'তোরা কিছু বলছিস না কেন?' আপা আর চুপ থাকতে পারলেন না।
'কি বলবো?'
'কি বলবো মানে?' আপা
'ওহ আপা, একটা শব্দ মাথায় ঘুরফাক খাচ্ছে। কিছুতেই এর একটা রফা করতে পারছি না'
'কোন শব্দ?' মনে হলো তিনি একটা কাজ পেয়ে গেছেন এমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।
'তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না, না শুনলেও তোমার চলবে' আমি না তাকিয়েই তার সাথে কথা বলছি। মিজানের অতশত দিকে খেয়ালও নেই। সে গিলছে সমানে।
'তারপরও আমাকে বল, আমি শুনবো'
'তেমন কিছু না। মতিঝিলে একটা বাসের নাম দেখলাম- 'ছালছাবিল' বলো এটা কোন নাম হলো?'
'তা ঠিক, আজকাল মানুষের নামের ঠিক নাই বাসের ঠিক থাকবে কেমনে? ঢাকায় আমার এক আত্মীয়ের ছেলের নাম রাখছে-হিকিক'
'হিকিক? এটা আবার কেমন নাম?'
'তা কে জানে বাপু?'
'যাত্রাবাড়িতে আরও একটা বাসের নাম দেখলাম- বেকার'
'হবে হয়তো কোন বেকারের বাস ঐটা। তা তুই সব ফেলে বাসের নামের দিকে নজর দিলি কেন?' আপা চোখে মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছেন।
'তা আর সাধে দেই? তারপর আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছো- আগে মানুষ বাসের বলো আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম বলো- 'মায়ের দোয়া' টাইপ নাম দিত। এখন দিচ্ছে 'পীরের দোয়া'। গুলিস্থানের আর মিরপুরের বাসগুলোয় দেখবে বড়বড় হরফে লেখা- অমুক পীরের দোয়া; তমুক আউলিয়ার দোয়া... এসব ভন্ড পীরের জন্য মায়ের নাম নিশানা পর্যন্ত হারিয়ে যাবার যোগাড়!'
'কিসব বলছিস? পীর আউলিয়ারা ভন্ড হবেন কেন?'
'হয় হয়, বুঝবা না। ওদের জন্য পোলাপাইন এখন মায়ের অনুমতির ধার ধারে না, পীরের কাছে সোজা গিয়ে হাজির হয়। সেদিন একজন একটা টেঙ্কি্যাব কিনবে বলে পীরের খোঁজে মরিয়া। পীরকে জিজ্ঞেস করবে, কোন কালারের ট্যাঙ্ িকিনলে সে লাভবান হবে...'
'দিন দিন মানুষ আল্লাহ ভক্ত হয়ে যাচ্ছে দেখছি'
'আল্লা ভক্ত না ছাই। ঐ ব্যাটা পীরের কাছ থেকে লোন নেয়ারও চিন্তা ভাবনা করছিল'
'কি বলিস? পীরের টাকা পয়সা আছে নাকি?'
'আপা, তুমি এখনো পুরনোই রয়ে গেছ। এখনকার পীরদের কোটি কোটি টাকা। তারা ঐ টাকা দিয়ে ভক্ত তৈরী করে। আবার ভক্তদেরই কাছ থেকে ঐ টাকা আদায়ও করে নেয়। এটা একটা বিরাট ব্যবসা বলতে পারো'
'ছিঃ ছিঃ এসবও হচ্ছে আজকাল?' আপাকে মুমূর্ষ মনে হচ্ছে। আপার এই চেহারা পাল্টাতে হবে।
'আপা দারুন রান্না হয়েছে। তোমার হাতের রান্না মানেই অমৃত' আমি চোখ মুখ বন্ধ করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলে উঠি। 'ঠিক, কাঁচা মরিচের ভর্তাটা দারুন লাগছে' মিজান কথাগুলো বললো ঠিকই কিন্তু মনে হয়না সে মুখটাকে বন্ধ করেছিল। আপা'র চেহারায় ফুটে উঠেছে একটা তৃপ্তিময় হাসি।
রাত বাজে পৌনে তিনটা। এখানে পুকুর পাড়ে বসার দারুন ব্যবস্থা করা আছে। মিজান ফোন করতে ব্যস্ত। এখন অফ-পিক আওয়ার। মিনিটে কাটছে 50 পয়সা। ওর কথোপকথনের কিছু শব্দ ভেসে আসছে। 'জান জানো! তোমাকে খুব মিস করছি...'। বিরক্তি লাগে এসব শুনতে। বিশেষ করে এই 'জান' শব্দটা। কি এমন শব্দ..., অথচ সারাদেশময় ছড়িয়ে গেছে। মোবাইলটা যতটা না কাজের এসব ব্যপার লক্ষ্য করলে মনে হয় সবটাই এর অকাজের। এখন তিন নাম্বারটার সাথে কথা বলছে ও। যাক, সব জাহান্নামে যাক। মৃদু বাতাস বইছে। হালকা নরম সুরে। কোথায় থেকে তীব্র ঘ্রানের ফুলের সুভাস ভেসে আসছে। নেশা ধরিয়ে দেয় এমন সুভাস। মাথার উপর কয়েকটা পাখি ঝটফট শব্দ করে ডানা ঝাপটে উড়ে চলে গেলো অজানা গন্তব্যে। সামনে রহস্যময় পুকুরের জল। মাঝে মাঝে মনে হয় এর ঢেউ দেখছি, মাঝে মাঝে বিভ্রম মনে হয়। মনে হয় কিছুই দেখছি না। সারাদিনের কথা মনে পড়ে যায় হঠাৎ। মনে পড়লো কেন এসেছি, মনে পড়লো কাল কোথায় যাব... এখন আমি সম্পূর্ণ ফ্রিম্যান। সময় আছে অফূরন্ত, তবু সবটা নিজের নয়। মেঘনা ব্রীজটায় যখন বাস উঠলো তখন রাতের অন্ধকারে আমি ভয়ানক চমকে গেছিলাম। ভেতরটা হঠাৎ অজানা শিহরনে মুচড়ে উঠেছিল। মানব জীবনের গভীরতর চিন্তা যেন আমাকে ঝাপটে ধরেছিল তখন। বাস যতই এগুচ্ছে ততই এর চাপ আমি প্রচন্ডভাবে অনুভব করছিলাম। আমার অকারনে খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। পারিনি। এ মিনিট কয়েক সময়ে নদীর ধুধু জলে আমি কল্পনায় কত কিছু দেখলাম... একটা হলুদ শস্যক্ষেত, স্পষ্ট মনে আছে- হলুদ ভেঙ্গে এক উচ্ছ্বল তরুনীর দৌড়ে যাচ্ছে... মাঝে মাঝে চেহারায় বন্য দুষ্টুমী এনে গভীর মায়ায় ফিরে ফিরে দেখছে... তার পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছে আমার মত দেখতে একটা ছেলে, অবিকল আমি..., এবং মনে পড়ছে দীঘির মুক্তদানার মত জলে সাঁতার কেটে তীরে উঠার ঘটনা। তীরে সবুজের সাথে মিশে বসে ছিল সে, মুখে হাত দিয়ে খুব বিষন্নতা নিয়ে কিযেন ভাবছিল; তার বিষন্নতা আজও আমাকে জড়িয়ে রয়েছে; রইবে।
জীবনটাকে বুঝেই উঠতে পারলাম না। মাঝে মাঝে থই হারিয়ে ফেলি। মনে হয় আমি তলিয়ে যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি অবিরাম... কোথায় জানিনা। যেটুকু মনে পড়ে সেটুকু হচ্ছে- সবুজের ভেতর একজন বিষন্ন দৃষ্টিতে অনিমেষ চেয়ে আছে অথবা, গভীর হলুদে তার হারিয়ে যাওয়া। এ হারিয়ে যাওয়াটায়ও বিষন্নতা আছে। বিষন্নতা, বিষন্নতা এবং বিষন্নতা। বিষন্নতার ভারে আমি দ্রুত তলিয়ে যেতে থাকি... দ্রুত... দ্রুত... 'অ্যাই কি ভাবিস এত?' ভিষন চমকে উঠি। শরীরটা অকারনে শিরশির করে ওঠে। পেছন ফিরে দেখি- মিজান দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে সামলে বলি- 'না তেমন কিছু না; কাল সকালেই ফিরতে হবে'।
'কালকেই যাবি?'
'কিছুই করার নাই। সুমন ফোন করেছে- ব্যাংক থেকে টাকাটা তুলে আন্টিকে কালই পৌছে দিতে হবে'
'ঝামেলা' মিজান অসন্তুষ্ট হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।
'এত ফোন করে কি পাস?' আমি মৃদু স্বরে বলি।
'কিছুনা' তার সোজাচ্যাপ্টা জবাব। এটা স্পর্শকাতর বিষয়, মানুষের ইগোতে সরাসরি আঘাত লাগে। আমি আর এগুলাম না। ঘুমানোর চেষ্টায় চোখ বুজে পড়ে রইলাম।
অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। সেকেন্ড কয়েক পর বুঝতে পারলাম কোথায় এসে থেমেছি। বাড়ির সবখানেই গাছগাছালি। বাগানের মাঝখানে একটা মাচার মত করে বসার জায়গা। এখানকার সবকিছুতে দারুন যত্ন আর ভালোবাসার ছাপ স্পষ্ট। আপা একটা সাদা মাশরুম নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আমাকে দেখে উঠে এলেন। তারপর ঘুরে ঘুরে সব দেখাতে লাগলেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে বললেন-
'তোর কি অবস্থারে?'
'ভালোই'
'পড়াশুনা কেমন হচ্ছে'
'এই চলছে কোনমতে'
একটা বেজি দেখে তিনি চিৎকার করে উঠলেন। যা, যা, যা বলে তিনি তেড়ে গেলেন। বেজি ততক্ষনে জঙ্গলে উধাও। ফিরে এসে বললেন- 'এক রাতে পনেরোটা কবতুর বেজি ধরে খেয়েছে। এরপর এক মাসেরও বেশি সময় কবুতরগুলো আর তাদের ঘরে ঢুকে নাই। বাড়ির চালায় ছিল।'
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের সামনে এসে গেছি। মিজান পুকুরের নৌকাটা নিয়ে ঝামেলায় আছে। নৌকা নিয়ে কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছে এখন সেটা আর এগুচ্ছে না, ঘুরছে। যতই ও বৈঠা মারে ততই এটা ঘুরে। আপা মজা পাচ্ছেন। মিজান হাল ছেড়ে দিয়েছে। শেষমেষ পানিতে লাফ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠলো। 'এ জিনিস মানুষ চালায় নাকি?' মুখ ভ্যাংচে ও কথাগুলো বলে।
'মানুষই চালায়, তুই পারিস না সেটা বল'
ও আবার পুকুরে লাফ দিলো।
'বেশিক্ষন থাকিস না, দুপুরে খিদা লাগছে বললে সবাই ছ্যা ছ্যা করবে। আপা যাই বলো- বুড়ো হয়ে গেলে আমি এমন একটা বাড়ি করবোই করবো'
'করিস'
'ভাইয়ের খবর কি?'
'2012 সালের আগে আসবে না বলে হুলিয়া জারি করেছে। বলছে- আর্সেনিকের উপর পি.এইচ'ডি নিয়ে তারপর আসবে। আমি অতশত বুঝিনা, বলেছি এ বছরেই যেন চলে আসে'
'আমারতো মনে হয়না আসবে সে'
'ওর বাপ আসবে'
আমি শব্দ করে হেসে উঠি।
ব্যাগ গুছিয়ে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। মিজান গজরাতে গজরাতে হাঁটছে। আপা কিছুদূর আমাদের এগিয়ে দিলেন। পেছন ফিরে আপাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি কদাচিৎ এটা করি। কেন করি তা জানিনা। হয়তো কষ্ট পেতে ভয় পাই বলে। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে হাঁটছি আমরা। গন্তব্য আপাতত পিচঢালা পথ। তারপর অগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। ঢাকাকে আমি কখনোই ভালোবাসতে পারিনি। এ সবসময় আমার জন্য অভিশপ্ত নগরী। বিষন্ন নগরী। পিচঢালা পথে উঠে এলাম। ঠিক তখন সূযর্্য লাল আভা দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। সবুজ গাছের ফাকফোকর দিয়ে কুসুম রঙটা চোখেমুখে লুকোচুরি খেলছে।
যতই তর্জনগর্জন করি-ই না কেন, প্রয়োজন মানুষকে কোথায় নিয়ে ফেলে সে নিজেও তা জানেনা। এই মরা শহরে মানুষকে আবারও ফিরে আসতে হয়। আসাটা জরুরী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা চরম সত্য। আমাদের দেশটা শহর কেন্দ্রিক উন্নয়নের জোয়ারে ভাসমান। সবাই উন্নয়নের স্রোতটা কেবল শহরে ড্রাইভার্ট করতে ব্যস্ত। এটা তারা কেন করে তা জানিনা। হয়তো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ গ্রামের সহজ সরল পরিবেশে পৌছাতে ব্যর্থ বলে! কাজের কাজ কিছুই হয়না। সাইফুর রহমান'রা কেবল বাঁশ নিয়ে লম্বা লাফ দেয়ার স্বপ্ন নিয়ে ব্যস্ত। তারা শহরটাকে ঝকঝক তকতকে করে দেশকে স্বনির্ভরময় হিসাবে দাঁড় করার ঠুনকো বানোয়াট পোষাকি কাজে ব্যস্ত। দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রকল্পে আমার মনে হয়না তারা গ্রামের মানুষজনের কথা বিবেচনায় আনে। তারা শহুরে মানুষগুলো নিয়েই সদা ব্যস্ত। এটা যতদিন বাংলাদেশের রাজনীতির অংশ হিসাবে থাকবে, ততদিন আমার মনে হয়না আমরা খুব একটা এগুতে পারবো।
বাসটা ছুটে চলেছে, ছুটে চলেছে আমার সমস্ত বন্য ধ্যন-ধারনা। মনে হয় যেন অনন্তকাল ধরে সেসব নিয়ে ছুটছি আমি। কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই, কোন ঘর নেই, ঘরের কোনে মনের মানুষ নেই... হা হা হা হা মনের মানুষ! খারাপ বলিনিতো। সত্যিই মনের কথা বলার মত 'মনের মানুষ' পাইনি। পাব না, কেউ-ই পায়নি, পাবেও না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০০৬ রাত ৩:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



