ঢাকা শহর থেকে এখানকার দুরত্ব শুধু নদীর এই পার আর ঐপার। তখনও জিঞ্জিরা নকল প্রসাধনীর জন্য এতটা বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে উঠেনি। শহরের এত কাছে থেকেও এ যেন বাংলাদেশের অন্য আট দশটা গ্রামের মতই। সবুজ শ্যামল ছায়ায় ঘেরা, যন্ত্রদানবের কর্কশ চিৎকারহীন শান্ত স্নিগ্ধ সৌম্য একটা পরিবেশ।
সামনে বছর আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা। রাত জেগে পড়ি। এর পর ফজরের নামাজ সেরে কিছু একটা মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ ঘুম। রাতে কুপির আলোয় ভারিদিকে একটা ভৌতিক পরিবেশ থাকে। শান্তিতে পড়ার জন্য আমার ঘরটা আলাদা করা। দুরত্ব খুব সামান্যই, কিন্তু ঘুটঘুটে আধারে সেই দুরত্বই অনেক মনে হয়। অবশ্য রাতের জোনাকি কিংবা নিশাচর পাখি আমার এই আধার রাতের সঙ্গি হয়। তবে বাইরের জগতের সাথে একমাত্র যোগাযোগ সবেধন নীলমণি জানালাটা খুলি না। পাছে কৌতুহলে তেনারা উকি দেন।
সেই রাতটি ভেবেছিলাম এমন নিঃশব্দ নিস্তব্ধটায় কাটবে। কিন্তু মাঝ রাতে বহুদুর থেকে এক গাদা চিৎকার ভেসে আসায় বিদ্যাদেবির আরাধনায় খানিকটা ব্যাঘাতই ঘটলো। খানিকটা বিরক্ত হলাম। কিছুদিন আগে বাব গত হয়েছেন। যৌথ পরিবারের ছায়ায় থাকায় সাময়িক স্বস্তি আছে বটে, কিন্তু এতিম এই ছেলেটির পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরা খুব জরুরি যে। তাছাড়া দ্রুত বড় হতে থাকা বোনটির গতি না করতে পারলে সমাজে ছি ছি পড়ে যাবে।
জীবনের এই প্রথম বুঝি এমন একটা সাহসের কাজ করলাম। হাতে কুপি নিয়ে দরজা খুলে বাইরে এলাম, বেশ নিঃশব্দেই। পাছে ঘরের কেউ জেগে যায়। তাছাড়া রাত বিরেতে ঘুরে বেড়ানো তেনাদের মনযোগ আকর্ষনের কোন ইচ্ছাই আমার নেই। অজস্র চিৎকার ধবনির শব্দটা একটু বেশি মনে হলো। উৎস নদীর ওপার, ঢাকা শহর থেকেই আসছে। আন্দাজ করলাম সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালইয় আর তার আশা পাশ থেকেই আসছে। আকাশে দেখলাম লাল নীল হলুদ কত রঙ্গিন আলোর খেলা। সেই সাথে বাজি ফুটবার মত শব্দ। নিশ্চই পাকিস্থানের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর সব প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। আর তাই উল্লাসে ফেটে পড়েছে জনতা। সে আনন্দেই তাই আকাশে হাউই উড়িয়ে বাজি ফুটিয়ে রাতের নিঃস্তব্ধতাকে চিরে দেয়া হচ্ছে।
মনটা আনন্দে ভরে গেলো। যাক বাবা, বাচা গেলো। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা, ভয়, প্রতিদিনের মিছিল মিটিং, গুরুজনদের ফিসফিসানি, বন্ধুবান্ধবের বদলে যাওয়ার অবসান হলো অবশেষে। তাই আবারো ঘরে ঢুকে বিদ্যাদেবিতে মন লাগালাম। কিন্তু কেন জানি না মনটা বেশ খুত খুত করতে লাগলো।
মসজিদের ইমাম সাহেব নামাজ পড়াতে যান আমার এই ঘরটির পাশ দিয়েই। যাবার সময় সামান্য কাশি দিয়ে যান, উদ্দেশ্য আমাকে নামাজের কথাটা মনে করিয়ে দেয়া। আজও তার কাশি শুনে বই পত্র গুছিয়ে রাখলাম। আকাশ তখন সবে মাত্র ফর্সা হতে শুরু করেছে। আতজবাজির সেই খেলা আর চিৎকার চেচামেচি সব রাত্রির আধারেই ইতি হয়েছে। আমার ঘরে একটা কলসিতে পানি আর বদনা থাকে। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে অজু করে রওয়ানা দিলাম মসজিদের দিকে। কুয়াশাভেজা মেঠো পথ ধরে খানিকটা আগালেই পুকুর। তার ঠিক পাশে রাস্তা থেকে কিছুটা উচু জমির উপর অনেকদিন আগে বানানো মসজিদ। পুকুর ঘাটের আলো আধারে দুজন মানুষের মত মুর্তিকে বসে থাকতে দেখে পা দুটো নিজ অজান্তেই থেমে গেলো। আতংকিত আমি কতক্ষন ও রকম ছিলাম জানি না, তবে নামাজ পড়তে আসা আরো কয়েকজনের উপস্থিতি টের পেয়ে সম্বিত ফিরে পেলাম। সবাই ওই মুর্তি দুটির দিকেই তাকিয়ে। নিজেদের ভেতর গুঞ্জন শুরু হলো। এর মধ্যে দেখলাম সাহসি একজন এগিয়ে গেলো ওদের দিকে। পেছনে পেছনে আমরা কয়েকজন।আরেকটু কাছাকাছি যেতেই দেখি খাকি হাফ প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি পড়া চুল ছোট দুজন উদ্ভ্রান্ত মানুষ। দুজনেরই ভেজা শরির। একজনের শরিরে লাল কিছু একটা। সেই সাহসি মানুষটাই প্রথমে কথা বললো।
" কে আপনারা? এখানে কি চান?"
সেই মানুষ দুটোর একজন উত্তর দিলো, " আপনারা কিছু জানেন না? শোনেননি কিছু?"
অজানা আশংকায় আমার বুকটা ছ্যাত করে উঠলো, কি শুনবো কি জানবো? সেখানে উপস্থিত মুসল্লিরা একে অন্যের দিকে তাকালো। কেউ কিছু শোনেনি। আমাদের নিরবতায় সেই মানুষটি নিজের মনেই বল উঠলো "ঢাকা শহরের সবাই শেষ। সব শেষ করে দিয়েছে।"
তার কথা গুলি যেন অনেক বেদনায় ডুকরে কাঁদার মত মনে হলো। ততক্ষনে আরো কিছু মানুষ আশে পাশে জড়ো হল। সবাই জানতে চাইলো কি ঘটেছে? সেই মানূষ দুটো বললেন তারা সদরঘাটের ফায়ার সার্ভিসের দমকল কর্মি। গতরাতে পিলখানা রাজাবাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মডদা কথা পুরো ঢাকা শহরেই পাকিস্থানি আর্মি যাকে যেভাবে পেয়েছে গুলি করে হত্যা করেছে। ফায়ার স্টেশনটিতেও ওরা হামলা করে ঘুমন্ত কর্মিদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। ওরা দুজন কোন মতে নদী সাতরে জীবন বাচিয়ে এ পারে এসেছে। তবে একজন সঙ্গির পায়ে গুলি লেগেছে।
" মিলিটারি এ পারেও আসতে পারে। জীবন বাচাতে চাইলে যত জলদি সম্ভব পালান", একথা বলে আহত সঙ্গিকে নিয়ে অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিলেন ওই দুজন।
সবাই স্বম্ভিত। সবাই যেন মুক বধির। অজানা আশংকায় সবাইকেই যেন ঘিরে রেখেছে। কি হবে এখন? কি করবো আমি? কোথায় যাবো? বড় বোনটির শশুর বাড়ি যে পুরানো ঢাকায়। ডুকরে কাদতে ইচ্ছা হলো, দৌড়ে ছুটে গেলাম বাড়িতে। মাগো ও মা বলে চিৎকার করে বাড়িশুদ্ধ লোককে সেই সাত সকালে ঊঠিয়ে দিলাম। সবার দৃস্টি আমার দিকে। ডুকরে কেদে কোনমতে গতকালের সেই ভয়াল রাতের কথা সবাইকেই জানালাম। চাচা চাচি, ছোট চাচা, মা, ছোট ছোট ভাইবোন সবার চেহারায় তখন একটিই প্রতিচ্ছবি। সেটা মৃত্যুভয়ের, আতংকের, অজানা গন্তব্যের।
(জিঞ্জিরাবাসি একজন সাধারণ মানুষের মুখে শোনা এই ঘটনা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিলাম। উৎসর্গ করলাম, সেদিনের ঘটনায় নিহত নাম না জানা অসংখ্য শহিদের প্রতি)।