হবে হবে খুব হবে।
ব্যাঙ্কে ইয়ার এন্ডিং এর ভয়ানক চাপ গেল- কোনো দিকেই তাকাতে পারেনি রজত, আজ সোমবার, শরীরের কারণ দেখিয়ে ছুটি নিয়েছে। সোমাও জীবন বীমায় উঁচুপদেই কাজ করে, সুন্দরী চটপটে ঘরে-বাইরে প্রচুর পরিশ্রম করে সে, ১৭ বছরের ছেলের মা বোঝাই যায় না।
অনিন্দ্য আসছে আজ, অনিন্দ্য ভট্টাচার্য সুখ্যাত আবৃত্তিকার, তার অনারেই রজত-সোমা ছুটি নিয়েছে আজ। আগে এ শহরেই পাশাপাশি বাড়িতে ভাড়া থাকতো তারা। অনিন্দ্য স্কুলে পড়াতো সঙ্গে টিউশন, আবৃত্তি করত আর তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠিনী অন্তরার সঙ্গে বেহদ প্রেম করত। বছর আটেক হল অন্তরাকে বিয়ে করে কলকাতামুখী হয়েছে, মধ্যমগ্রামের কাছাকাছি এক কলেজে পড়ায় এখন, আজ রাতে তার আবৃত্তির অনুষ্ঠান আছে দীনবন্ধু মঞ্চে। আর ডিনারও থাকবে এ বাড়িতে- বহুদিন বাদে আজ রাতে জম্পেশ আড্ডা হবে।
রজতের স্ফুর্তির কারণ আছে- অনিন্দ্যর অনারে আজ শুধু খানা নয় সামান্য পিনার ব্যাপারটাও আছে- মনোমত সঙ্গী না হলে পিনাটা ঠিক জমে না। সোমা কবিতা ভালবাসে- অনিন্দ্য অন্তরা দুজনকেই খুব ভালবাসে।
রজত আজ বাড়ির কম কাজ করেনি- বাজার হয়েছে- এখন আনন্দবাজার, টেলিগ্রাফ সহযোগে চা- তারপর আছে বেসিন কমোড সব পরিষ্কার- ছেলে পুকানের বাথরুম পরিষ্কার করে তার মা। সতেরো বছরের ছেলেকে বলা উচিত বোধ হয়- নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব তার নিজেরই। বলি বলি করেও বলা হয় না অনেক কথাই। পড়ার চাপ, একগাদা টিউশন।
ওদের জিনস, স্নীকার, হাই-হ্যালো, কোক-পিৎজা, পারফিউম সবই রপ্ত করা হল, কিন্তু ছোট্ট থেকেই আত্মনির্ভরতা আর শৃঙ্খলার পাঠই শেখা হল না এদের।
ছাদের টবে টবে কৃষ্ণচূড়া, মুগান্ডা, জবা, শিউলি আর নানান ধরনের পাতাবাহারের গাছ হয়েছে, সিঁড়ির দরজার ডানপাশে ছোট্ট একটা ঠাকুরের আসনও পেতেছে সোমা। সিগারেট সহযোগে টবগুলির পাশে পায়চারি করবার সময় বেশ তৃপ্তি হয় রজতের।
মা তখন বড়দার ওখানে- প্রায় পাঁচ মাস তো হল, এবারে মেজদার নিয়ে যাওয়া উচিত, মেজদা চা বাগানের কোয়ার্টারে, বাবাও এই বাগানেই চাকরী করতেন, ২০০০ এ বাবা গত হবার পর থেকে মা ‘যাযাবর’- তিন ছেলের কাছেই ঘুরে ঘুরে থাকেন, ওহ্ এ মাসের ১২ তারিখ পেরিয়ে গেল, মায়ের মাসিক বরাদ্দের ৫০০ টাকা পাঠানো হয় নি- এ্যাতো ঝামেলা, কাজের চাপ।
পুকানের উচ্চমাধ্যমিকের পরেই মাকে আনবে রজত- দাদাদের সাথে সেরকমই কথা হয়ে আছে। এ বাড়িতে মায়ের জন্য আলাদা কোনো ঘর নেই। বেডরুম তো দু’টো- একটা পুকানের অন্যটা রজত-সোমার, একটা ডাইনিং, দু’টো বাথরুম, কিচেন, তবে ড্রইংটা বিশাল, মা এলে ড্রইং-এর ডিভানেই রাত কাটান। পুব-দক্ষিণ খোলা বাড়ি- বন্ধুরা খুব প্রশংসা করে- বাড়ি, স্ত্রী-ভাগ্য ও সন্তান নিয়েও। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও সোমা প্রাণঢেলে বাড়িটি টিপটপ রাখার চেষ্টা করে। আজকাল সে ফ্যাংসুই-এর ঘোর ভক্ত। শ্বেত পাথরের জোড়া পায়রা, লাফিংবুদ্ধ, ঘন্টা, ফুলদানীর রং ও অবস্থান সব মিলিয়ে সুখের পাখিটিকে চিরকাল বেঁধে রাখার ইচ্ছে!
ঠিকে মাসি মায়াদি বেশ ক’বছর এ-বাড়িতে কাজ করছে, বড় বিশ্বস্ত ও আন্তরিক মানুষটি, তার কাঁধের ওপর ভর দিয়েই সোমা ঘর-বার সামলায়।
এক মায়ের সাথেই সুর মিললো না সোমার। পুকানের ছোট্টবেলায় মাকে নিয়ে আসবার খুব চেষ্টা করেছিল সোমা- কিন্তু বাবাকে ছেড়ে, নিজের সাজানো সংসার ছেড়ে মা আসেন নি- সেই থেকে ক্ষোভ!
পুকান বারো ক্লাসে পড়ছে, মাধ্যমিকে স্টার পেয়েছিল- অংক, জীবন বিজ্ঞান, ভূগোলে লেটারসহ। দু’জনেরই ছেলেকে নিয়ে গর্ব- স্বপ্নও অনেক। বড় বাধ্য ছেলে- আঁকা, সাঁতার, গান যখন যেটায় ভর্তি করা হয়েছে, শেখার চেষ্টা করেছে। আপাতত সব কাজ রেখে শুধুই পড়া। এই রেজাল্টের ওপর বাকি জীবনটা নির্ভর করছে। তার মস্তিষ্কের পুষ্টির জন্য প্রাচীন মতের ঘিয়ে ভেজে ব্রাহ্মীশাক থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক অ্যাময়ের প্রোটিনেক্স, সুষম ডায়েট-চার্ট তৈরি করা হয়েছে। তার দুই চোখ ও মনের আরামের জন্য দেওয়ালের সাথে রং মিলিয়ে হালকা সবুজ পর্দা, বিছানার চাদর, বালিশের কভার, চেয়ারের কুশন। হ্যাঁ মিউজিক সিস্টেমও আছে- গান না শুনলে পুকানের অঙ্কই হয় না। মাধ্যমিকে অঙ্কে ৯৭ পেয়েছিল- সুতরাং এটাই হয়তো অঙ্কে নম্বর বাড়ানোর টনিক- মিউজিক ওয়ার্ল্ড থেকে সিডি ক্যাসেট আনে সে- কখনও কখনও তিন-চারশ টাকারও।
মায়ের হাত-খরচের টাকাটাই যথাসময়ে পাঠানো হয় না, ঐযে বলে না সেই নিম্নগামী, আর ভালবাসা, নাড়ির টান, কৃতজ্ঞতা, কর্তব্য- এসব? কি জানি আজকের এই জেটযুগে তাদের অবস্থানটি ঠিক কোথায়? আর এই ভাবনাটুকুর জন্যেও যেন সময় নেই। এ বাড়িতে মায়ের কোন সঙ্গি নেই, দাদাদের বাাড়তেও কি আছে? বার্ধক্য বড় নির্জন- সবার মধ্যে থেকেও।
পুকানের সেই খিলখিল করে হেসে ওঠার অভ্যাসটা আর নেই- গল্প-কথা সব কমে গেছে, মুখটা কেমন রুক্ষ-ব্যাজার। ছ-ছজন প্রাইভেট টিউটর, অনেকটা সময় চলে যায় কোচিং সেন্টার আর টিউটরদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে! স্কুলেও পড়ার চাপ, সব মিলিয়ে সেই মিষ্টি হাসিখুশি ছেলেটা হারিয়ে যাচ্ছে, কেমন এক নতুন অচেনা মানুষ দেখতে পায় সোমা।
যা কঠিন প্রতিযোগিতার যুগ, পড়াশোনার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য তো বাকি জীবন পস্তাতে হবে, ভদ্র জীবন, ভালো চাকরী কিছুটি মিলবে না। হও গিয়ে মাফিয়া ডনের শাগরেদ, ড্রাগ পেডলার- আর দু’দিন বাদে খাও গিয়ে জেলখানার লপ্সি নয় পুলিশের গুলি- সব শেষ। জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে নেওয়া যাবে কি আর?
জীবন কী? জয়েন্টে ভালো র্যাংক, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে সুযোগ, তারপর ট্রেনিং, নামী কোম্পানীর দামী পদে চাকরী তারপর পরিচিত জনের দিকে আত্মপ্রসাদের চাপা হাসির এক টুকরো উপহার দিয়ে, প্রথমে ব্যাঙালোর বা হায়দ্রাবাদ তারপর বছর না ঘুরতেই ইউরোপ বা আমেরিকা। ছেলের জীবনটাকে এমন করেই সাজিয়ে তুলতে চায় রজত আর সোমা। সে জন্যে সমস্ত রকম আয়োজনও করেছে তারা। দৌড়টা ভালোই শুরু করেছে ছেলে- বাকি পথটুকুর জন্যেই যা চিন্তা। শান্ত নীল আকাশে হালকা মেঘখন্ডের মতই ভাসে ওরা।
রান্না সেরে ঘরদোর গোছাতে গোছাতে আজ দু’টো বেজে গেল, কিন্তু ছেলে তো এখনো এলো না। সকালের দু’টো টিউশনি পড়ে আগে ১১টার মধ্যে বাড়ি ফিরতো পুকান। কিন্তু আজকাল ১২টা ১টাও হয়ে যাচ্ছে। শঙ্খ বা কিংশুকদের বাড়ি গেল নাকি? ওদের আবার ইন্টারনেট-এর কানেকশন আছে। বড্ড ভয় করে সোমার- এ বয়সটা ভয়ংকর। চারদিকে যা সব ঘটছে। খোলামেলা পোশাকের নায়ক-গায়ক-নায়িকাদের ছবি সম্বলিত ম্যাগাজিন পড়ার বইয়ের পাশে পাশে থাকছে আজকাল। চোখে ধাক্কা লাগে, অস্বস্তি হয়। তরুণ শরীরের আর মার্কশীটের পুষ্টির সাধ্যমতো চেষ্টা চলছে। ঘরের আর বাইরের জীবন সাজাতে সাজাতে শত কাজের চাপে পুকানের মনের পুষ্টি ও প্রকৃত সৌন্দর্যবোধের চর্চাই তেমন করে শুরু হল না। বিউটি আর ভালগারিটির মধ্যেকার তফাৎটুকু উপলব্ধি করবার সময়ই পাচ্ছে না এই প্রজন্ম। এই উপলব্ধিও তো চর্চারই বিষয়।
রি রি রিং রি রি রিং বেজে ওঠে ফোনটা। ‘হ্যালো’ ওপাশ থেকে অপরিচিত পুরুষকণ্ঠ, কিছুটা যেন রুক্ষ- এটা রজতাভ মিত্রের বাড়ি? থানা থেকে বলছি। ‘থানা’ শব্দেই কেঁপে ওঠে সোমা, হঠাৎ দম আটকে আসে। মিঃ মিত্র কি আছেন? দিনতো একটু ওনাকে। রজতকে ভাঙা গলায় ডাকে সোমা, ‘এদিকে এসো তাড়াতাড়ি।’
‘হ্যাঁ বলুন, রজতাভ মিত্র বলছি।’ -আপনি এখুনি একটু থানায় চলে আসুন, ভক্তিনগর থানা, অমিতাভ মিত্র আপনার ছেলে তো? -হ্যাঁ, কি হয়েছে ওর? ছেলেটা... কোন অ্যাকসি... না না সে সব কিছু নয়, ছেলে আপনার ভালেই আছে, আসুন।’ -খট্ করে লাইন কেটে যায়। দ্রুত পাঞ্জাবীটা গলিয়ে পার্স পকেটে নেয়।
‘আমিও যাবো, কি হয়েছে বলবে তো!’- কাতরে ওঠে সোমা।
‘জানি না, কিছু বুঝতে পারছি না- এসো।’
বাইকটা রেখে বারান্দায় উঠে পড়ে ওরা- একজন বড় বাবুর ঘরটা দেখিয়ে দেয়। পাশেই লকআপে সাত-আটেক ছেলে, গাদাগাদি করে, জড়সড়- হাতে, রুমালে মুখ ঢেকে বসে আছে, কেউ কেউ কাঁদছে, ফোঁপাচ্ছে, -একটা চেয়ারে ইংরেজীর অধ্যাপক সত্যরঞ্জন বসু, চোখে মরা মাছের দৃষ্টি, ওনার ছেলে শঙ্খশুভ্র পুকানের নার্সারী বেলার বন্ধু- পড়াশোনায় তুখোড়, উনি এখানে কেন?
‘আমি রজতাভ মিত্র’- হুঁ, অমিতাভ মিত্র- বলে হাঁক ছাড়ে বড়বাবু, এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছে ছেলেটি- ও কে? হ্যাঁ পুকানই তো, সার্ট নেই, শুধুই প্যান্ট, পিঠে কাঁধে কালশিটের দাগ- চোরের মত পা ঘষটে ঘষটে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়...
কাঠের ভারি রুলটা রজতের হাতে দিয়ে বড়বাবু বলেন- হুঁ মারুন, মেরে হাত দু’টো আর পা দুটো ভেঙে দিন- এই দলটাকে কয়েকদিনের চেষ্টায় ধরেছি, সাদা পোশাকের মহিলা কনস্টেবল দিয়ে হাতে নাতে ধরেছি, বাচ্চা ছেলে সব, নাকে টিপলে দুধ গলে, এক থাপ্পড়ে প্যান্ট ভেজায়, মাসি পিসি মানে না মশাই, এদের জ্বালায় শহরের মেয়ে বউরা পথে বেরোতে পারে না- সকাল থেকে শুরু করে অসভ্যতা, মুখে নোংরা ভাষা, কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি, হাতধরে টানাটানি, কু-প্রস্তাব, -কোথায় শিখলো বলুন তো? এরা সব ভদ্রবাড়ির ছেলে, শহরটাকে জঙ্গল বানিয়ে দিচ্ছে- ছ্যা ছ্যা, দিন দেখি বেশ দু’চার ঘা। দেখুন পুলিশ কেস দিলে লাইফের বারোটা বেজে যাবে, যা সব জানোয়ার তৈরি হয়েছে, সমাজের কলংক সব, কেসই দেওয়া উচিত; -ক্ষোভে ফেটে পড়েন বড় বাবু।
রজতের মাথায় বজ্রাঘাত হয়েছে- নাকি প্রবল জ্বর এলো- জ্বরের তাড়সে কাঁপছে শরীরটা- রুলটা দিয়ে হঠাৎ ভীষণ জোরে- জীবনে এই প্রথমবার বারি মারে পুকানের পিঠে, তারপর নিজের গায়ে। হাত থেকে রুলটা পরে গিয়ে গড়িয়ে যায় টেবিলের তলায়। প্রলাপের মত বলতে থাকে- মারুন, মেরেই ফেলুন ওকে- আমাকেও। ধপ করে বসে পরে পাশের চেয়ারটায়।
হাঁটু গেড়ে বসে পুকান দারোগার পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদছে- ‘আর মেরো না, কখনো করবো না।’
সোমা কি বধির হয়ে যাচ্ছে- নাকি অবাস্তব অলীক কোন দৃশ্য দেখছে- দুধের মত শুভ্র সেই ছোট্ট শিশু, সরু সরু আঙ্গুল, টুকটুকে লাল ঠোঁট, খালি ঘুমোয়, স্বপ্ন দেখে মিষ্টি করে হাসে। একটু বড় হতেই কুকুর, শালিখ, কাক, বিড়াল সবাইকে ‘বিক্কু দাও’, ‘বিক্কু দাও’- সোমা মনে মনে খুশ হয়েছে, বড় হলে ভালবাসবে সব্বাইকে ঠিক, অমিতাভ নাম রাখা সার্থক হবে। সোমার আঙ্গুল ধরেই বাইরের পৃথিবীতে প্রথম পা রেখেছিল তার আদরের ধন। পড়া, আঁকা, সাঁতার, গান, গীটার, মাধ্যমিকে স্টার- আর এখন, ছিঃ কী ঘেন্না- হে ঈশ্বর- এই শাস্তি কেন- কোথা দিয়ে কখন এই মরণব্যাধী?...
রজতের চোখের সামনে হঠাৎ যেন মায়ের অসহায় অবয়বটা দুলে ওঠে- বার্ধক্যের নির্জনতায় একজন মূক জড়সড়! অপরজন সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে সোনার আপেল বাগানে পৌঁছনের নির্দিষ্ট ট্র্যাকে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত- তাই কি এই দলবদ্ধ বিকৃত উল্লাস যাপন? এ্যাতো বিষ জমল কখন বোঝাই গেল না... এ্যাতো কাছে থেকেও...! সত্যি সত্যি কেউ কি কারো কাছে নেই আমরা। সম্পর্কের নামাবলির আড়ালে প্রকৃত সম্পর্কের সুতো কি তবে ছিঁড়ে গেছে... হারিয়ে গেছে.. আত্মীয়-সমাজ-দেশ সবার সাথেই?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ ভোর ৬:৪৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




