সেন্ট্রাল ঢাকার কথা মনে হলেই সামার সাহেবের মনে ও শরীরে শত সহস্র ক্লান্তি এসে ভর করে। রাজধানী ঢাকার সড়কে এতো এতো জ্যাম পেড়িয়ে সেন্ট্রাল ঢাকাতে যাওয়া সত্যি সত্যি এক মহাক্লান্তিকর বিষয়। সামার সাহেব অফিসের দেয়াল ঘড়ি ও হাতঘড়ির সাথে সেলফোনের সময় মিলিয়ে নিলেন - না, উভয় ঘড়ির সময়ই ঠিক আছে। শীতের বিকেল। অতিদ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসবে সাথে সাথে রাতও। সেন্ট্রাল ঢাকায় পাঁচ তারকা একটি হোটেলে আজ সন্ধ্যায় বণিক সমিতির জরুরী সভা। সামার সাহেব নিরামিষভোজী মানুষ। বুফে খাবার লোভে ঢাকার জ্যাম ঠেলে পাঁচ তারকা হোটেলে যাবার মানুষ তিনি নন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ট্যাক্স ভ্যাট এআইটি এটিভি সব মিলে ব্যবসায়ীদের নাকে দম আঁটকে রেখেছে - গলা চিপে ধরেছে। সভায় হাজিরা দেওয়াটা জরুরী আর তাই আজ বণিক সমিতির সভায় না গেলেই নয়।
সামার সাহেব আর দেড়ি না করে বনানী অফিস থেকে এসইউভি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। উদ্দেশ্য বনানী এগারো নাম্বার সড়ক ধরে গুলশান শ্যুটিং ক্লাব হয়ে হাতিরঝিল পাড়ি দিয়ে এফডিসি সড়কে উঠবেন। সামার সাহেবের কাছে চির পরিচিত বনানী মাঝে মাঝেই অপরিচিত মনে হয়। কে বলবে এই বনানী একসময় নিরব নিস্তব্ধ আবাসিক এলাকা ছিলো? এখনকার বনানী হয়ে গিয়েছে রেষ্টুরেন্ট আর মেয়েছেলের কাপড়ের বাজার! সারাটা দিন মানুষ খাচ্ছে আর সারাটা দিন মানুষ কাপড় চোপড় কিনছে। এতো খায় মানুষ! - আর আর এতো এতো খাওয়া সম্ভব? দেশের মানুষের গড় ওজন কতো বেড়েছে তার কি কোনো সঠিক বেঠিক সমীক্ষা বা জরিপ হয়েছে? - সামার সাহেবের ভাবনায় বাঁধা পড়ে। গুলশান শ্যুটিং ক্লাব পাড় হতেই চার পাঁচটি বাইক আচমকা ভনভন শব্দ করে সড়কে চলমান সিএনজি সেলুন এসইউভি ফোর হুইল ভেহিকল অতিদ্রুত অতিক্রম করে ছুটে চলে হাতিরঝিলের দিকে - তারই মাঝে এক বাইকার দেখেও না দেখে পেছনে ফেলে যায় এক বৃদ্ধকে! বৃদ্ধ সড়কের পাশে ছিটকে পড়েছেন! ছিটকে পড়েছে তাঁর বাজারের ব্যাগের সামান্য গরুর মাংস, চাল, আলু ও পেঁয়াজ।
শেষ বিকেলের আলো - সবাই বাড়ি ফেরায় ব্যস্ত; সামার সাহেবও ব্যস্ত তারপরও তিনি গাড়ি সাইট করেন। পৃথিবীতে কিছু মানুষ তৈরিই হোন ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট হিসেবে এরা কখনো স্বার্থপর হতে পারেন না। বিপদে আপদে এই মানুষগুলো বিনা স্বার্থে মানুষের পাশে দাড়ান। বিচিত্র কারণে কারো বিপদ দেখে এই মানুষগুলো কখনো পালিয়ে যেতে পারেন না। মজার ব্যাপার, বৃদ্ধ দেখতে অবিকল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মতো! তিনি উঠে দাড়িয়েছেন তেমন কোনো ব্যথাও পাননি। খেটে খাওয়া মানুষের শক্ত মজবুত শরীর বলে কথা। বয়স আনুমানিক ৬৫ হবে।
ছড়ানো ছিটানো চাল পেঁয়াজ আলু ও মাংস সামার সাহেব বাজারের ব্যাগে উঠাতে চেষ্টা করেন। অতি সামান্য গরুর মাংস! সামার সাহেব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন এই গুলোকে সঠিক মাংস বলা ঠিক হবে না। কসাইয়ের কাছে স্পেয়ার/অতিরিক্ত হাড় থাকে - অতি সামান্য মাংসযুক্ত গরুর মাথার হাড়! তাও তিন থেকে চারশত গ্রাম হবে হয়তো।
সামার সাহেব বৃদ্ধের হাতে ব্যাগ দিয়ে বলেন - চাচামিয়া আপনার পোয়া খানেক চাল উঠাতে পেরেছি, সব চাল উঠানো সম্ভব না, ইট বালির গুড়োতে শেষ। তবে মাংস ধুয়ে নেয়া যাবে। বৃদ্ধ ব্যথা পেয়ে এতোক্ষণ কাঁদেননি এখন পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখ মুছেন। তিনি ধরা গলায় কথা বলেন, তাঁর নাতনী জহুরা মাংস পোলাও খেতে চাইছে মাস খানেক ধরে, আজ চাল মাংস কিনে এই দুর্ঘটনা। বৃদ্ধের নাম জালাল উদ্দিন। সড়কে পড়ে থাকা প্লাস্টিক বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে জীবন যাপন করেন। তিনজনের পরিবার; তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী ও পাঁচ বছরের নাতনী শিশু জহুরা। বৃদ্ধ জালাল উদ্দিনের ছেলে রিক্সা ভ্যান চালাতো, স মিলে গাছ নামাতে গিয়ে তলায় চাপা পড়ে পঙ্গু হয়েছে আর পঙ্গু থেকে তিন মাসের মাঝে মৃত্যু! আর ছেলের বউ পঙ্গু স্বামী ও সন্তান রেখে নিখোঁজ হয়েছে চার বছর হলো!
সামার সাহেব বুকে এক অজানা অচেনা ব্যথা অনুভব করেন। জহুরা! - জহুরা সামার সাহেবের বেহেস্তবাসী ফুপুর নাম। তিনি কি মনে করে বৃদ্ধকে বলেন - আপনি গাড়িতে উঠেন, আপনি থাকেন কোথায় আমি দেখবো? বৃদ্ধকে নিয়ে তেজগাঁ এক বস্তিতে উপস্থিত হয়ে যা দেখেন তা বৃদ্ধের বর্ণনা সত্যি প্রমাণিত করে। সামার সাহেব তেজগাঁ পলিটেকনিক কাঁচা বাজার থেকে মাংস পোলাও চাল প্রয়োজনীয় মসলাপাতি কিনে জালাল উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলেন - আপনারা কি আমার গ্রামের বাড়িতে যাবেন? সেখানে আপনাদের কাজ করে খেতে হবে। বাড়িতে আরোও মানুষ জন আছেন, ফসলি জমিতে সবাই কাজ করেন। তবে আপনার নাতনীর কোনো কাজ করতে হবে না, তাঁকে পড়ালেখা করানো হবে। আমি কথা দিচ্ছি তাঁর জীবন গড়ার দায়িত্ব আমার। আমি যদি বেঁচে না থাকি - আমার ছেলেমেয়ে তাঁকে দেখবেন। আপনারা চিন্তা করুন। আগামী বৃহস্পতিবার রাতে আমি গ্রামের বাড়িতে যাবো।
পরিশিষ্ট: বৃহস্পতিবার রাত। ঢাকা সিলেট মহা সড়কে সামার সাহেবের এসইউভি ছুটে চলেছে - গন্তব্য গ্রামের বাড়ি অন্ধগ্রাম। জহুরা সামার সাহেবের পাশের সিটে - খুব সম্ভব অনেক অনেক দিন পর আরামের ঘুমে জহুরা। আর পেছনের সিটে বৃদ্ধ জালাল উদ্দিন ও তাঁর স্ত্রী কিছুক্ষন পর পর চোখ মুছছেন।
আত্মকথা: সামার সাহেব নামক অতি সাধারণ একজন মানুষের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্পটি লেখা হয়েছে।
ছবি: আব্রাহাম লিংকন - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম রাষ্ট্রপতি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সামহোয়্যারইন ব্লগ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:২৯