজে আসবে না?”
“এর কোনোটাই একা একা কাজে আসবে না। শুধুমাত্র সবকিছু যখন একসঙ্গে দেখতে পাবি, তখনই একটা মানে তৈরি হবে তার। মনে রাখিস...”
দিদা বলে চললেন, “ এই পরচুলাগুলো বরং ডাইনীদের জন্য চরম একটা সমস্যার হয়ে দাঁড়ায়।“
“কী সমস্যা?”
“মাথার তালুতে ভয়ানক চুলকানি বাঁধায় তারা। দেখিস, কোনো অভিনেত্রী পরচুলা পরলে সে তার আসল চুলের ওপর পরে। তুই কিংবা আমি পরলেও তাই। কিন্তু ডাইনীদের পরতে হয় সরাসরি তাদের টাকের ওপরেই। আর পরচুলার নিচের দিকটা হয় খুব রুক্ষ আর খরখরে। টাকের চামড়ায় ভয়াবহ পাঁচড়া হয় তাই। বিচ্ছিরি ঘা হয়ে যায়। ডাইনীরা এই পাঁচড়াকে বলে ‘উইগ-র‍্যাশ’।“
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ডাইনী চেনার জন্য আমাকে আর কী কী লক্ষ্য রাখতে হবে?”
"তাদের নাকের ছিদ্রগুলো খেয়াল করবি। ডাইনীদের নাকের ছিদ্রগুলো সাধারণ মানুষদের চেয়ে খানিকটা বড়। ছিদ্রের ধারগুলো গোলাপী আর বাঁকানো, একরকম সামুদ্রিক ঝিনুকের মতো।“
“তাদের নাকের ছিদ্র ওরকম বড় কেন?”
“গন্ধ পাওয়ার জন্য। ডাইনীদের ঘ্রাণশক্তি অভাবনীয়। পিচ-কালো রাতেও তারা রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো শিশুর গন্ধ পেয়ে যায়।“
“সে আমার গন্ধ পাবে না। আমি সবে গোসল করেছি।“
“পাবে! যত পরিচ্ছন্ন থাকবি, তত ভালো গন্ধ পাবে।
আমি বললাম, “এটা সত্যি হতেই পারে না।“
“একদম ঠিকঠাকভাবে পরিচ্ছন্ন কোনো শিশুর গন্ধ ডাইনীদের নাকে সবচে’ পূতি-দুর্গন্ধময় ঠেকে। যত অপরিচ্ছন্ন থাকবি, তত কম গন্ধ পাবে।“ দিদা বললেন।
“এর কোনো মানে নেই, দিদা!”
“মানে অবশ্যই আছে! ডাইনীরা ময়লার গন্ধ নেবে না, তারা নেবে তোর গন্ধটা। যে গন্ধটা ডাইনীকে পাগল করে দেবে, সেটা হচ্ছে ঠিক তোর চামড়া থেকে আসা গন্ধ। এই গন্ধ একটা ঢেউয়ের মত তোর গা থেকে বেরিয়ে আসে। ডাইনীরা এই গন্ধের ঢেউকে বলে ‘দুর্গন্ধের ঢেউ’। বাতাসে ভেসে এসে এই ঢেউ তাদের ঠিক নাক বরাবর ধাক্কা মারে।“
“এক মিনিট থামো তো এখন, দিদা......”
“কথার মধ্যে কথা বলিস না। পয়েন্টটা হচ্ছে, যখন তুই এক সপ্তাহের মতো গোসল করবি না, তোর চামড়া পুরোপুরি ময়লায় ঢেকে থাকবে, ডাইনীদের কাছে তোর ‘দুর্গন্ধের ঢেউ’ ওরকম ভালোভাবে পৌঁছাতে পারবে না।“
“আমি আর কোনদিন গোসল করব না।“
“প্রায়ই করার দরকার নেই। এক মাসে এক বার করাই বুদ্ধিমান শিশুর জন্য যথেষ্ট।“
ঠিক এরকম মুহূর্তে আমি আমার দিদাকে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেলতাম।
আমি বললাম, “কিন্তু দিদা, ঘুটঘুটে রাত হলে ডাইনীরা ছোটদের আর বড়দের গন্ধ কিভাবে আলাদা করে চিনবে?”
“চিনবে। কারণ- বড়দের গা থেকে ওরকম ‘দুর্গন্ধের ঢেউ’ বের হয় না। সেটা শুধু বাচ্চাদেরই হয়।“
“কিন্তু আমার গা থেকে তো দুর্গন্ধের ঢেউ বের হয় না! হয়? এই মুহূর্তে তো ওরকম ঢেউ বের হচ্ছে না, তাই না? হচ্ছে?”
“আমার কাছে না। আমার কাছে তো তোর গন্ধ রাস্পবেরি আর ক্রিমের মতো লাগে। কিন্তু ডাইনীদের কাছে এই গন্ধই খুব বিরক্তিকর লাগবে।“
“আমার গন্ধ কিসের মত লাগবে তাদের কাছে?”
“কুকুরের বিষ্ঠার মতো।“

আমার মাথা ঘুরে উঠল। হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। “কুকুরের বিষ্ঠা!” আমি কেঁদে উঠলাম, “আমার গন্ধ মোটেই কুকুরের বিষ্ঠার মত না। আমি বিশ্বাস করি না, করব না।“
“এর বেশি আর কী!” দিদার কথায় তৃপ্তির ছোঁয়া।
“ডাইনীদের কাছে তোর গন্ধ কুকুরের ফ্রেশ বিষ্ঠার মতো।“
আমি চেঁচিয়ে বললাম, “এটা মোটেও সত্যি না! আমি জানি, আমার গন্ধ কুকুরের বিষ্ঠার মতো না। নতুন-পুরনো কোনো বিষ্ঠার মতই না।“
দিদা বললেন, “এটা নিয়ে তর্ক করার কোনো সুযোগ নাই। এটা জীবনের একটা সত্যি মাত্র।“
আমি রেগে গেলাম। দিদা যা বলছিলেন, তার কোনো কিছুই আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না।
দিদা বলে চললেন, “অর্থাৎ, কোনো মহিলা যদি তোর পাশ ঘেঁষে নাক চেপে ধরে রাস্তা পার হয়, সেই মহিলা একজন ডাইনী হতেই পারে!“

আমি কথার মোড় ঘুরাতে চাইলাম। বললাম, “ ডাইনীদের মধ্যে আর কী কী দেখতে হবে, বলো।“
“চোখ। খুব সতর্ক হয়ে চোখ দেখতে হবে। সত্যিকারের ডাইনীদের চোখ তোর আর আমার চোখের চেয়ে আলাদা। আমাদের চোখের মণির মাঝখানটায় এমনিতে একটা কালো বিন্দু থাকে। কিন্তু ডাইনীদের এই কালো বিন্দুটা রঙ বদলাতে থাকে। সেই রঙীন বিন্দুর মধ্যে তুই দেখতে পাবি আগুন আর বরফের নাচ। তোর চামড়ার মধ্যে শিরশিরিয়ে উঠবে।“
দিদা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন আর তৃপ্তিভরে তার ঐ ফালতু কালো সিগারেটটা টানতে লাগলেন। আমি মেঝেতে উবু হয়ে ছিলাম। মুগ্ধ, বিস্মিত। দিদা হাসছিলেন না, মারাত্মক গম্ভীর দেখাচ্ছিল তাকে।

“আর কিছু আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
দিদা বললেন, “অবশ্যই আছে। ডাইনীরা যে ঠিক মহিলা না, এটা তাদের দেখেই বোঝা যাবে না। তারা দেখতে সাধারণ মহিলাদের মতই। মহিলাদের মতো কথা বলে। মহিলাদের মতো কর্মকান্ড দেখাতে জানে তারা। কিন্তু সত্যিকার ব্যাপারটা হলো, তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রাণি। মানুষের আদলে দানব তারা। সেজন্যেই তাদের নখওয়ালা থাবা আছে, টাকলু মাথা আছে, বিচ্ছিরি নাক আর উদ্ভট চোখ আছে। এই সবই দুনিয়ার আর সবার কাছ থেকে যতটা সম্ভব লুকিয়ে রাখতে হয় তাদের।“

“আর কী কী আলাদা ব্যাপার আছে তাদের, দিদা?”
“পা। ডাইনীদের কখনোই পায়ের গোড়ালি থাকে না।“
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, “গোড়ালি নাই! তাহলে কী আছে তাদের?”
“শুধুই পায়ের পাতা। চারকোণা পায়ের পাতা, আদৌ কোনো গোড়ালি নেই।“
“হাঁটতে কষ্ট হয় না তাদের?”
“আদৌ না। কিন্তু জুতা পরার বেলায় একটা সমস্যায় পড়ে যায় তারা। সব মেয়েই ছোট ধরনের সরু জুতা পরতে ভালোবাসে। কিন্তু এই ছিমছাম, সুঁচালো জুতাগুলোয় ডাইনীদের চ্যাপ্টা, চারকোণা পাগুলো আঁটিয়ে নিতে খবর হয়ে যায়।“
“চওড়া, আরামদায়ক চারকোণা জুতাগুলো পরে না কেন তারা?”
“ভয় পায়। যেভাবে পরচুলা দিয়ে টাকলু মাথাটা ঢেকে রাখে, ঠিক সেভাবেই বিচ্ছিরি পাগুলোকে সুন্দর সরু জুতায় ঢেকে রাখতে হয় তাদের।“
“ভয়ানক অসুবিধার না ব্যাপারটা?”
“অবশ্যই! কিন্তু তাদের পরে থাকতে হয়।“


“সাধাসিধে জুতা পরে থাকলে তো, এটাও তাদের চিনতে কাজে দেবে না। দেবে, দিদা?”
“আমার ভয় হয়, এটা কাজে দেবে না। তুই হয়ত একটা জিনিস দেখতে পাবি, অবশ্য যদি খুব কাছ থেকে দেখিস—কিছুটা লেংচে হাঁটে তারা।“
“এটাই কি তাহলে একমাত্র পার্থক্য?”
“আরেকটা আছে। আর একটা মাত্র।“
“কী সেটা, দিদা?”
“তাদের থুতু নীল রঙের।“
“নীল! নীল না! নীল হতেই পারে না থুতু।“ আমি চিৎকার করে উঠলাম।
দিদা বললেন, “বিলবেরীর মতো নীল।“
“তুমি ঠিক এটাই বুঝাচ্ছ না, দিদা। নীল থুতু কারোরই হতে পারে না।“
“ডাইনীদের হয়।“
“তাদের থুতু কি কালির মতো?”
“একদম! মাঝে মাঝে তারা তা দিয়ে লেখেও। নিবওয়ালা পুরনো ধাঁচের কলমগুলো ব্যবহার করে তারা। কলমের নিবটা শুধু চেটে দেয়।“
“তুমি কখনো তাদের থুতু খেয়াল করেছ, দিদা? যদি কোনো ডাইনী আমার সাথে কথা বলত, আমি কি সেটা খেয়াল করতে পারতাম?”
“খুব সতর্কভাবে দেখলে। খুব সতর্কভাবে দেখলে তুই হয়ত তার দাঁতে একটা নীলচে রঙ দেখতে পেতি। কিন্তু খুব বেশি তা দেখা যায় না।“
“থুতু ফেললে দেখতে পেতাম।“
দিদা বললেন, “ডাইনীরা কখনোই থুতু ফেলে না। সাহস হয় না তাদের।“

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, আমার দিদা আমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলছেন। সপ্তাহের প্রতিটা দিন সকালে তিনি গির্জায় যেতেন। প্রতি বেলা খাবারের আগে ঈশ্বরের দয়া চাইতেন। এমন একজন মানুষ কখনো মিথ্যে বলতে পারে না। আমি দিদার প্রতিটা কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম।

দিদা বললেন, “এই তো, এ সম্পর্কে তোকে এটুকুই বলতে পারি আমি। এগুলোর কোনোটাই খুব একটা কাজের না। এখনো তুই একজন মহিলার দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে বলে দিতে পারবি না সে ডাইনী কিনা। কিন্তু যদি সে দস্তানা পরে থাকে, যদি নাকের ছিদ্রটা তার বড় হয়, চোখ দুটো যদি হয় উদ্ভট, চুল দেখে যদি মনে হয় সেটা আলগা, আর দাঁতে তার থাকে যদি নীলচে আভা; এই সবকিছু যদি তার থাকে, তাহলে তোকে পাগলের মতো দৌড়াতে হবে।“
“দিদা, ছোট্ট বেলায় তোমার কি কোনো ডাইনীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”
“একবার। শুধু একবার।“
“কী হয়েছিল?”
“আমি সেটা বলছি না তোকে। ভয় পেতে পারিস। দুঃস্বপ্ন দেখতে পারিস।“
আমি অনুনয় করলাম, “প্লিজ দিদা, বলো না আমাকে।“
“নাহ। এসব কথা এত ভয়ঙ্কর যে, বলা যায় না।“
“তোমার হারিয়ে যাওয়া বুড়ো আঙুলের সঙ্গে কি তার সম্পর্ক আছে, দিদা?”

আচমকা দিদার কোঁচকানো ঠোঁট দুটো একজোড়া সাঁড়াশির মতো শক্ত হয়ে এঁটে গেল। আর হাতে ধরা সিগারেটটা (যেটার ওপর কোনো বুড়ো আঙুল ছিল না) তিরতির করে কাঁপতে শুরু করল।

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন না। কথা বললেন না। একেবারে হঠাৎ করেই তিনি পুরোপুরি চুপ হয়ে গেলেন। আমাদের কথা শেষ হয়ে গেল।
“গুড নাইট, দিদা”, আমি বললাম।
তিনি নড়লেন না। আমি ধীরে ধীরে রুম থেকে বের হয়ে এলাম এবং সোজা আমার বিছানায় চলে গেলাম।
*****************************
ডাইনী সর্দারনী

পরদিন কালো স্যুট পরা এক লোক এলেন বাড়িতে একটা ব্রিফ-কেইস হাতে করে। দিদার সঙ্গে বসার ঘরে তাঁর দীর্ঘক্ষণ আলাপ হলো। লোকটা থাকার সময় আমার সেখানে যাওয়া বারণ ছিল। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর........

[কালো স্যুট পরা লোক চলে যাবার পর কী হলো, সেটা জানতে হলে বইটা পড়তে হবে। বইটা এ বছরের যে কোনো সময় প্রকাশিত হবে, এমন আশা করছি।]

উপন্যাসের নাম- ডাইনী, মূল- রোয়াল ডাল, অনুবাদ- আমি :D

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:৪৭
১৬টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×