-কিরে,অমন প্যাচা মুখ করে বসে আছিস ক্যান?? কি হইছে??
উফ!এতক্ষন বইসা ছিলাম শান্তিতে।এখন এর জ্বালায়তো চুপ কইরা থাকার উপায় নাই।নিজেও বক বক করবে,আমাকেও করতে হবে।
আমি খুব গম্ভীর স্বরে বললাম,
-এখন জালাইছ না তো অথৈ,প্লীজ।আমি প্যাচাল পাড়ার মুডে নাই।তুই ক্লাশে যা।
-এহ! আমারে তাড়ায় দেয়! প্যাচাল পাড়ার মুডে নাই উনি!এহ! অই,তোর কথায় কি আমি উঠি।না বসি। আমি ক্লাশ করুম না আজকে।কি করবি তুই?হ্যা?কি করবি?মুখটাও করছে প্যাচার মতন,কথাও বেরোইতেছে প্যচার মতন।
-উফফ,তুই থামনা বাপ।ক্লাশে না গেলে না গেলি।তর যা মনে চায় কর গিয়ে।আমারে একটু একা থাকতে দে.................প্লীইইজ।
-না,আগে বল কি হইছে।
এই হইল আরেক যন্ত্রনা।একবার যদি জেদ ধরছে,তো না শুইনা ছাড়বে না।আমিও আজ নাছোড়বান্দা।কমুনা তরে।দেখি এইবার কে জিতে!
-পড়ে বলবনে তোকে।আমাকে একটু একা থাকতে দে না অথৈ।আমি নিজেই তোকে বলব।প্রমিজ।
মনে হয় কাজ হইছে।সে অতি ভাবুক একটা চেহারা করে বলল,
-ঠিক আছে।তুই ভাব।আমি বসে রইলাম।ভাবনা শেষ হইলে....
-আররে!তুই এইখানে বইসা থাকবি,আর আমি বইসা বইসা ভাবব? ভাবনা করার ও তো একটা নিয়ম আছে,নাকি?তুই যাছনা!আমি আসতেছি। যা,বটতলায় যাইয়া বসগে।
-আচ্ছা।ঠিক আছে।তবে ১৫মিনিটের বেশী না কিন্তু?!
-১৫ মিনিট?!!
-ক্যান?বেশী হইয়া গেল?
-না না ঠিক আছে।ঠিক আছে।১৫মিনিট। আইচ্ছা আম্মা তুই যা....
-অই,তুই আমারে আম্মা কইলি ক্যান? আমারে কি আম্মা আম্মা লাগে?!!হ্যা?
-ওরে,নাআআ......তোরে রূপবতী অপ্সরা লাগে। যান অপ্সরা জী।
-আইচ্ছা। (একখানা হাসি সহকারে)
উফ।বাচা গেল। আমি যে কি নিয়ে টেনশনে ছিলাম,তাই ভুইলা গেছি,এই মাইয়ার যন্ত্রনায়
সমস্যা যে কোন টাইপের ভয়াবহ এখনো বুঝতেছিনা।আমার টাকা দরকার।বিশাল পরিমানে দরকার।আমাদের বাড়িটা বন্ধক রেখে ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবার চিকিৎসা করানো হয়েছিল।আল্লাহর রহমতে বাবা সুস্থ হয়ে উঠছেন আস্তে আস্তে।কিন্তু বাড়ি বন্ধক দেয়া হয়েছিল যার কাছে তিনি তো আর মানতে রাজি না।দুই বছরের সময় দিয়েছিল।তা পার হতে চলেছে প্রায়।আমাদের দুইতলা ছিমছাম বাড়িটার দিকে যখনই তাকাই ভয়ে বুক কেপে উঠে।এইটা অন্যের হাতে তুলে দিব?! কত সখ করে বাবা এই বাড়িটা করেছিলেন,তার পেনশনের সমস্ত টাকা দিয়ে।বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা লন ও আছে সবুজ ঘাসে মোড়া।অইখানটার ছোট্ট টেবিল্টায় বসে প্রায় বিকেলেই আমরা তিন ভাই আর বাবা মা চা খেতাম হই হুল্লোড় করে।আজ সবই স্তব্ধ হওয়ার পথে।বাবা নড়াচড়া করতে পারেন না খুব একটা। ভাইয়ার ব্যাংক এর চাকরীটার ভরসায় আমরা বেচে আছি এখনো।তার পক্ষে আর কতটাই বা সম্ভব?এই সংসার চালাতেই তাকে হিমিশিম খেতে হয়।তাও সে কিছু টাকা জোগাড় করেছে।আর ছোট ভাইটা তো এখনো স্কুলের গন্ডি ই পেরোয়নি। মাঝখানে বাকি আছি আমি। প্রত্যেক্টা রাত্রে মায়ের চুপচাপ কান্নার ফোপানি শুনলে ইচ্ছে করে তক্ষনি যেয়ে ছিনতাই করে ১০লাখ টাকা এনে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে এই থাকার জায়গা টাকে আবার আমাদের বানিয়ে নেই।
অনার্স শেষ করতে আরও এক বছর বাকি।কোথায় পাবো আমি এত্তগুলা টাকা!!কিভাবে জোগার হবে এই টাকা??! কিচ্ছু ভাল্লাগেনা আমার।কিচ্ছুনা।এই অসহ্য যন্ত্রনার চেয়ে মরে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হইত! ...কিভাবে মুক্তি পাবো.....
-হইছে তোর?
চিন্তার জগত থেকে চমকে ফিরে আসলাম।
-কিরে রুদ্র?কি হইছে তোর??!! তোর চেহারা এমন মরা মানুষের মতন হয়ে আছে ক্যান???!!! কি হইছে???শিগগির বল??
-মরা মানুষ,না? সত্যি সত্যি যদি মরা মানুষ হয়ে যেতে পারতাম,তাইলে কি ভালো হইত নারে?
-কি বলতেছিস এইসব? এই?তোর কি হইছে?
-মরে গেলে দুঃখ কষ্ট কচ্ছু ছুতে পারতনা.........
-রুদ্র!চুপ কর?কি বইলা যাইতেছিস এইসব? আর একটা কথা বলবিনা।আমার দিকে তাকা....
নিস্প্রান পুতুলের মতন তাকালাম ওর দিকে। আমার ক্লাশের ৫টা ফ্রেন্ড এর মধ্যে এই মেয়েটা ক্যান জানি সারাক্ষন আমার পেছনে লেগে থাকে। আমাকে জালাইতে এর যে কি ভালো লাগে,আমি এখনো বুঝতে পারিনাই।আমি যতই বিরক্ত হই,সে যেন তত উৎসাহ নিয়ে আমার উপর অধিকার খাটাতে শুরু করে।এখন আমিও আর কিছু বলিনা।করুক যা মন চায়।খালি বকবকানি সহ্য করতে হয় একটু,এই যা।তার সবচেয়ে প্রিয় কাজের একটা হইল দুই দিন পর পর আমাকে অবাক করে দিয়ে কিছু একটা করা। তার ভাষায়, সারপ্রাইজড হলে আমার চেহারাটা নাকি সবচেয়ে মায়াময় হয়ে যায় যা দেখার জন্যেই তার এই প্রচেষ্টা। আমি অবাক হই এই কথা শুনে।কেন?সে কি এর বিনিময়ে আর কিছু চায় আমার কাছে?মাঝে মাঝে ভাবলে আমার নিজেকেও খুব দুর্বল লাগে ওর প্রতি।আমি ই বা কেন এইসব মেনে নিচ্ছি,এরো কোন উত্তর পাইনা।তবে উত্তর টা ডায়রীর পাতায় একদিন বের হয়ে গিয়েছিল।আসলেই কি তাই!
-হুম,এইবার বল কি হইছে? কি সমস্যা শুধু সেইটা বলবি। বাসায় কোন সমস্যা? আঙ্কেলের শরীর ভালো আছে?
-আমি আর থাকতে পারতেছিনারে.......
চোখ থেকে পানি বেরিয়ে আসল আমার।একে একে ওকে সমস্ত ঘটনাই বললাম।
-আমি আসলেই আর পারতেছিনা রে দোস্ত।কারো কাছ থেকে যে টাকা এনে বাড়ি টা বাচাবো,তাও সম্ভব না।বাবার চিকিতসার সময় আত্মীয় স্বজন সবাই নানান ভাবে সাহাজ্য করছে।এখন আবার?! দোস্ত রে,আমার বাবা কখনই কারো কাছ থেকে টাকা ধার করে কিছু করে নাই।আর যদি সে শুনে তার বাড়ি বাচাতে টাকা ধার নেয়া হবে,তাইলে সে বেচে থেকেও মরে যেবে।আব্বু বলে দিছে,বাসা ভাড়া নেয়ার ব্যাবস্থা করতে।
-হুম।
-এজন্যেই মরে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হইত।
-রুদ্র?আবার?বলছিনা এই কথা টা আর একবার ও বলবিনা! এত তাড়াতাড়ি আল্লাহর উপর থেকে ভরসা হারায় ফেলিস না।
-ভরসা? কিভাবে আল্লাহ রক্ষা করবে,বল দেখি? ১০লাখ টাকা নিয়া কে বইসা রইছে,কোন জায়গায়?
-কোন না কোন উপায় হবেই।এইভাবে ভেঙ্গে পরিস না।
.................
বাসার কলিং বেল বেজে উঠল।আমি ছাড়া ঘরে কেউ নেই,বাবা কে নিয়ে মা আর ভাইটা গেছে ডাক্তারের কাছে।উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। খুলেই ঝারি খেলাম.......
-কি আশ্চর্য! এতক্ষন লাগে খুলতে!ঢুকতে দিবিনা,নাকি??!! সর
আমাকে অবাক করে দিয়ে অথৈ আমার বাসায়!
-তুই?! এই সময়ে? এতদিন গায়েব! আজকে আমার বাসায়?! এইখানে কি?
-আগে দরজাটা লাগা।ভেতরে বসি।পরে বলছি সব। বলতেই তো আসছি
-বাসায় কেউ নাই!
-তাতে কি?!! আমার তোকেই দরকার। আমি জানি বাসায় কেউ নাই।মুরাদ বলছে।
-আচ্ছা আয়,ড্রইং রুমে আয়।বস।আমি চা বানায় আনি?
-নাআ।চা আমি পরেও বানায় খাইতে পারব।তুই এইখানে বস আগে।
-বল,কি বুঝে তুই আমার বাসা পর্যন্ত চলে আসলি,আমাকে না বলে! ঠিকানা পাইলি কই! ওই বান্দর মুরাদ টা দিছে,না?ও আমার বন্ধু হইয়া আমাকে কেন বলল না?!!
-আমি মানা করছি।উফ! এই টপিক বাদ।এইটা ধর
-কি?
-হাতে নে।
একটা চেকের পাতা আমার সামনে বাড়ানো।নামের জায়গায় দেখলাম আমার নামটা লেখা।টাকার অঙ্ক ১১লাখ।
-এইটা আমাকে কেন!
-আমার টাকা।আমি তোকে দিচ্ছি।তাই।
-তুই কি বলতেছিস আবোল তাবোল! তোর টাকা আমি নেব কীভাবে! সবসময় এইসব ছেলেমানুষী করবিনাতো!
-রুদ্র!আমি সিরিয়াসলি বলছি।এই কয়দিনে আমি ১টা জিনিস চিন্তা করেছি।আমি কোনটা নিয়ে সারাজীবন সুখে কাটাতে পারব সেইটা বের করেছি।
-সুখ! কি বলতেছিস,আবোল তাবোল? এত্ত টাকা তুই পেলি কই?!
-এগুলা বাবা ডিপোসিট করেছিল আমার নামে।আমার বিয়েতে আমাকে গয়না বানিয়ে দেয়ার জন্যে।বাবা মারা যাওয়ার আগে আমার একাউন্টে দিয়ে বলেছিল,আমার একমাত্র মেয়েকে যেন গয়না দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়!সবাই যেন হিংসা করে।এটা ছিল বাবার শেষ ইচ্ছা।আমার পূরন করা ফরয।
-!
-রুদ্র......তুই কি পারবি না আমার গয়না হতে।আমাকে তোর ভালবাসা দিয়ে ঢেকে রাখতে?এমন ভালবাসা যা দেখে সবাই হিংসায় মরবে?পারবিনা তুই?বল?
-এমন করে কি বলে যাচ্ছিস পাগলের মতন?!এসব হয় না,অথৈ। আমি?! কোথেকে!কীভাবে!
-কেন?তবে কি তোর ডায়রীর লেখা টা ভুল ছিল?
মনে পড়ল, গত বছর আমি নিজে হাতেই লিখেছিলাম, "....আমার এই এলোমেলো জীবনটা গোছাতে একটা মেয়ের আলিঙ্গন যদি খুবই প্রয়োজন পরে তবে আমি অথৈ পাগলীটাকেই ছিনিয়ে নেব।"
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




