মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মাদ আলী
জন্ম: ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪২ সন। মৃত্যু: ৩ জুন, ২০১৬।(৭৪)
মুহাম্মদ আলী পূর্বনাম ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র ইংরেজি Cassius Marcellus Clay, Jr একজন মার্কিন পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, খেলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড তাকে শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় ও বিবিসি তাকে শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত করেছে। মুহাম্মদ আলী জানুয়ারি ১৭, ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ক্লে সিনিয়র একজন রং মিস্ত্রি ছিলেন তিনি সাইনবোর্ড এবং বিলবোর্ড রঙ করতেন, সিনিয়র ক্লে প্রাক-গৃহযুদ্ধের দক্ষিণাংশের একজন আফ্রিকান আমেরিকান ক্রীতদাসের বংশধর ছিলেন। এবং মুহাম্মদ আলীর মা ওডিসা গ্র্যাডি ক্লে একজন সাধারণ গৃহিনী ছিলেন।
ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে (মুহাম্মদ আলী) মাত্র ১২ বছর বয়সে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ২২ বছর বয়সে তিনি সনি লিস্টনকে পরাজিত করে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেন। এর কয়েকদিন পরে, তিনি নেশন অব ইসলামে যোগদান করে তার নাম পরিবর্তন করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুন্নি ইসলামে ধর্মান্তরিত হন এবং ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র নাম পরিবর্তন করে মুহাম্মদ আলী নাম গ্রহণ করেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি: ১৯৬৪ সালে তিনি সৈনিক জীবনে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হোন পরীক্ষায় অনুত্তীর্ন হওয়ার কারণে। ১৯৬৬ সালে তিনি উত্তীর্ণ হোন এবং তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে কোরআন যুদ্ধ সমর্থন করে না। আল্লাহ বা নবীর নির্দেশ ছাড়া তিনি যুদ্ধে যাবেন না। কোন ভিয়েতকং এর সাথে তার বিরোধ নেই, তারা কেউ তাকে কালো বলে গালিও দেয়নি। তিনি ক্যাসিয়াস ক্লে বলে পরিচিত হতে চাননি, এ কারণে তিনি ১৯৬৬ সালে আমেরিকায় লড়াই এ অংশ নিতে পারেননি। ১৯৬৫ সালে লিস্টন এর সাথে ফিরতি ম্যাচের পর ১৯৬৭ সালে যোরা ফলির সাথে ম্যাচের মধ্যে তিনি ৯ বার শিরোপা রক্ষার লড়াইয়ে নামেন। খুব কম বক্সারই এতো কম সময়ে এতো বেশি বার লড়াই করেন। তার জীবনের একটি অন্যতঅম কঠিন লড়াইএ তিনি ১২ রাউন্ডে জয় লাভ করেন। আলি ১৯৬৬ সালে আমিরিকায় ফিরে এসে ক্লিভলান্ড উইলিয়ামস এর সাথে লড়াই করেন। এটি তার সেরা ম্যাচগুলোর একটি যেটিতে তিনি ৩ রাউন্ডে জিতেন। ১৯৬৭ সালে তিনি হিউস্টন এর একটি রিং এ এরনি তেরেল এর সাথে লড়াইয়ে নামেন। তেরেল তাকে ম্যাচ এর আগে ক্লে বলে অপমান করেন। আলি তাকে সঠিক শাস্তি দেয়ার মনস্থির করেন। ১৫ রাউণ্ডের এ লড়াইয়ে তিনি তাকে রক্তাক্ত করেন, অনেকে মনে করেন যে আলি ইচ্ছা করে লড়াই আগে শেষ করেননি। ১৯৬৭ সালে তিনি ৩ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হোন ভিয়েতনাম যুদ্ধে না যাওয়ার কারণে। ১৯৭০ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনি আবার লড়াইএ ফিরে আসতে সমর্থ হোন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে, আলী তার ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের বিরোধিতার কারণে মার্কিন সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান করতে অস্বীকৃত হোন। এর কয়েকদিন পরে তাকে এই কারণে দোষী সাব্যস্ত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বক্সিং উপাধি কেরে নেয়। তিনি তার জীবনের সেরা সময়ে পরবর্তী চার বছর কোন ধরনের বক্সিং প্রতিযোগিয়ায় নামতে পারেননি। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর আপীল সুপ্রিম কোর্টে পেশ হয়, যেখানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সরিয়ে নেওয়া হয়। যুদ্ধের বিরুদ্ধে আলীর বিবেকজনিত কার্যকলাপ তাকে সংস্কৃতি বিরোধী প্রজন্মের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র করে তোলে। বক্সিং জগতে ফিরে এসে আলী ১৯৭৪ ও ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে আবার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেন।
১৯৬০ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ক্লে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম অপেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় নামেন। তিনি ছয়বার কেন্টাকি গোল্ডেন গ্লাভস উপাধি, দুইবার জাতীয় গোল্ডেন গ্লাভস উপাধি, একবার অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ইউনিয়ন জাতীয় উপাধি এবং রোমে অনুষ্ঠিত ১৯৬০ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে বক্সিং প্রতিযোগিতায় লাইট হেভিওয়েট বিভাগে স্বর্ণপদক লাভ করেন। অপেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় ক্লে ১০০ বার জেতেন ও মাত্র পাঁচ বার পরাজিত হোন। মার্চ ১৯৭১ সালে জো ফ্রেজিয়ার খেলায় জয়লাভ করেন ও আলি প্রথমবারের মত পরাজিত হোন। ১৯৭৪ সালের ফিরতি লড়াইয়ে আলি জো ফ্রেজিয়ারের সাথে ২য় বারের মতো মুখোমুখি হোন যা 'শতাব্দীর সেরা লড়াই' হিসাবে পরিচিত। বহুল আলোচিত এ লড়াইটি ছিলো দুই মহাবীরের লড়াই যা সকলকে শিহরিত করে। এবং মুহাম্মদ আলী জো ফ্রেজিয়ারকে রক্তাত্ব পরাজিত করে শিরোপা পুণরুদ্ধার করেন। মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী তার জীবদ্দশায় ৬১ বার বক্সিং প্রতিযোগিতায় ৫৬ বার বিজয়ী হোন এবং ৫ বার অসুস্থতার কারণে পরাজিত হোন।
মুহাম্মদ আলীর বাংলাদেশ সফর: জানা যায় মুষ্টিযোদ্ধা মেজর জিয়াউর রহমান ও মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী কলম বন্ধু ছিলেন। আর এই সুবাধে লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) এর দাওয়াতে ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সহযোগি হয়ে ৫ দিনের সফরে বাংলাদেশ বিমানে করে তিনি স্বপরিবারে ঢাকায় এসেছিলেন। সে সময় তার সফর সঙ্গী ছিলেন তার মাতাপিতা, দ্বিতীয় স্ত্রী ভেরোনিকা পরশে, মেয়ে লায়লা আলী ও ভাই। কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলীর সঙ্গে বাংলাদেশের হয়ে মুষ্টিযোদ্ধা আবদুল হালিম একই রিংয়ে নেমেছিলেন। তবে সেদিন আবদুল হালিমকে নকআউট করেননি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মুহাম্মদ আলী। তিনি আরও ছোট কাউকে চেয়েছিলেন তার সাথে আনন্দ করার জন্য, তখন বাংলাদেশের জুনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ১২ বছর বয়সী গিয়াস উদ্দিন তার সাথে বক্সিং খেলার সুযোগ পান। মুহাম্মদ আলী উভয়ের কাছে পরাজিত হয়ে আব্দুল হালিম ও গিয়াস উদ্দিন সহ সমগ্র দর্শককে আনন্দ ও ভালোবাসায় সিক্ত করেন এবং উৎসাহিত করেন। মুহাম্মদ আলী বাংলাদেশ সফরকালে স্বপরিবারে ন্যাশনাল চিরিয়াখানা, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট, সিলেট ডানকান চা বাগান, সুন্দরবন ফরেষ্ট, রাঙামাটি ও পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ভ্রমণ করেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উপহার: গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) বন্ধু মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলীকে সম্মানসূচক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান সহ আন্তজার্তিক পাসপোর্ট প্রদান করেন এবং কক্সবাজারে ১,০০০ স্কয়ার মিটারের একটি পর্যটন প্লট উপহার প্রদান করেন। মুহাম্মদ আলী অত্যন্ত আনন্দের সাথে উক্ত প্লট গ্রহণ করেন এবং গর্বের সাথে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করেন যা প্রিয় মুহাম্মদ আলীর উপহার হিসেবে পর্যটন কর্পোরেশন কক্সবাজার সুইমিং পুল নির্মান হয়। পল্টনের বক্সিং স্টেডিয়ামকে তার নামে মুহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম নামকরণ করেন মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলীর বন্ধু মুষ্টিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান।
বন্ধু লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) এর সাথে বন্ধু মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলীর কথোপকথন:
● জিয়া: প্রিয় বন্ধু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার সামান্য উপহার। তুমি আজ থেকে বাংলাদেশের নাগরিক আর এটি তোমার বাংলাদেশ পাসপোর্ট।
● আলী: (আবেগে আপ্লুত হয়ে) তাহলে আজ থেকে আমি বাংলাদেশের নাগরিক?
● জিয়া: অত্যন্ত সম্মান ও গর্বের সাথে।
● আলী: আমি কি এটি সমগ্র বিশ্বে ব্যবহার করতে পারবো?
● জিয়া: (স্মিত হেসে) অবস্যই, নিসন্দেহে।
● আলী: আমেরিকা যদি আমার সাথে আর কখনো অন্যায় করে আমি জানবো আমি মনে রাখবো আমার বাংলাদেশে বাড়ি আছে এবং আমি বাংলাদেশের নাগরিক, আমি বাংলাদেশে ফিরে আসবো। আমার প্রিয় বন্ধু আমি তোমার কাছে ও বাংলাদেশের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ।
● জিয়া: বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ তোমাকে অনন্তকাল মনে রাখবে।
শেষ কথা: ১৯৮০ সালে তিনি পারকিন্সন্স রোগে (en:parkinson’s disease) আক্রান্ত হোন। তাকে যখন বলা হয় তিনি তার রোগের জন্য বক্সিংকে দায়ী করেন কিনা, তিনি বলেন বক্সিং না করলে তিনি এতো বিখ্যাত হতেন না। অবসরের পরে তিনি তার জীবনকে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ৩২ বছর পারকিনসন্স রোগে ভোগার পর ৩রা জুন, ২০১৬ তে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি। বলা হয়ে থাকে কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মুহাম্মদ আলী পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মুষ্টিযোদ্ধা তার মতো পরাক্রমশালী বীর মুষ্টিযোদ্ধা না কখনো হয়েছে আর না কখনো হবে। আজ ৩রা জুন ২০২০ মুহাম্মদ আলীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি পরুম করুনাময় আল্লাহপাক তাকে জান্নাতবাসী করুন।
উৎসর্গ: লেখাটি উৎসর্গ করছি আমাদের সকলের প্রিয় ব্যক্তিত্ব প্রিয় ব্লগার ও গুরুজন ● ব্লগার ডঃ এম এ আলী ভাইকে। ● ডঃ এম এ আলী ভাই আপনি ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন, আমাদের সাথে থাকুন।
সুত্র: বিবিসি নিউজ, উইকিপিডিয়া, ডেইলি ষ্টার।
ছবি: গুগল সার্চ ইঞ্জিন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সামহোয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৫৩