বাবা মা হয়তো আদর করে নাম রেখেছিলেন ফয়জুর রহমনার অথবা ফজলুর রহমান, এখন তাকে কেউ এ নামে চেনে না, ফজু মাঝি নামে পরিচিত এলাকায়। ফজুর বৃদ্ধ কুঁজো অন্ধ মা’ও তাকে ফজু বলেই ডাকেন গালাগালি করেন। ফজুর ঘরে দুইবেলা জাও ভাত রান্না হয়। ঘরে ক্ষুধার্ত সদস্য মাছ তরকারি বিহীন সাদা জাও ভাত গিলে বেঁচে আছে - বেশ ভালোভাবেই বেঁচে আছে। আজ দুদিন যাবত মুষলধারে বৃষ্টিতে ঘরের বাইরে কারো কাজ কারবার নেই তাই নৌকা পারাপারও নেই, ফজুর দুই মেয়ে এক ছেলে সহ ঘরে খানেওয়ালা ছয়জন। আগামীকাল কি রান্না হবে ফজু - ফজুর বউ মোমেনা জানেনা, ঘরে বাচ্চাদের কান্না আর শাশুরির বকা গালি খেয়ে মোমেনা নিরব থাকে, মোমেনা বোবা কালা না! - তারপরও সে আজন্ম নিরব থাকবে এই যেনো তার পণ।
জামাল উদ্দিন মাতবর এলাকার মেম্বার, তার বাড়িতে বড় মেয়ে পোয়াতি জোসনা বানু। আজ সারাদিন দুই দাই বেটির কসরতেও জোসনা বানুর সন্তানের কোনো কুল কিনারা করতে না পেরে হাল ছেড়ে মেম্বার সাবকে জানান দেয় তাদের পক্ষে সম্ভব না, সন্তান ও মাকে বাঁচাতে হলে সদরে নিতে হবে। মেম্বার সাব লোক না পাঠিয়ে নিজে দৌড়ে আসেন ফজু মাঝির বাড়িতে সাথে মেয়ে জামাই লঞ্চ ড্রাইভার আলাউদ্দিন মাতবর। মেম্বার সাব ধমক ছাড়া কথা বলতে পারেন না। আজ ফজু মাঝিকে অনুরোধ করেন “বাবা চল, দেড়ি করিস না, মেয়ে আমার বাঁচবে না” শশুরের সাথে মেয়ে জামাই আলাউদ্দিন কান্নাচোখে।
ফজু মাঝির বৃদ্ধ মা মেম্বার সাবকে আশ্বস্ত করেন - “বেটা আল্লার নাম ল, আল্লার নাম ল। মেম্বার সাব আল্লার নাম নেন - এছাড়া আর কি করার আছে?
মেঘনা নদীর মোহনায় নৌকাতে যাত্রী মেম্বার সাব, তার স্ত্রী মালকা বানু, প্রায় অজ্ঞান পোয়াতি মেয়ে জোসনা বানু, মেয়ে জামাই আলাউদ্দিন, দুই দাই বেটি সহ ফজু মাঝি। নৌকার দাড় বাইছেন ফজু মাঝি আর আলাউদ্দিন। হ হ শব্দে অন্ধকার রাত চিড়ে ফুলে ফেপে আসমান সমান উচু হয়ে আসা ঢেউ তারা চিনতে পারেন, পানির ঢেউ - মরণঘাত জলোচ্ছাস। মেম্বার সাবের পুরো পরিবার সহ এক রাতে ভেসে গেলো প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের প্রাণ। সময় মধ্যরাত, ১২ই নভেম্বর ১৯৭০।
আজ ভয়াল ১২ই নভেম্বর। ১৯৭০ সালের ভোলা ঘূর্ণিঝড় ছিলো একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় যা ১৯৭০ সালের ১১ - ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্নিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্নিঝড় এবং এটি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় পাঁচ লক্ষ (৫,০০,০০০) মানুষ প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় বদ্বীপের সমুদ্র সমতলের ভূমিতে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এটি ১৯৭০-এর উত্তর ভারতীয় ঘূর্ণিঝড় মৌসুমের ৬ষ্ঠ ঘূর্ণিঝড় এবং মৌসুমের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ছিলো। এটি সিম্পসন স্কেলে 'ক্যাটাগরি ৩' মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। খাদ্য, পানীয় পানি ও ঔষধের অভাবে আরও এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মানুষের হয় অকাল মৃত্যু।
ঘূর্ণিঝড়টি বঙ্গোপসাগরে ৮ই নভেম্বর সৃষ্ট হয় এবং ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ই নভেম্বর এটির গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৮৫ কিমি (১১৫ মাইল) এ পৌঁছায় এবং সে রাতেই তা উপকূলে আঘাত করে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। এতে ঐসব এলাকার বাড়ি-ঘর, গ্রাম ও শস্য স্রোতে তলিয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা ছিল তজুমদ্দিন উপজেলা। তজুমদ্দিন উপজেলাস্থ ১,৬৭,০০০ জন অধিবাসীর মধ্যে ৭৭,০০০ জনই (৪৬%) প্রাণ হারান।
সরকারের ভূমিকা: পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরও জরুরি ত্রাণকার্য পরিচালনায় গড়িমসি করেন। ঘূর্ণিঝড়ের পরও যারা বেঁচে ছিলো তারা মারা যায় খাবার ঔষধ আর পানীয় জলের অভাবে। ঘূর্ণিঝড়ের এক সপ্তাহ পরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বীকার করেন - সরকার দুর্যোগের ভয়াবহতা বুঝতে না পারার কারণেই ত্রাণকার্য সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
উপসংহার: বাংলার মানুষ আজন্ম মোমেনার মতো নিরব থাকার মানুষ, নিরব থেকেই এরা মারা যান, বাংলার মানুষের ভাগ্যে ঝড় জলোচ্ছাস দুঃখ কষ্ট নিয়েই জন্ম নিয়েছেন। ভাগ্য আর নিয়তির কাছেই বন্দি আজীবন।
ব্লগার জনাব আহমেদ জী এস এর তথ্য অনুসারে: আজ ১২ই নভেম্বর সেই ভয়ঙ্কর কালো দিনটি। নিরবে চলে যাচ্ছে। যেমন সেদিনও জলোচ্ছাস ও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার লাখো মানুষ নিরবে মারা গেলেও ৩/৪দিনের আগে সে খবর দেশের আর কোথাও পৌঁছেনি। এমনকি দশহাত দূরের বরিশাল শহরের মানুষজনও টের পায়নি শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দূর্যোগটি উপকূলে হানা দিয়ে গেছে ক'দিন আগে। দুঃসহ ছিলো সে মরন ছোবলের ছবি। কচুরিপানার মতো লাশ ভেসে আছে সাগরের কূলে কূলে। সন্তান সম্ভবা অসংখ্য মায়েদের লাশ মোচড়ানো অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো উপকূল জুড়ে। কারো কারো আঁচলে বাঁধা ছিলো কোলের সন্তান, আঁকড়ে ছিলো গাছের ডাল কিম্বা টিনের চাল। পানির তোড়ে যেন ভেসে যেতে না পারে তাই আঁচলে বেঁধে রাখা। তবুও শেষ রক্ষা করতে পারেনি ঐসব অসহায় মায়েরা। ভেসে গেছে গভীর সমুদ্রে। প্রকৃতির রুদ্র রোষ ছাড় দেয়নি কাউকে।
১৯৭০ এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসটি ছিলো সে সময় পর্য্যন্ত রেকর্ডকৃত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে ভয়ঙ্করতমটি। প্রশান্ত মহাসাগরে উদ্ভুত ঘূর্ণিঝড় “নোরা” দক্ষিন চীন সাগরে দুই দিন ঘোরাফেরা করে ৫ই নভেম্বর পশ্চিম দিকে মালয় পেনিনসূলায় এসে থেমে যায়। এর ফলে ৮ই ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরের মধ্যভাগে সৃষ্টি হয় একটি নিম্নচাপের। নিম্নচাপটি উত্তরের দিকে ধাবিত হলে এটা ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের নজরে আসে। ভারত পাকিস্তানের সম্পর্ক সে সময় ভালো না থাকায় এই খবরটি তারা আর পাকিস্তান কে দেয়নি। তখনকার দিনে তো আর ঐ সব নিম্নচাপ বা ঝড়ের নামকরন করা হতো না বড় একটা( যেমন “আইলা” নার্গিস” “নিনো” “ ক্যাটারিনা” ইত্যাদি ) তাই এই নিম্নচাপটিরও কোনও নাম ছিলোনা সেদিন। দুটো দিন নিম্নচাপটি শান্ত থাকে ঐ জায়গাতেই। ১১ নভেম্বর তা যখন আরো উত্তরপূবে অগ্রসর হতে থাকে তখন সে ধরে তার রুদ্র রূপ। বাতাসের গতিবেগ দাঁড়ায় ঘন্টায় ১১৫ মাইল থেকে ১৩৪ মাইলে। আরো উত্তরপূবে এগিয়ে এলে নিম্নচাপের ফলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টি আরো বেশী গতিবেগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে উপকূলীয় ভোলা, হাতিয়া , সন্দীপ এলাকায় ১২ই নভেম্বরের রাতে। ঘটনাটি ঘটে ভরা জোয়ারের সময়। এতে সাগর ফুঁসে ওঠে স্মরণকালের ভয়ঙ্কর জলোচ্ছাসের ঘটনাটি ঘটিয়ে ফেলে। জলোচ্ছাসের মাত্রা দাঁড়ায় ১৫/২০ ফুটে। স্থলভাগে আছড়ে পড়ায় এর গতিবেগ কমে যায় আর তা দূর্বল হয়ে ভারতের আগরতলায় আঘাত হানে।
তৎকালীন পাকিস্তান আবহাওয়া দপ্তর শুরু থেকেই সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়টিকে পাত্তা দেয়নি। কেবল মাত্র ১২ তারিখের দিনের বেলা একটি “ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহন” ঘোষনা প্রচার করে শুধু। এর বেশ পরে পাকিস্তান রেডিও থেকে প্রচার করা হয় মহাবিপদ সংকেতের কথা। আর এর মধ্যেই ঘটে যায় যা ঘটার। জলোচ্ছাসে ভেসে যায় সব। কেবলমাত্র পরের দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার দূর্গতস্থল ঘুরে এসে খবরটি জানায় সামরিক জান্তার কাছে। ঘটনাটি সামরিক সরকার তাদের নিজেদের মধ্যেই রাখে প্রশাসনকে জানায়নি। এতে দুদিন যাবৎ বিধ্বস্ত এলাকার তেমন কোনও খবরই পৌঁছেনি মানুষের কাছে। মানুষ বুঝতে পারেনি যে কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেছে তাদের ঘরের কাছেই।
এই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ থেকে ৫ লাখে। ১৩টি দ্বীপে একজনকেও জীবিত পাওয়া যায়নি। সম্পূর্ণ ভাবে বিধ্বস্ত হয় হাতিয়া, সন্দীপ, কুতুবদিয়া আর ভোলার দক্ষিনাঞ্চল। ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেও কোনও ত্রানসামগ্রী পৌছেনি কোথাও, চালানো হয়নি উদ্ধার কাজও। সব মিলিয়ে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় পাকিস্তান সরকারের প্রস্তুতির অপ্রতুলতা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলা সেদিন বড় বেশি করে বুকে বাজে বাঙালীদের।
আর একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেই, ৭০ এর এই জলোচ্ছাসে বাঙালীদের প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের উদাসীন্য এবং বিমাতা সুলভ আচরনও কিন্তু বাঙালীদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। এবং এর একমাসের মাথায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচনে তাই সারা বাঙালী এক হয়ে মুজিবকে ভোট দিয়েছিলো।
তথ্যসূত্র: উকিপিডিয়া, বিবিসি বাংলা, ব্লগার আহমেদ জী এস
ছবি: গুগল সার্চ ইঞ্জিন
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সামহোয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৯:৩৭