আজ প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে শিশির একরকম বন্দী জীবন যাপন করছে। এরই মাঝে চার তালার ছাদের চিলেকোঠার এই ছোট্ট ঘরটাকে অনেক আপন করে নিয়েছে। ঘরের এক কোনে পড়ে আছে একটা আধভাঙ্গা টেবিল- চেয়ার, কিছু অগোছাল বই, অপরিস্কার পানির মগ, ভাঙা একটা আলনা আর তাতে কিছু এলোমেলো ময়লা কাপড়। ছোট্ট একটু খানি জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে দিনের সুর্য, আর রাতের চাঁদ-তারারা উঁকি দেয়। হয়তবা পথ ভুল করে কোন অচেনা পাখি উড়ে এসে বসে কার্নিশে, কিচির মিচির ডেকে চলে আপন মনে।
একমাত্র জানালা দিয়েই সে দেখে দূরের আকাশের মেঘ আর নক্ষত্রের মেলাকে। কত-শত রঙের মেঘ। ইশ সে যদি ছুতে পারত! সত্যিই মেঘের অনেক রঙ। আচ্ছা মানুষের জীবনেও তো অনেক রঙ, কিন্তু আমার জীবনটি ধূসর কেন? কেন এত তাড়াতাড়ি আমার জীবনটা থমকে দাঁড়াতে চায়? কেন হারাতে চায় গহীন আঁধারে? আরও কত প্রশ্ন উঁকি দেয় মনের কোনে। এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঝিমুনি চলে আসে, হয়তবা একটু ঘুমও। হঠাত বৃষ্টির ফোটার স্পর্শে জেগে ওঠে। জানালা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল হয়ত। বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বাইরে তাকিয়ে আপন মনে বৃষ্টি দেখতে থাকে। কি অপরূপ সুন্দর বৃষ্টিটা! খুব ইচ্ছা হয় সেগুলো গায়ে মাখতে। কিন্তু...........।
আজ সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। মনে হচ্ছে সমগ্র আকাশটা কারও উপর অভিমান করে অঝোর ধারায় কাঁদছে। কোনকিছুর বিনিময়ে যেন এই কান্না থামবার নয়। বিছানাটা বেশ খানিকটা ভিজে যেতেই সে নিতুকে ডাকতে থাকে। কিন্তু সে আসে না, হয়ত বৃষ্টিতে ভিজছে। মনটা কেমন জানি উদাস হয়ে ওঠে। পুরানো স্মৃতিরা ভিড় করে বুকের মাঝে, ভেসে ওঠে চোখের কোনে। কত সুন্দর সময়ই না ছিল তার। এমন ঝুম বৃষ্টিতে সেও কত ভিজেছে একসময়। আর এখন.........।
এরমাঝে কখন নিতু এসেছে সে বলতে পারে না। চমক ভাঙে নিতুর ডাকে, ভাইজান আপনার চা, আপনি না আজ বাইরে যাবেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, দেখিস না বাইরে কেমন বৃষ্টি, কিভাবে যাব? কিন্তু বের তো ওকে হতেই হবে। এই দিনটার জন্যই সে অপেক্ষা করে আছে, কত স্বপ্ন, শত আশা নিয়ে বুক বেঁধে আছে এই দিনের প্রতীক্ষায়। কিন্তু মাঝ থেকে বাধ সাধল এই মরার বৃষ্টি। জামা পরতে পরতে আপন মনেই বলে উঠল, বৃষ্টিটা আজকে না হলেই কি হত না? কি-আর করা, আমার ইচ্ছাতে তো বৃষ্টি আর আসবে যাবে না।
হ্যাঁ, সত্যিই তো তার ইচ্ছাতে তো বৃষ্টি আর আসবে যাবে না। বৃষ্টি তো এখন অনেক দূরের কেউ। আর এই দূরত্ব শুধু পথের না মনেরও। বৃষ্টি আজ ট্রেনে করে যাবে। খুব কাছের এক বন্ধুর মাধ্যমে এই খবর সে পেয়েছে। বাড়ির পাশের যে লোকাল ষ্টেশনটা যেখানে ট্রেন থামে মাত্র ৫ মিনিটের জন্য। এরই মাঝে ওর যা করার করতে হবে। আজ দীর্ঘ ৫ বছর পর ওর সাথে দেখা হবে, ভাবতেই কেমন জানি লাগে। সত্যি হবে তো? এই ৫ বছরে ওর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। ভাবতেই অবাক লাগে একসময় একদিন যাকে না দেখলে কেমন অস্থির থাকত, সে কিভাবে পারল এতটা দিন এভাবে কাটাতে? আসলেই মানুষ নামক প্রাণীটি বড়ই অদ্ভুত! বৃষ্টি নাকি জানালার পাশে বসেছে, হ্যাঁ তাইতো বসার কথা। ট্রেনে চড়ে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে খুব ভালবাসত ও । আর আমি ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম, বাতাসে ওর খোলাচুল উড়ত, কি যে সুন্দর লাগত! মনে হত পৃথিবীর সব সৌন্দর্য ভর করেছে ওর উপর। যতবার ওকে নিষেধ করতাম বাইরে হাত বের কোর না, আর ততবারই অবাধ্য শিশুর মত হাসতে হাসতে বলত, বাইরে হাত দিলে কি হয়? বলতাম, তুমি যদি ব্যাথা পাও? ও হেসে বলত, না হয় পেলামই একটু। কতক্ষন পর কানের কাছে আস্তে আস্তে বলত, “এত ভালো কেন বাস আমায়? যদি কোনোদিন হারিয়ে যায় কি করবে তখন?” বলতাম, আমি তোমাকে হারাতে দিলে তো। তখন ও নির্ভয়ে আমার হাতটা আঁকড়ে ধরে থাকত। কি যে এক মায়াময় অনুভূতি........।
কিন্তু আমি পারিনি আমার কথা রাখতে। এই ব্যার্থতা কি শুধুই আমার? এজন্যই হয়ত আজও ছুটে চলেছি ওর পিছনে। জানি ও আমার হবার নয়, তারপরও ছুটছি.........। জানিনা কীসের আশায়......... কোন সে মায়ায়......... আজও খুঁজে ফিরি তাকে। চোঁখটা ঝাপসা হয়ে আসে ওর। আচ্ছা, দেখা হলে কি বলব ওকে? আমাকে চিনবে তো, নাকি না চেনার ভান করবে? আমার সাথে কথা বলবে তো? না-কি আমি শুধু দূর থেকেই দেখব? এসব ভাবতে ভাবতে একসময় কাকভেজা হয়ে সে ষ্টেশনে পৌঁছায়। হুইছেল বাজাতে বাজাতে একসময় ট্রেন এসে থামে। দু’হাত ভর্তি বাদল দিনের প্রথম ফোঁটা কদম ফুল নিয়ে শিশিরের উৎসুক দু’চোখ হাজারও অচেনা মানুষের ভিড়ে খুঁজে ফেরে সেদিনের সেই হারিয়ে যাওয়া বৃষ্টিকে............।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



