somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুইসাইড

৩০ শে জুন, ২০১২ রাত ১০:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার নাম জানার কোনো দরকার নেই। আমি অত্যন্ত নগন্য মানুষ। শুধু জেনে রাখুন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজে পড়ি। নতুন বছর মানে ২০১২ শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর আমি এক বন্ধুকে নিয়ে ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে আমি এমন একটা জিনিসের সন্ধান পাই যা আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল এবং আজও দেয়। জিনিসটা কোথায় পেয়েছিলাম তা আর বললাম না। জিনিসটা কেনই বা ওখানে কেউ ফেলে রেখেছিল তাও বলতে পারব না। জিনিসটা ছিল এক হতাশাগ্রস্ত ছেলের ডায়রি। সারা ডায়রি জুড়ে ছেলেটার হতাশা আর আক্ষেপের করুন সুর বেজে উঠেছিল। ছেলেটার হতাশাগুলোর সাথে আমারও বেশ কিছু হতাশার মিল খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু সেটা মূল বিষয় না। মূল বিষয় হল মানে আমি যেটা আপনাদের বলতে চাচ্ছি সেটা হল ডায়রিতে সর্বশেষ ছেলেটা কি লিখেছিল। ছেলেটা ডায়রিতে শেষ লেখাটা লিখেছিল নতুন বছর শুরু হওয়ার আগের রাতে মানে যে রাতকে আমরা থার্টি ফার্স্ট নাইট হিসেবে উদযাপন করি। ছেলেটা সেই রাতে ডায়রিতে যা লিখেছিল তা আমি হুবহু নিচে লিখে দিচ্ছি-

৩১ ডিসেম্বর, ২০১১। রাত ১১ টা।
আমার আর কিছুই ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এতদিন ধরে লালন করা জীবন নিমেষেই পুরোপুরি অর্থহীন মনে হচ্ছে। এত কষ্ট হচ্ছে যে মনে হচ্ছে কোনো দানব আমাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। এখন যদি কোনো কাছের বন্ধু বা প্রেমিকা আমার পাশে থাকত তাহলে কি এমন অনুভূতি হত? হয়ত না। কাছের বন্ধু আর প্রেম এ দুটাই আমার জীবনে তাসের ঘরের মত এসেছে আর ভেঙ্গেছে। কেন যে আমি এসব ধরে রাখতে পারি না আমি নিজেও জানি না।
আজ মনে হচ্ছে, সেটা যে কোন অশুভ ক্ষণ ছিল যখন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম! প্রথমে তো চান্স পেয়ে বেশ খুশিই হয়েছিলাম। বাবা মাও খুশি হয়েছিলেন বেশ। কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকে কি থেকে কি যে হয়ে গেল টেরই পেলাম না। শিক্ষকরা একেকজন দেড় দুই ঘন্টা ধরে ক্লাস নিতেন। আমার ক্লাসে মন বসত না। ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতাম আর বেশিরভাগ সময় ক্লাসে যেতামই না। হলে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতাম আর এক দুইজন বন্ধুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। পড়াশোনা করতাম না মোটেও। ভাবতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া তো কঠিন কিছু না। পরীক্ষার আগে পড়লেই হবে। তখন জানতাম না সেটা কতবড় ভুল ধারনা ছিল। এভাবে দেখতে দেখতে ছয়মাসের মধ্যেই পরীক্ষা হয়ে গেল। পরীক্ষা খুব খারাপ দিলাম। তিন বিষয়ে ফেল করলাম। আমাকে আবার প্রথম বর্ষেই থেকে যেতে হল। আমি ছোটবেলায় বেশ ভাল ছাত্র ছিলাম। ক্লাস টেন পর্যন্ত সবসময় ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম। তাই ইয়ার লসের ব্যাপারটা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হল। বেশ হতাশ হয়ে পড়লাম। বন্ধুদের সাথেও তেমন যোগাযোগ রাখলাম না। বুকে চরম হতাশা নিয়ে নতুন ছাত্রদের সাথে প্রথম বর্ষে আবার ক্লাস শুরু করলাম। আমি যেন একটা জিন্দালাশের মত হয়ে গেলাম। কারও সাথে কথা বলি না, কোনো দিকে তাকাই না, শুধু যেন কি এক ঘোরের মধ্যে একটার পর একটা ক্লাশ করে যাই। শিক্ষকদের লেকচারে আমি তখনও মনোযোগ দিতে পারতাম না। শিক্ষকরা প্রায় প্রতিদিনই আমাকে দাঁড় করিয়ে অপমান করত। খুব খারাপ লাগত, আমি সহজভাবে নিতে পারতাম না। ক্লাস শেষে আমি সোজা হলে গিয়ে শুয়ে পড়তাম। জোর করে পরতে চেষ্টা করেও পড়তে পারতাম না। মনের ভিতর শুধু হতাশা আর বিক্ষিপ্ত চিন্তাই ঘুরে বেড়াত। প্রতিটা দিন আমার জন্য যেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে লাগল। প্রতিটা দিনই চিৎকার করে কাদঁতে ইচ্ছা করত। কিন্তু কেন জানি কাদঁতে পারতাম না। এভাবে আবার ছয়মাস পর পরীক্ষা এসে গেল। আমি নগন্য প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিতে বসলাম। চোখ বন্ধ করে একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে গেলাম।
আর আজ সেই পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। হা! হা! এবার আমি তিন বিষয়ে না, চার বিষয়ে ফেল করেছি। এখন মনে হচ্ছে, কেন আমি পড়াশোনা করলাম না? কেন আমি সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিতে পারলাম না? কেন আমি অন্যদের মত জীবনটাকে ভোগ করতে পারলাম না? অনেক ভেবে দেখলাম, কোনো কূলকিনারা পেলাম না। সবই এখন ভাগ্যের নির্মমতা মনে হচ্ছে। মানুষ কিছু না পারলে ভাগ্যেরই দোষ দেয়। তবে আমি দেখেছি, ভাগ্যকেও মানুষ কখনই এড়িয়ে যেতে পারে না।
যাক, ফলাফলটা পাওয়ার পর বিভাগের চেয়ারম্যান আমাকে ডেকে নিয়ে বললেনঃ “তুমি তো শেষ। পর পর দুই বার কেউ ফেল করে? তোমার মত নির্বোধ তো আমি একটাও দেখি নাই...” উনার আর কোনো কথা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলাম উনার রুম থেকে।
ফলাফল পাওয়ার পর মা ফোন করে বললেনঃ “তুমি এটা কি করলা? তোমাকে নিয়ে আমাদের কত আশা ছিল! তুমি সব শেষ করে দিচ্ছো। তুমি আর বাসায় এসো না। তোমার বাবা তোমাকে ঘরে ঢুকতে দিবে না।”
এরপর আমি অনেকক্ষন কাদঁলাম। তবু মনে হল কান্নার একশ ভাগের এক ভাগও বের হয় নাই। সারাটা দিন শুধু চোখের কোণে পানি জমে থাকল। এখনও জমে আছে। এখন আমার মনে হচ্ছে সেটা যে কোন অশুভ ক্ষণ ছিল যখন আমি জন্মেছিলাম!
সবাই এখন নতুন বছরের উৎসবে মেতে আছে। হলের চারদিক থেকে শুধু হই চই শোনা যাচ্ছে। বন্ধুরা আমাকে নানারকম সান্ত্বনা দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি যাই নি। রাত বারোটার পর তাদের এই উৎসব আরও বাড়বে। সবাই ২০১২ আসার আনন্দে যেন পাগল হয়ে যাবে। আমিও বারোটার পর একটা জরুরি কাজ করব। সেটা হল, হলের ছাদ থেকে লাফিয়ে নিজের জানটা দিয়ে দিব। শুধু শুধু এ জীবন টেনে নেয়ার কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্য মৃত্যুকে নিয়ে ভীষণ ভয় হচ্ছে। মৃত্যুর পর কোন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে কে জানে। মানুষ বলে মৃত্যুর পর নাকি সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আসলেই কি তাই? এমন কি হতে পারে আমার আত্মা সবকিছু অনুভব করতে পারছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না? আর আত্মা অসীম যন্ত্রণা পেয়ে যাচ্ছে? তাহলে তো ব্যাপারটা অনেক ভয়ঙ্কর হবে। যদিও আমি ধর্মে বিশ্বাস করি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আসলেই কি পরকাল বলে কিছু আছে? নাহ, আর ভাবতেই পারছি না।
বারোটা বেজে গেছে। হলের নিচে ক্যাম্পফায়ার করে সবাই গান বাজনা আর হই চই করছে। আমি এখন ছাদে চলে যাব। আশা করি ছাদ থেকে পড়ার পর পরই আমার মৃত্যু হবে, আশা করি মৃত্যুর পর আমি চিরশান্তি পাবো। আমি যাচ্ছি, বিদায়। ডায়রিটা এখানেই থাকুক। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ..............
[ ছেলেটার নাম ছিল শফিক। এই লেখাটাই তার ডায়রির শেষ লেখা। শফিকের ডায়রিতে বিচিত্র কিছু লেখা আছে। সময় পেলে বা লেখার ইচ্ছা হলে আমি সেসব আপনাদের কাছে তুলে ধরব। যাই হোক, আমি শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নাকি অনেক উদার হয়, অনেক আনন্দের হয়। কিন্তু আমি জানতাম না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় শিক্ষক আর উদার পরিবেশ শফিকের মত ছেলেকে আত্মহত্যা থেকে রোধ করতে পারে না।]
১৩টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঘরে ফেরার টান

লিখেছেন স্প্যানকড, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৬:৩১

ছবি নেট।

তুমি মানে
সমস্ত দিনের ক্লান্তি শেষে
নতুন করে বেঁচে থাকার নাম।

তুমি মানে
আড্ডা,কবিতা,গান
তুমি মানে দুঃখ মুছে
হেসে ওঠে প্রাণ।

তুমি মানে
বুক ভরা ভালোবাসা
পূর্ণ সমস্ত শূন্যস্থান।

তুমি মানে ভেঙ্গে ফেলা
রাতের নিস্তব্ধতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বজলুল হুদাকে জবাই করে হাসিনা : কর্নেল (অব.) এম এ হক

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৯

মেজর বজলুল হুদাকে শেখ হাসিনা জবাই করেছিলেন।

(ছবি ডিলিট করা হলো)

শেখ মুজিবকে হত্যার অপরাধে ২৮শে জানুয়ারী ২০১০ এ মেজর (অব.) বজলুল হুদা সহ মোট ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মি. চুপ্পুর পক্ষ নিয়েছে বিএনপি-জামাত; কারণ কী?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩৬


বিএনপি গত ১৬ বছর আম্লিগের এগুচ্ছ কেশও ছিড়তে পারেনি অথচ যখন ছাত্ররা গণহত্যাকারীদের হটিয়েছে তখন কেন বিএনপি চু্প্পুর পক্ষ নিচ্ছে? অনেকেই বলছে সাংবিধানিক শুন্যতা সৃষ্টি হবে তার সংগে বিএনপিও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগারেরা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুমিয়াকে চান না, কিন্তু বিএনপি কেন চায়?

লিখেছেন সোনাগাজী, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৪



**** এখন থেকে ১৯ মিনিট পরে (বৃহ: রাত ১২'টায় ) আমার সেমিব্যান তুলে নেয়া হবে; সামুটিককে ধন্যবাদ। ****

***** আমাকে সেমিব্যান থেকে "জেনারেল" করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিকাহের পরিবর্তে আল্লাহর হাদিসও মানা যায় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪




সূরা: ৪ নিসা, ৮৭ নং আয়াতের অনুবাদ-
৮৭। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নাই। তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই। হাদিসে কে আল্লাহ থেকে বেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×