অনেকদিন ধরে ভাবি নিজের জীবনটা নিয়ে একটা বই লিখি, যখন ভাবি তখন প্রচণ্ড উৎসাহের সাথে কলমটা হাতে নিয়ে বসে পড়ি, কিন্তু ওই পর্যন্তই । আমি বা এমন কে যার কথা মানুষ পড়বে আর তার উপর যা লেখার ছিরি, কেউ তো পড়বেই না, পড়তে চাইলেও ভাষার মাধুর্যে হোঁচট খেয়ে আর এ পথ মারাবে না । নিজের উপর এমন আত্ম বিশ্বাস নিয়ে তাও কেন যে লিখতে বসেছি নিজেই বুঝতে পারছিনা । যাই হোক....
ছোটবেলায় , মানে যখন আমার বয়স এই প্রায় বছর ছয়েক হবে আর আপুর বারো , আম্মাকে একদিন কাক ডাকা ভোরে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল । ব্যাপারটা তেমন কিছুনা , আমার আরেকটা ভাই বা বোন হবে, এই । সবাই চলে যাওয়ার পর দেখি আপুও কেমন যেন চিন্তিত মুখ করে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে । আমার লাগছিল চরম বিরক্তি । আমার আর ভাই বোনের মোটেও কোন শখ নাই । এতদিন সবার মধ্যমণি হয়ে ছিলাম আমি আর এখন কিনা কোথা থেকে উড়ে এসে আমার স্থানটায় জুড়ে বসবে এক পিচ্চি । কোনো ভাবেই মানতে পারছিলামনা ব্যাপারটা । যাইহোক, বাসায় আমরা দুজন একলা, পাশের বাসা থেকে জিনতু কাকি এসে আমাদের দুপুরের খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়ে গেছে । বাসা থেকে বের হওয়া নিষেধ , বসে আছি তো আছিই , সে এক বিশাল অপেক্ষার পালা , শেষে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এলো কিন্তু আম্মার কোনো খবর নেই । সেইসময় অনেকের হাতে হাতেই মোবাইল ঘুরতো কিন্তু আমাদের বাসায় এর প্রচলন তখনো হয়নি , তাই আমি আর আপু একেবারে অন্ধকারের মধ্যে বসে বসে প্রহর গুনছি । লোডশেডিং -এর নিস্তব্দ্ধতাকে ছাপিয়ে ঝি ঝি পোকার তীক্ষ্ণ কর্কশ ডাকটা কেমন যেন নেশা ধরা । সেটা শুনতে শুনতে আপুর কোলে শুয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল করিনি । ঘুম ভাঙল এক প্রচণ্ড ধাক্কায়, ধড়মড় করে উঠে বসলাম , আপুও দেখি লাল লাল চোখে আব্বার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে , কি হল কিছুই বুঝতে পারছিলামনা । ঘুমের ঘোর কাটতেই হঠাৎ খেয়াল করলাম শোয়ার ঘর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে । বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো , এক অশুভ আতঙ্কে কুঁকড়ে গেলাম । নিশ্চয়ই আমার ভাই বা বোনটা বেঁচে নেই , আমি চাইনি ও হোক , এজন্যই বোধহয় কিছু হয়েছে । আব্বা ওই ঘরে যেতে বলল আমাদের দুজনকে । আপু আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো । জোরে জোরে টানতে লাগলো , আমি ভয়ে যেতে চাচ্ছিলাম না , যদি বুঝে ফেলে আমার দোষ । আম্মাকে সরি বললেই কি হবে , সরি বললেই কি আমাকে মাফ করে দিবে , অন্যায় করে সরি বললে আম্মা আগে যেমন আদর করে কোলে টেনে নিয়ে চুমায় চুমায় ভরায় দিত ওরকম যদি না করে -- নানা আশঙ্কা মনের মধ্যে খেলে যাচ্ছিল । ভয়ে ভয়ে যখন শোয়ার ঘরে পৌছালাম তখন দেখলাম আম্মা খাটের উপর ঘুমিয়ে আছে আর চারদিক ঘিরে পরিচিত অপরিচিত কয়েকজন মহিলারা কাঁদছে । আপু হঠাৎ আম্মাকে জরিয়ে ধরে আম্মা আম্মা বলে ভীষণ জোরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো । আমি অবাক হয়ে দেখলাম এত জোরে শব্দ করার পরও আম্মার ঘুম ভাঙছে না ।
আম্মার ঘুম আর ভাঙল না । পরেরদিন আম্মাকে মাটির নিচে শুইয়ে দিয়ে আসা হল । আম্মা কেমন হঠাৎ করেই নাই হয়ে গেল । কতবার মনে হয়েছে আম্মার গলা শুনতে পেয়েছি , আমাকে ডাকছে , " আয় মামনি এদিকে আয় ।"" আয় সোনা আমার ।" ছুটে গেছি, বারবার বারবার ছুটে গেছি । তারপর হঠাৎই একদিন থেকে আর যাইনি । আম্মার কণ্ঠ শুনলে কান চেপে ধরেছি । ধিরে ধিরে আম্মার কণ্ঠটা মলিন হতে হতে একদিন মিলিয়ে গেল ।
...... চলবে