somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প : বেনুদির শাড়ী উড়ে গ্যাছে হাওয়ায় ...

২০ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নিঝুমনিদ্রা ভেঙে জেগে দেখি সবখানে এক অপরূপ আঁধার ; আমার ধূপ-ধোয়া ঘরে প্রবেশ করছে হাওয়া-মাতাল বৃষ্টিজলের ছাঁট । গরাদে ঝুলে আছে – জলমগ্ন রাত , বাবার খয়েরি শার্ট , বিমর্শ রোদ-চশমা । আনত ফ্রেম থেকে উড়ে যাচ্ছে তেরটি স্মৃতির পাখি , উদ্দেশ্যহীন । এইসব হিমশীতল নৈঃশব্দ্যের রাতে আশ্চর্য এক নিঃসঙ্গতা বুকে চেপে বসে । কখনো মনে হয় বৃষ্টি এক নির্জন উপত্যকার ডাকনাম , এই ভেবে ক্রমশ অস্থির হয়ে পরি । বাইরে থেকে হয়তো নিমজ্জিত আলোরা ঘরে এসে পরে , সেই আলো আঙ্গুলে জড়িয়ে আরও ব্যথিত হই , ছায়া-মগ্ন হয়ে থাকি । অন্ধকারে বিছিয়ে দেই মায়াবী ক্যানভাস ; দেখি উড়তে উড়তে তেরটি স্মৃতির পাখি হারিয়ে যাচ্ছে অনিঃশেষ প্রান্তরে । ক্যানভাসে ক্রমশ ফুটে উঠছে বাবার বিষণ্ণ মুখ , মায়ের ব্যথিত দৃষ্টি !

বেনুদিকে মনে পরে , মনে পরে বেনুদির হাসি । বেনুদির শাড়ী উড়ে গ্যাছে হাওয়ায় । সে শাড়ী থেকে জন্ম নিলো পাঁচটি গোপন নদী । একটি নদী আমার ; আমার নদীর নাম সিথিসিদুর । বেনুদি আমার চার ক্লাস উপরে পড়েন ; বেনুদি থাকেন আমাদের পাশের গ্রামে । বেনুদি সারাদিন নদী তীরে ঘুরে বেড়ান , আর আমি তার পিছু পিছু হাটি । বেনুদি কবিতা ভালোবাসেন , হাটতে হাটতে কবিতা আওড়ান –

জল-শিথিল গাঙ ;
সে গাঙ্গে মাছরাঙাটি থাকে –
মাছরাঙ্গাটি ধরতে গিয়ে হারাই নদীর বাঁকে !

- ও দিদি ! তোমার তো অনেক নদী । একটা নদী দাওনা ?
- নিবি ? যা তোকে একটা নদী দিয়ে দিলাম !
- আমার নদীর নাম কি ?
- তোর নদীর নাম দিলাম সিথিসিদুর !
সেই থেকে আমি সিথিসিদুর নদীর বাঁকে থাকি । প্রতিদিন একটি দুঃখ ফেলে দেই জলে । কুড়িয়ে নেই অজস্র শঙ্খ ; কেননা –
বেনুদির দৃষ্টি জুড়ে শঙ্খ নদীর গান , এলোচুলে নেমে এলো গভীর বৃষ্টিবান......

বাবা কবিতা লিখতেন , আর সে কবিতা উড়িয়ে দিতেন হাওয়ায় । উড়তে উড়তে সেগুলো পেরিয়ে যেত কল্লোলিত কাশবন , বিচ্ছিন্ন রেললাইন , বেনুদিদের সাঁঝ উঠোন । আমি সে কবিতা মুঠোয় পুরে বেনুদিদের বাড়িতে ছুটতাম – “ অন্ধকার নিকটে এলে ঘাস-ফুল তুমি কোথায় লুকাও ? করতলে রেখেছি ঘ্রানলিপি , ধ্রুপদী সুর । সমুদ্র-স্নানের পর ব্যথিত পাখিরা ঘরে ফিরে , ঠোটে করে নিয়ে আসে অরন্যসবুজ । চুপি চুপি আমি কেন সেই অরণ্যে হারাই ? ...... ” । আমরা কবিতা পড়তাম , আর হাসতাম । হাসতে হাসতে আমাদের চোখে জল আসত , সেই জল আঙ্গুলে নিয়ে বেনুদি একটি শূন্য চিহ্ন এঁকে দিতেন কবিতা পৃষ্ঠায় ।

বাবা কবিতাপৃষ্ঠায় একটি জল-অংকিত অদৃশ্য শূন্য চিহ্ন দেখে বিষণ্ণ হয়ে যেতেন ; তার কপালের ভাঁজে ঝুলে পরত বিষণ্ণ শব্দাবলী । তার কোন কবিতার বই নেই , তার কবিতা কেউ ছাপে না । কেবল মা কবিতাগুলো সস্নেহে সাজিয়ে রাখতেন গোপন দেরাজে । মাঝে মাঝে বের করে পড়তেন । তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত , গভীর থেকে বেরিয়ে আসত দীর্ঘশ্বাস । মা বাবাকে গভীর ভালোবাসেন । অথচ আমি বুঝতে পারি কোন এক বিচিত্র কারণে বাবা , মাকে ভালবাসেন না ।

এক শীতের সকালে বাবা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন , তার হাতের মুঠোয় অজস্র বকুল কুড়ি ! বলেন –
- চল পাখিশিকারে যাই !
আমি বাবার হাত ধরে পাখি শিকারে চলি ; আমাদের গ্রামের কোণে এক অন্ধ অরণ্য আছে , কেউ জানেনা । সে অরণ্য আমার এবং তাতে অনেকগুলো সারস উড়ে বেড়ায় ! আমি সারস ভালবাসি ; কেননা মাঝে মাঝে খুব উড়তে ইচ্ছে করে । আমার পকেট-ভর্তি সারসের পালক , মুঠোভরতি ডানা ! আমি উড়তে পারিনা ,
- বাবা , আমি উড়ব !
- উড়বি ? চল উড়ি !
বাবা আমাকে কাঁধে তুলে নেন । আমি উড়তে উড়তে পেরিয়ে যাই কুয়াশা , অজস্র শস্য-জমিন , একটি নদীসাকো ! শূন্যে উড়িয়ে দেই পালক – ডানা , অনির্দিষ্টে ।

বাবা নদীতীরে পাখি-ফাঁদ পাতেন , আর আমি কাশফুল-বনে অপেক্ষা করি ! কিছু কাশফুল ছিঁড়ে লুকিয়ে রাখি বুকে , গলায় পরে নেই পুষ্পমাল্য । কাশফুল এবং উজ্জ্বল দুপুর ক্রমশ ডুবে যায় নদীজলে , সুদূরে দেখি – বেনুদির ছায়া , হেঁটে আসছেন নদীতীর ধরে । আমি ডাকি
- ও বেনুদি ! ......
বেনুদি কেবল হাসেন , বলেন – কিরে ! কাশবনে হারালি কবে ?
- হারাই নি , ফুল তুলি ! হি ...হি...
বেনুদি কাশবনে আসেন , কিছু ফুল উড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে যান ।

বাবা ফাঁদ পেতে ফিরে এসে বলেন
- ওটা কেরে ?
- ওর নাম বেনুদি । বেনুদি তোমার কবিতা খুব পছন্দ করে ।
বাবার মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হয় , বাবার দিকে তাকিয়ে বেনুদি লজ্জা পেয়ে চলে যান ।
- চল ! আজকে আর পাখি ধরব না , ফিরে যাই !
আমি আশ্চর্য হয়ে ফিরে আসি , পাখিশুন্য আমাদের দেখে মা কিছুটা হতাশ হন !

তারপর চলে এলো আরেকটি বসন্ত , আমাদের বয়স বেড়ে যায় হঠাত । দেখি – সবখানে এক অদৃশ্য পরিবর্তন । মা এবং বাবার মাঝে ক্রমশ বেড়ে চলেছে দূরত্ব , গড়ে উঠছে প্রস্তর-দেয়াল । মা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন , আমি ব্যথিত হই । আমি এখন প্রতিদিন স্কুলে যাই , আমার রোল – এক । আমি ছবি আঁকি , মাঝে মাঝে সে ছবি ছাপা হয় পত্রিকায় । মা সে ছবি ঘরের দেয়ালে টানিয়ে দিয়ে হাসেন । তার হাসির অভ্যন্তরে দেখতে পাই অনন্ত বেদনা ।

বাবা এখন মাকে কবিতা পড়ে শোনান না , আমাকে দিয়ে বলেন
- তোর বেনুদিকে কবিতাটা দিয়ে আয় !
আমি কবিতা দিতে এসে দেখি বেনুদির পরিবর্তন , বেনুদি এখন আর হাসেন না , কেমন লজ্জিত হয়ে কবিতা পড়েন নিশ্চুপ ! তারপর একটা চিঠি আমাকে দিয়ে বলেন
- এটা তোর বাবাকে দিবি । তুই পড়িসনা , বল তিন সত্যি !
আমি তিন সত্যি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি , উঠোন পেরিয়েই খুলি চিঠি-ভাজ ! পড়তে পড়তে আমি লজ্জিত হই , বুঝতে পারি বেনুদি বাবাকে ভালোবাসেন । তারপর সে চিঠি ফেলে দেই সিথিসিদুর নদীর জলে , একটি দুঃখসহ ! বাবা মাঝে মাঝে বলেন
- একদিন ওই কাশফুল-বনে হারিয়ে যাব , দেখিস ...

আমার বিশ্বাস হয়না , কেননা বাবাকে আমি ভালোবাসি । স্কুলে আমার কোন বন্ধু নেই , আমি নিঃসঙ্গ । আমাকে কেউ পছন্দ করেনা । ছুটি হলে কেউ আমাকে খেলায় নেয় না । আমি কষ্ট পাই এবং ছবি আঁকি । আমার কোন রং-পেন্সিল নেই , আমার কোন ক্যানভাস নেই ! আমি ছবি আঁকি আমার স্কেচ-খাতায় , কলম দিয়ে । সবাই সে ছবি দেখে হাসে ,আমি বাবার মত সে ছবি উড়িয়ে দেই হাওয়ায় ।

একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনি – মা কাঁদছেন । আমি দেখি আমাদের ঘরের সামনে অজস্র লোকের ভিড় । আমি নিকটে যেতেই মা আমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন, আমি বিস্মিত হই । আমার চোখে জল আসে , কেউ একজন এসে সেই জল মুছিয়ে দিয়ে চলে যায় ।

আমি বুঝি আমি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে গাছি । আমি বুঝি - বাবা বেনুদিকে নিয়ে হারিয়ে গ্যাছেন কাশফুল-বনে , বেনুদি খুঁজে পেয়েছে তার হারানো নদী ।


আমি সিঁথি সিঁদুর নদীর জলে কাগজের নৌকোসহ এই দুঃখটা ভাসিয়ে দিলাম এবং একটি ধুসর ছবি এঁকে , হাওয়ায় টাঙিয়ে দিয়ে ফিরে এলাম ...

***
৬৭টি মন্তব্য ৬৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×