সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা
ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে অজেয় জগতে
ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?
মেঘনাদবধ কাব্য
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
প্রথম অধ্যায়: -
রাবণ একটি পুরাণ ইতিহাস। হতে পারে মিথ, হতে পারে নিছক গল্প অথবা উপন্যাস। অনেক কিছুই হতে পারে তবে পুরাণ অনুযায়ী এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অনেক। তারমধ্যে সবথেকে বেশি প্রচলিত ব্যাখ্যাটি পুরাণ অনুযায়ী রাবণের ১০টি মাথা আসলে মানুষের ১০টি খারাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যের প্রতীক। (১) অহংকার (২) মোহ (৩) অনুতাপ (৪) ক্রোধ (৫) ঘৃণা (৬) ভয় (৭) হিংসা (৮) লোভ (৯) কাম (১০) জড়তা। এই ১০টি চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যের প্রতীক হিসেবেই রাবণ দশানন।
রাবণ ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণের অন্যতম প্রধান চরিত্র ও প্রধান নায়ক। তিনি মহাকাব্য ও পুরাণে বর্ণিত লঙ্কা দ্বীপের রাজা। কিন্তু বর্তমানে শ্রীলঙ্কা যে সেই লঙ্কা সেটি এখনো নিশ্চিত নন। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে রামায়নের এই তথ্যটি পাওয়া যায় না। রামচন্দ্রের পত্নী সীতাকে হরণ করে তিনি লঙ্কায় নিয়ে যান। সীতার উদ্ধারকল্পে কিষ্কিন্ধ্যার বানরসেনার সাহায্যে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করলে রাবণের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়। এই ঘটনা রামায়ণ মহাকাব্যের মূল উপজীব্য। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে তার পূর্বজীবনের কথা বলা হয়েছে।
রাবণের প্রকৃত নাম দশানন/দশগ্রীব। তার রাবণ নামটি শিবের দেওয়া। জনপ্রিয় শিল্পে তার দশটি মাথা, দশটি হাত ও দশটি পা দর্শিত হয়। মহাকাব্যে কামুক ও ধর্ষকামী বলে নিন্দিত হলেও রাবণকে মহাজ্ঞানী ও তাপসও বলা হয়েছে। উত্তর ভারতে দশেরা উৎসবে রাবণের কুশপুত্তলিকা দাহ আজও এক জনপ্রিয় প্রথা। রাবণ আদি যুগে সর্বপ্রথম মর্তে উড়ন্ত যান পুষ্পক রথ ব্যবহার করেন।
রাবনের পিতা ব্রহ্ম ঋষি বিশ্রবা এবং মাতা কৈকসী। বিশ্রবা মহর্ষি পুলস্ত্যর (সপ্তর্ষি/সপ্ত ঋষির একজন) পুত্র আর কৈকসী হলেন অসুর রাজা সুমালীর কন্যা। কৈকসীকে বিবাহের জন্য অসুর রাজা সুমালীর কাছে অনেক প্রস্তাব আসে কিন্তু সুমালীর ইচ্ছা যে, সে তার কন্যাকে মৃত্যু লোকের সবচেয়ে শক্তিশালী সত্তার সাথে বিবাহ দিবে, যাতে তার মেয়ের সন্তানরা ব্যতিক্রমী, তেজস্বীএবং পরাক্রমী হয়, তাই সকল বরকে তিনি ফিরিয়ে দেন কারণ তারা কেউই তার চেয়ে শক্তিশালী ছিলনা। কৈকসী অনেক ঋষি ও মুনির মধ্যে খুঁজে বিশ্রবাকে বিবাহ যোগ্য মনে করেন এবং তার সেবা করেন। তার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে ঋষি বিশ্রবা তাকে বিবাহ করেন। ব্রহ্ম ঋষি বিশ্রবার ঔরসে কৈকসীর গর্ভে তিন পুত্র যথাক্রমে দশানন (দশ মাথা বিশিষ্ট), কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ এবং এক কন্যা শূর্পণখার জন্ম হয়। রাবণ ও তার সহোদরদের শিক্ষা তার পিতার কাছে সম্পন্ন হয়। রাবণ বেদ শাস্ত্রের অন্যতম একজন পন্ডিত ছিলেন।
রাবণ গীত রচনায় অতি নিপুন ছিলেন। তিনি শিবের পরম ভক্ত ছিলেন। সার্বক্ষণিক শিবের সান্নিধ্য পাওয়ার লক্ষ্যে তিনি যখন কৈলাশ পর্বতকে লংকায় প্রতিস্থাপনের জন্যে নিজ তপোবল দ্বারা দুই হস্তে তুলে নেন তখন মহাদেব তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি কৈলাশে স্পর্শ করলে রাবণের দুই হাত কৈলাশের নিচে চাপা পরে যায়। রাবণ তখন প্রচন্ড চিৎকার করতে থাকে এবং শিবকে শান্ত করার নিমিত্তে তিনি একটি গীত রচনা করেন, যা পরে "শিব তাণ্ডব স্তোত্র" নামে পরিচিত হয়। শিবের ক্রোধ শান্ত হয় এবং মহাদেব রাবণকে তার চন্দ্রোহাশ নামক খড়গ তাকে উপহার দেন এবং অতি উচ্চ মাত্রায় তার রোদন করার কারণে তার নাম রাবণ বলে পরিচিত হয়। “শিব তাণ্ডব স্তোত্র” গীতমালাটি রাবণ পুত্র ইন্দ্রজিৎ মুছে দেন যাতে পরবর্তীতে আর কেউ কোনোদিন কোনোকালে “শিব তাণ্ডব স্তোত্র” গীতমালা ব্যবহার করে শিবকে অনুকূল করতে না পারেন।
রাবণ বাস্তু শাস্ত্রে এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রে অতীব জ্ঞান রাখতেন। জ্যোতিষ শাস্ত্রে তার জ্ঞানের দ্বারা সে তার পুত্রের জন্মলগ্নে সকল গ্রহকে তার বসে এনে সেই তিথিকে মঙ্গল তিথী বানিয়ে নেন। রাবণ ব্রহ্মার কঠোর তপঃ করেন এবং বর প্রাপ্ত হন যে, নর ও বানর ছাড়া তাকে কেউ বধ করতে পারবেন না। রাবণ তার বৈমাত্রেয় বড় ভাই কুবের কে পরাজিত করে তার কাছ থেকে পুষ্পক বিমান নেন যা তাকে অতি অল্প সময়ে লঙ্কা থেকে যে কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারত। প্রথম জীবনে রাবণ শিবের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে পরে শিবের ভক্ত হোন। রাবণ পূর্বজন্মে ছিলেন অভিশাপগ্রস্ত বিষ্ণুভক্ত বিজয়। রাবণ তার নিজশক্তিতে ত্রিলোকের অধিপতি হোন। শ্রী রাম অবতারিত হোন এবং রাবণকে বধ করেন। কথিত আছে, রাম রাবণকে হত্যা করে ১ বৎসর ব্রহ্ম হত্যার অনুশোচনায় হিমালয়ের তপস্যা করেন। কারণ রাম ছিলেন পুরুষোত্তম।
দ্বিতীয় অধ্যায়: -
চন্দ্রাবতীর রামায়ন কাহিনী শুরু হয়েছে লঙ্কার বর্ণনা দিয়ে। চন্দ্রাবতির রামায়নে রাম চরিত্রের বদলে সীতা চরিত্র হয়ে উঠেছে অনেক বেশী উজ্জল । কাব্যটি তাই রামায়ন না হয়ে হয়েছে নারীর দু:খের কাহিনী ‘সীতায়ন”। যে জন্য রামের জন্মের কথা প্রথমে না বলে সীতার জন্ম কাহিনী দিয়ে শুরু করে তার জীবনের গুরুত্বপুর্ণ ঘটনাবলী স্থান দিয়ে , তার মানসিকতাকে সুনিপুনভাবে ব্যখ্যা করে তারই পাতাল প্রবেশ দিয়ে রামায়নের কাহিনীর ছেদ টেনেছেন কবি । পুরুষতান্ত্রিক প্রাধান্যের কাছে নারীরা কিভাবে উপেক্ষিত ও লাঞ্চিত হয় ,কিভাবে তাকে দু:খের সাগরে নিক্ষেপ করা হয় – সেই ঘটনা তথা কাহিনী উঠে এসেছে চন্দ্রাবতীর রামায়নে "নারীর চোখে নারীর বয়ানে”।
অনেক লেখাতেই দেখা যায় রামায়ন আনুসারে রাবণ একজন দানব, তবে শ্রীলঙ্কানদের কাছে তিনি হিরো, শ্রীলঙ্কানদের কাছে রাবণের বিষয়ে রয়েছে আকর্ষণীয় কিছু গল্প। উল্লেখ্য হিন্দু সম্প্রদায় যখন দশেরা পার্বন উদযাপন করে তখন তারা খুব ভক্তিভরে রামায়ন পাঠ করে । তাদের কাছে রামায়ন কেবল ভগবান রামের রাবণকে জয় করে সীতা উদ্ধার করার গল্পই নয়, এটি অনেক বাধা সত্ত্বেও খারাপের উপর ভালর জয়ের বিষয়। এটি সেই গল্প যা সেই ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির সঠিক বিষয়গুলির জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আশা এবং অনুপ্রেরণা দেয়। তবে আমরা সকলেই জানি যে প্রতিটি গল্পের দুটি দিক রয়েছে। শ্রীলঙ্কানদের কাছেও রাবণ সম্পর্কে আলাদা কিছু ধারণা রয়েছে। রাবণের পিতা ব্রক্ষ ঋষি বিশ্রবা ও মাতা কৈকসী। তার জন্ম বৃতান্ত ও গুনাবলী আপনার পোষ্টে সুন্দরভাবে উঠে এসেছে । আসলে মনুর বয়সকালে তাঁর বাবা ছিলেন সাপ্তারিশের একজন। উচ্চ মার্গের পরিবার থেকে আগত, রাবণকে একাডেমিক এবং মার্শাল আর্ট উভয় ক্ষেত্রেই সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল।
এটি একটি পরিচিত সত্য যে রাবণের দশটি মাথা ছিল এবং লোকেরা প্রায়শই বলে যে এটি তাকে তার জ্ঞানের জন্য বিশেষ উপহার দিয়েছে। ধারণা করা হয় যে তার ১০ টি মাথা থাকার অর্থ তিনি একজন খুব জ্ঞানবান ব্যক্তি এবং সেই যুক্তি অনুসারে এক মহান রাজা যিনি প্রশাসনের বিষয়ে দুর্দান্ত জ্ঞান রাখেন। আসলে, আয়ুর্বেদে সাতটি বই রয়েছে যার লেখক হিসাবে এখনও তাঁর নামই দাঁড়িয়ে আছে, যার ফলে তাঁকে একজন মহান চিকিৎসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কথিত আছে যে তার স্ত্রীর অনুরোধে তিনি শিশুদের জন্য আয়ুর্বেদিক (ঔষধ) প্রতিকারের বিষয়ে একটি বই লিখেছিলেন।
বিজ্ঞান থেকে শুরু করে চিকিৎসা পর্যন্ত সমস্ত ক্ষেত্রে রাবণ নিজের জন্য একটি নাম তৈরি করেছিলেন। সীতাকে অপহরণ করার সময় রাবণের যে পুষ্পক বিমান ব্যবহৃত হয়েছিল পৌরাণিক কাহিনী মতে সেটি ছিল রাবণ আবিষ্কত উড়ন্ত যান । এই পৌরানিক উপাখ্যানটি প্রমান করে রাবণের জ্ঞান শুধু চিকিৎসা সাস্রের উপর্ই ছিলনা উপরন্ত তিনি বৈজ্ঞানিকও ছিলেন। নতুনত্বের দিকে তার ঝুঁক ছিল এবং তার অনন্য যানটি সে দিকটিই প্রতিভাত করেছে। এসকল বিষয়ে তার জ্ঞানই তাকে এমন একজন মানুষ হিসাবে গড়ে তুলেছিল যে কারণে মানুষ তার প্রশংসা করেছিল সাথে তার শক্তিমত্তার জন্য তাকে ভয়ও করত।
তিনি শিবের এক মহান ভক্ত ছিলেন। রাবণ তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য ধ্যান করতেন। তিনি একজন মানুষ হিসাবে যেভাবেই থাকুন না কেন, কেউ অস্বীকার করতে পারেন না যে তিনি শিবের অত্যন্ত অনুরাগী ভক্ত ছিলেন। ভগবান শিব তাঁর দ্বারা এতই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে তিনি তাঁকে ঐশ্বরিক অস্ত্র ব্যবহার করার শক্তি দান করেছিলেন, এটি এমন এক সম্মান যা কেবলমাত্র একজন পরিশ্রমী ভক্তই অর্জন করতে পারেন।
শ্রীলঙ্কানদের কাছে রাবণ এবং রামের মধ্যে যুদ্ধের শুরুটাও ছিল ভিন্ন রকম। ভারতীয়রা বিশ্বাস করেন যে রাবণ যদি সীতাকে অপহরণ না করত তবে এর কিছুই ঘটতনা । অন্যদিকে শ্রীলঙ্কানরা বিশ্বাস করে যে ভগবান রামকে প্রনয় প্রস্তাব দেওয়ার কারণে রাবণের ভগ্নী সুপর্ণখার নাক কেটে রামভ্রাতা লক্ষনই ঘটনা প্রথম শুরু করেছিলেন। তাদের মতে, রাবণ যা কিছু করেছিলেন তা ছিল তার ছোট বোনের প্রতি আঘাতের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একজন বড় ভাই এর কাজ।
শ্রীলঙ্কানরা রাবণকে দেবতা হিসাবে অবশ্য পুজা করে না তবে তারা তাঁর সমস্ত কাজের জন্য তাঁকে একজন মহান রাজা হিসাবে বিবেচনা করে। তাদের জন্য, তিনি ছিলেন রাজা যিনি আক্রমণকারীদের প্রতিহত করেছিলেন। তাদের জন্য, তিনি হলেন সেই মর্মান্তিক নায়ক যিনি তার বোনের সম্মানের প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করার সময় তাঁর নিজের ভাই বিভীষণ রামের স্বার্থের কারণে তার প্রতি বিশ্বাসঘতকতা করেছিল। শ্রীলঙ্কানদের কাছে তিনি ছিলেন সেই রাজা, প্রভুত জ্ঞানের পুস্কার হিসাবে যাকে দান করা হয়েছিল দশটি মাথা। তিনি ছিলেন সেই রাজা, যিনি ভগবান শিবের প্রতি তাঁর অঘাধ ভক্তির পুরস্কার হিসাবে অর্জন করেছিলেন এক শক্তিশালী ব্রহ্মাস্ত্র।
রাবণকে নিয়ে শ্রীঙ্কানদের কোন উৎসব পার্বণ নেই এবং তারা তাঁর নামে মন্দিরও তৈরি করেনি তারা। তবে তারা তাঁকে এক মহান রাজা হিসাবে দেখেন যার সাথে জড়িত রয়েছে একটি মর্মান্তিক পরিণতি। রাবণ একটি অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব যার কাহিনীর সাথে যুক্ত রয়েছে দুটি বিপরীত সত্য।
শেষ কথা: অত্যন্ত মজাদার একটি তথ্য দিয়ে শেষ করছি, রাবণ আমাদের মহেশখালী দ্বীপে মধ্যরাতে মধ্য প্রহরে অবতরণ করেছিলেন। আমাদের মহেশখালী দ্বীপে শিবের আগমন ঘটে রাবণের কারণেই - সে গল্প অন্য একদিন। সবাইকে নতুন বছরের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি।
ছবি: গুগল সার্চ ইঞ্জিন
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সামহোয়্যারইন ব্লগ কর্তৃপক্ষ।
তথ্য উপাত্ত:
প্রথম অধ্যায়: মেঘনাদবধ কাব্য কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
দ্বিতীয় অধ্যায়: কৃতজ্ঞতা্র সাথে যার নাম নিচ্ছি তিনি আমাদের সকলের প্রিয় জনাব, ডঃ এম এ আলী সাহেব।
গুগল সার্চ ইঞ্জিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৫:৫৪