
তীব্র সাম্প্রদায়িক ছাপ বিশিষ্ট এমনি একটি চিঠি সাইক্লোষ্টাইল করে যাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল তাদের প্রায় সকলকেই হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীনতার ঊষালগ্নে। পাক বাহিনী আত্মসমর্পনের পূর্বে তাদের দোসর আল-বদররা স্বাধীন বাংলাদেশ যেন সামাজিক ও মানসিকভাবে বিবেকবান হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি হত্যার যে সুপরিকল্পনা করেছিল তারই নজীর উপরের চিঠিখানা।
দালালরাই নয়, বিংশ শতাব্দীর কলঙ্ক স্বয়ং টিক্কা খানও একটি ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি দিয়েছিলেন ডঃ নীলিমা ইব্রাহীমকে। চিঠিখানার অনুবাদ ছিল এমন
“ মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারস্
জোন ‘বি’
ঢাকা।
আমি, লেঃ জেঃ টিক্কা খান, এইচ. জি. এ. এইচ. পিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাধ্যক্ষ হিসেবে বাংলা বিভাগের ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি যে তুমি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করবে না।
লেঃ জেঃ টিক্কা খান
সামরিক আইন প্রশাসক
স্থান- ঢাকা
তারিখ- ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ”
শুনা গিয়েছিল শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকেও এ ধরনের চিঠি দেয়া হয়েছিল।
দেশ স্বাধীনের পর বুদ্ধিজীবি হত্যাকারী জল্লাদ আল-বদর বাহিনীর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খানের ডায়েরী থেকে কতগুলো চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ধার করা হয়। এই জল্লাদ স্বহস্তে গুলি করে সাতজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে মিরপুরে হত্যা করেছে। যে গাড়ীতে শহীদ শিক্ষকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার ড্রাইভার মফিজউদ্দিন এই জবানবন্দী দেয় পুলিশের কাছে।
ডায়েরির দুই পৃষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯জন বিশিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষিকা ও চিকিৎসকের নাম-ঠিকানা লেখা রয়েছে। নিচে তার স্কেন কপি দেয়া হল।

উল্লেখ্য যে, এই বিশ জনের মধ্যে ১৪ই ডিসেম্বর আটজন নিখোঁজ হন। তাঁরা হলেন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা), অধ্যাপক আনোয়ার পাশা (বাংলা), ডঃ আবুল খায়ের (ইতিহাস), অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস), অধ্যাপক রশিদুল হাসান (ইংরেজী), ডঃ ফয়জুল মহী (শিক্ষা ও গবেষণা) ও ডঃ মর্তুজা (চিকিৎসক)।
তবে উক্ত ডায়েরিতে নিখোঁজ অধ্যাপক সন্তোষ ভট্রাচার্য (ইতিহাস) ও অধ্যাপক সিরাজুল হক খান (শিক্ষা ও গবেষণা)- এই দুজনের নামোল্লেখ নাই।
এছাড়াও উক্ত ডায়েরিতে যাদের নাম ছিল তারা হলেন- জনাব ওয়াকিল আহমেদ (বাংলা), ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম (বাংলা), ডঃ লতিফ (শিক্ষা), ডঃ মুনিরুজ্জামান (ভূগোল), জনাব সাদউদ্দিন (সমাজতত্ত্ব), জনাব এ. এম. এম. শহীদুল্লাহ (গণিত), ডঃ সিরাজুল ইসলাম (ইসলামের ইতিহাস), ডঃ আখতার আহমেদ (শিক্ষা), জনাব জহিরুল হক (মনস্তত্ত্ব), জনাব আহসানুল হক (ইংরেজী), ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজী) এবং বাংলা একাডেমীর পরিচালক জনাব কবির চৌধুরী।
উক্ত ডায়েরির আরেকটি পৃষ্ঠায় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো ষোল জনের নাম, যার মধ্যে একটি হচ্ছে পাক হানাদার বাহিনীর দালাল ডঃ মোহর আলী। আশ্চার্যের বিষয়, ঐ ষোল জনের কেউই নিখোঁজ হয়নি।
এছাড়াও ডায়রীতে জল্লাদ বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মইনুদ্দিন, অপর কমান্ডার শওকত ইমরান, সিটি বদর বাহিনীর প্রধান শামসুল হকের নাম উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও হত্যাযজ্ঞের নায়ক ব্রিগেডিয়ার বশির ও ক্যাপ্টেন তাহের সহ বহু সংখ্যক দালালের নাম রয়েছে।
ডায়েরির এক জায়গায় জুট বোর্ডের ফাইন্যান্স মেম্বার জনাব আব্দুল খালেকের নাম, পিতার নাম, ঢাকার ঠিকানা, গ্রামের ঠিকানা সব লেখা ছিল। জনাব খালেককে ৯ই ডিসেম্বর অফিস থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। শুধু তাই নয়, এই হত্যাকারী দৈনিক পূর্বদেশের শিফ্ট ইন চার্জ ও সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক জনাব আ.ন.ম. গোলাম মোস্তফাকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ডায়রীর তথ্য অনুযায়ী জল্লাদটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল।
এছাড়াও জামালপুর ইসলামী ছাত্র সংঘের নরপিশাচ মোঃ আবদুল বারীর ডায়রীতে বাংলা, ইংরেজী কিংবা সাংকেতিকভাবে নৃশংসতার কাহিনী পাওয়া যায়। যেমন- “ টাঙ্গাইলে Successful Operation হয়েছে। হাজার দেড়েকের মত মুক্তিফৌজ মারা পড়েছে আল-বদর ও আর্মিদের হাতে।” কিংবা “ ১. Haider Ali, ২. Nazmul Haque RS. 25000.00 তিতপল্লার শিমকুড়া গ্রাম- জব্বারের কাছ থেকে ২৯/১০/৭১ (তারিখে) আরো তিন হাজার নেয়ার পরিকল্পনা আছে। ইত্যাদি।” ইসলামের লেবাসধারী এই ঘাতকদের জঘন্য চরিত্রের পরিচয় মেলে আরো দুটি পাতার উদৃতিতে ঃ
"26-10-71.... Prostitution Quarter......."
"29-10-71....... Raping case...... Hindu girl"
তথ্যসুত্র ঃ বাংলাদেশে গনহত্যা- ফজলুর রহমান (প্রকাশকাল নভেম্বর ১৯৭২)
দৈনিক অবজার্ভার, ২১শে ডিসেম্বর, ১৯৭১
দেশ ঃ ৩৯ বর্ষ-১৩ সংখ্যা, পৃঃ ১২৮৩
দৈনিক পূর্বদেশ, ২৭শে পৌষ, ১৩৭৮
দৈনিক ইত্তেফাক, ১০ই মার্চ, ১৯৭২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


