বউ রান্না করছে। এরই এক ফাঁকে লুকিয়ে খাবারের সঙ্গে সাবান মিশিয়ে দিয়ে এসেছেন শাশুড়ি। ছেলে সে খাবার মুখে দিয়ে প্রায় বমি করে ফেলছে। ভর্ৎসনা করছে স্ত্রীকে। আড়াল থেকে দৃশ্যটি দেখে মিটিমিটি হাসছেন শাশুড়ি। এটি ভারতীয় একটি টিভি সিরিয়ালের গল্প। একে অন্যকে অপদস্থ করার এমন বহু কল্পকাহিনী প্রতিনিয়ত উপহার দিচ্ছে এসব সিরিয়াল। বাংলাদেশের গৃহিণীরা কাজ ফেলে দিনরাত এগুলো দেখছেন। অন্যরা হিন্দী চলচ্চিত্র, আইটেম সঙ আর ইংলিশ মুভি ও মিউজিক চ্যানেল দেখে দেখে রাত ভোর করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সঙ্গীত, নাটক, সিনেমায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ভিনদেশী সংস্কৃতি। বহুকালের অপচর্চা বন্ধে জরুরী উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন দেশের শিৰাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীসহ বিশিষ্ট জনেরা।
বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতীয় টিভি সিরিয়ালে এক রকম আক্রান্ত বাংলাদেশের গৃহিণীরা। স্টারপস্নাস, সনি, জিটিভি, জি বাংলা, ইটিভি বাংলাসহ অধিকাংশ চ্যানেল ঘটা করে এসব সিরিয়াল দেখাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশেষ করে স্টারপস্নাস থেকে চোখ একেবারেই সরাতে পারেন না বাংলাদেশের নারী ও টিনেজ মেয়েরা। এ চ্যানেলে প্রতিদিনই প্রচারিত হয় একাধিক ধারাবাহিক। বর্তমানে চলছে 'সসুরাল গেন্দা ফুল', 'ইয়েহ রিশতা ক্যা কেহ রাহে', 'সাথ নিভানা সাথিয়া' ও 'প্রতিজ্ঞা'সহ বেশ কয়েকটি সিরিয়াল। সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত পালাক্রমে এগুলো দেখানো হয়। চলে সারা দিন। সমসত্ম রাত ধরে। একটি সিরিয়াল শেষ ও অন্যটি শুরু করতে নেয়া হয় মাত্র আধঘণ্টার বিরতি। দর্শকদের রিভিশনের সুযোগ করে দিতে মাঝখানের দুই দিন শনি ও রবিবার রাত সাড়ে ৮টায় দেখানো হয় প্রচারিত সিরিয়ালের বিশেষ পর্ব। এ আয়োজনটিকে স্টারপস্নাসের তরফে বলা হয়_ মহোৎসব। আর এ উৎসব-মহোৎসবের প্রধানতম শিকার এখন বাংলাদেশ। এসব সিরিয়ালে চোখ রেখে দেখা যায়, প্রায় সব ক'টিতেই পারিবারিক কলহের চিত্র। নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্যে ভর করে আছে হিংসা, দ্বেষ, চাতুর্য, অন্যের অনিষ্ট করার চিনত্মা, অপদস্থ করার কৌশল, ব্যবসা কেড়ে নেয়া, সংসার ভেঙ্গে দেয়ার চক্রানত্ম, পরকীয়া ইত্যাদি। বর্তমানে বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় 'সাথ নিভানা সাথিয়া' সিরিয়ালটিতে দেখা যায়, মা কোকিলার পছন্দে ছেলে এহেম বিয়ে করেছে বটে, তবে স্ত্রী গোপীকে তার সহ্য হয় না। সে গোপীর মামি ও মামাত বোনদের প্ররোচনায় স্ত্রীকে প্রতিমুহূর্তে অপদস্থ করার চেষ্টা করে। তাদের লাঞ্ছনাগঞ্জনায় কোণঠাসা গোপীকে দেখে 'ইস্' 'আহা' করছেন বাংলাদেশের দর্শক। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের এমন অনেক দর্শকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা গোপীকে নিয়ে দারম্নণ উদ্বিগ্ন থাকেন সব সময়। তার কষ্টে কেঁদে ফেলেন। আর গোপীর মামাত বোন রাশীকে গাল দেন 'ডাইনী' বলে। 'প্রতিজ্ঞা' সিরিয়ালটিতে স্বামী বেচারা স্ত্রীকে খুব ভালবাসেন বটে। কিন্তু সমস্যা শাশুড়ি। ছেলের বউয়ের শানত্মি কি করে নষ্ট করা যায় সে চিনত্মা মাথায় নিয়ে রাতে ঘুমাতে যান তিনি। রিমোট চেপে কলকাতার চ্যানেল জি বাংলায় এসে দেখা যায়, 'কন্যা' নামের একটি সিরিয়ালে শাশুড়ি বড্ড ভাল। কিন্তু ছেলের বউ সমস্যা। সাম্প্রতিক একটি পর্বে শাশুড়িকে বউ বলছিলেন, 'শাশুড়ি মা কখনও নিজের মা হতে পারে না।' ইটিভি বাংলার '১৬ আনা' সিরিয়ালে বউকে ফের ইতিবাচক চরিত্রে দেখা গেল এবং যথানিয়মেই খারাপ শাশুড়ি। তিনি ছেলের বউকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন। যাওয়ার সময় বউকে গয়না সঙ্গে নিয়ে যেতে বলে পরৰণেই ছেলেকে বলছেন, থানায় স্ত্রীর বিরম্নদ্ধে চুরির মামলা করতে। একই চ্যানেলের 'বিনি্ন ধানের খই' সিরিয়ালে স্ত্রী মহান; মন্দ শাশুড়ি। এতে দেখা যায়, গুরম্নতর অসুস্থ স্বামীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন স্ত্রী। কিন্তু শাশুড়ি ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছেন হাসপাতালে এসে। বলছেন, এ মেয়ে আমার ছেলেটাকে শেষ করে দিল। চ্যানেলটির অন্য ধারাবাহিক 'দেবী বরণ'-এ চলছে পরিবারের কর্তৃত্ব কার হাতে থাকবে সে নিয়ে সংঘাত। 'রানী মা' হতে একে অন্যের ধ্বংস কামনা করছেন প্রতিনিয়ত। এসবের বাইরে সিরিয়ালগুলোতে নিয়মিত বিপণন করা হচ্ছে পরকীয়া প্রেমসহ নানা অপসংস্কৃতি। বিশেস্নষকদের মতে, এভাবে নানা জটিলতা জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মনে। তাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে ছন্দপতন ঘটাচ্ছে। এরপরও সিরিয়ালের দর্শক আরও বাড়াতে চলছে নানা প্রচার। রাজধানীসহ প্রধান প্রধান শহরে এসব সিরিয়ালের বিজ্ঞাপনসংবলিত বিলবোর্ডও এখন নিয়মিতই চোখে পড়ে।
এদিকে এরও বহু আগ থেকেই ভারতীয় বাণিজ্যিক ছবির রমরমা বাজার বাংলাদেশ। বলিউডের কোন ছবি মুক্তি পাওয়ামাত্রই তা ডিভিডি হয়ে এ দেশে ঢুকে পড়ে। সচেতন দর্শকদের মতে, এসব ছবি প্রায়শই ভাল নির্মাণ হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ চলচ্চিত্র মুনাফা নিশ্চিত করতে নগ্নতাকে পুঁজি করছে। নাচ, গান, সমুদ্র সৈকতে স্নান, নাইট ক্লাব, ড্যান্স বার ইত্যাদির আড়ালে মূলত নগ্নতা বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে 'আইটেম সঙ' নামের পণ্যটির কবলে এখন বাংলাদেশের যুবসমাজ। এসব গানে স্বল্পবসনা মেয়েরা নাচের নামে যৌন সুড়সুড়ি দেয়ার কাজ করে। মেয়েদের চারপাশে নাচে কামুক পুরম্নষের দল। রগরগে এসব দৃশ্যসংবলিত নাচগান ভারতের মিউজিক চ্যানেলগুলো বার বার প্রচার করে সারাবিশ্বে নতুন বাজার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। পরে নতুন এ বাজারে দলবল নিয়ে সশরীরে উপস্থিত হন বলিউড তারকারা। অতিসম্প্রতি এ বেচাকেনা শুরম্ন হয়েছে বাংলাদেশেও। চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর আর্মি স্টেডিয়ামে এ ধরনের প্রথম অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। উন্মুক্ত এ আয়োজনে অংশ নেন শাহরম্নখ খান, রানী মুখাজর্ী, অর্জুন রামপাল, অইটেম গার্ল শেফালীসহ শতাধিক সদস্যের নৃত্যদল। এর কয়েক মাস পর দ্বিগুণ উৎসাহে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয় সালমান খান, ক্যাটরিনা, অৰয়ের অংশগ্রহণে বিশেষ নাচগানের অনুষ্ঠান। উভয় আয়োজনেই ভারতীয় তারকারা খোলামেলা পোশাকে দর্শকদের সামনে আসেন। নিজেরা নাচেন। দর্শকদের নাচান মধ্যরাত অবধি। লাখ লাখ টাকায় টিকেট কিনে এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করে নিম্নআয়ের বাংলাদেশ।
ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, যে জায়গাটায় এসে থামে হিন্দী চলচ্চিত্র ও এর তারকারা, ইংলিশ মুভি ও মিউজিক চ্যানেলগুলো শুরম্ন করে সেখান থেকেই। বড়দের অনেকেই এসব চ্যানেল দেখে রাত ভোর করেন। সকাল থেকে দিনের বাকি সময়টাকে বেছে নেয় বাসায় বেশি সময় থাকা অপেৰাকৃত কম বয়সী ছেলেমেয়েরা। কৌতূহলের ষোলোকলা পূর্ণ করতে এসব চ্যানেলে লুকিয়ে চোখ রাখছে তারা। ভুল করে রিমোটের বাটন চেপেও এসব দৃশ্যে চলে যেতে পারে এমনকি শিশু-কিশোররা। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পাশ্চাত্যের সমাজ ও পারিবারিক জীবনের বাসত্মবতায় নির্মিত চলচ্চিত্র ও পর্নো ফিল্ম বাংলাদেশের তরম্নণ-তরম্নণীদের ভেতরের কামনাবাসনাকে অযাচিতভাবে উসকে দিচ্ছে। একইভাবে ৰতি করছে স্থানীয় কেবল অপারেটরদের দ্বারা পরিচালিত ভিডিও চ্যানেলগুলো। এসব চ্যানেলে সকাল, বিকেল বা রাত যখন খুশি পর্নো ছবি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা এসব দেখছে। পর্নোগ্রাফি তো বটেই, এ চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলোও হয় চূড়ানত্ম রকমের অরম্নচিকর, অশস্নীল।
এদিকে আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পোশাক এবং ফ্যাশনেও। বাঙালী নারীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি। কিন্তু এর প্রতি তাদের আগ্রহ দিন দিন কমছে। উৎসবে-পার্বণে শাড়ি পরলেও কাজটিকে তারা এ্যাডভেঞ্চার ভাবতেই বেশি পছন্দ করে। শাড়ি পরা উপলৰে বাসায় পড়শীদের ডেকে জড়ো করে। যেন অদ্ভুত কোন কা- ঘটতে যাচ্ছে। আর যারা নিয়মিত পরেন তাদের পছন্দ আবার 'ক্যাটরিনা', 'কারিনা' নামের শাড়িগুলো। হিন্দী ফিল্ম বা সিরিয়ালে দেখানো অতিরিক্ত চাকচিক্যময় ভারতীয় এসব শাড়ি কিনতে ভিড় লেগে থাকে অভিজাত মার্কেটগুলোতে। রাজধানীর পিঙ্ক সিটি, শপার্স ওয়ার্ল্ড, বসুন্ধরা সিটি, ইস্টার্ন পস্নাজা, রাপা পস্নাজা, নিউমার্কেটসহ নামীদামী শপিংমলগুলো ঘুরে দেখা যায়, এসবের বিশাল অংশ জুড়ে আছে ভারতীয় শাড়ি, থ্রিপিস, লেহাঙ্গাসহ বাহারি সব পণ্য। নিউমার্কেটে দুটি দোকানের মালিক শাহাদাত হোসেন জানান, এটি তাদের অনেক পুরনো ব্যবসা। বহু বছর ধরে তিনি দেশীয় শাড়ি বিক্রি করে আসছেন। কিন্তু এখন মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশের শাড়ি ভারতের বলে বিক্রি করতে হয়। তিনি জানান, মানের দিক থেকে বাংলাদেশের শাড়ি এখনও অনেক এগিয়ে কিন্তু এরপরও বিদেশেরটা কিনতে বেশি আগ্রহী এখন মহিলারা। নায়িকাদের নামে নতুন কোন শাড়ি বা জামা আসামাত্রই বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। শহরের মেয়েদের গায়ে যত জামা এখন দেখা যায় এসবের অধিকাংশই পাশর্্ববতর্ী দেশ থেকে আসা বলে জানান তিনি। দেশীয় মোটিফের শাড়ি বা জামার পরিবর্তে হিন্দী সিরিয়ালে দেখানো জামা পরে টেলিভিশন স্ক্রিনে উপস্থিত হতে বেশি ভালবাসেন দেশীয় তারকারা। সংশিস্নষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব জামা ছাড়া বড়লোকদের অনেকেরই ঘরে ঈদ হয় না। মিরপুরের ঐতিহ্যবাহী বেনারসি পলস্নী ক্রেতাশূন্য পড়ে থাকে। অথচ বিয়ের সওদা করতে দল বেঁধে কলকাতায় ছোটেন মধ্যবিত্ত ঘরের বউ-ঝিরাও। টিনেজ মেয়ে ও তরম্নণীদের বড় একটি অংশ আবার পাশ্চাত্যের পোশাকে অভ্যসত্ম। তাদের পছন্দ জিন্স, ফতুয়া, শর্ট কামিজ, বিভিন্ন ধরনের টপস, শার্ট, টি-শার্ট, স্কার্ট, শর্টস ইত্যাদি। এদের কাউকে জিন্স ও শর্টসের সঙ্গে টি-শার্ট পরতে দেখা যায়। কেউ কেউ জিন্স বা নরমাল প্যান্টের সঙ্গে ফতুয়া বা শর্ট কামিজ পরছেন। জামার ওপর দিয়ে বেল্ট পরতেও দেখা যায় অনেককে। তবে যাই পরিধান করম্নক, এখন নিজের ফিগার তুলে ধরার ব্যাপারটিকে গুরম্নত্ব দেন নারীরা। তাদের প্রায় সব পোশাকই গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। এ কারণে শাড়ি পরার পরিচিত ঢঙটিও পাল্টে গেছে। পোশাক ও ফ্যাশনে অপসংস্কৃতি লালন করছেন তরম্নণরাও। গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানম-িসহ রাজধানীর যে কোন পাড়ামহলস্নায় চোখ রাখলেই দেখা যায়, অনেক তরম্নণের মাথার চুল সজারম্নর কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাবার থাক বা না থাক, ছেলের চিবুকের নিচে যত সামান্য দাড়ি। কায়দা করে জুলফি কাটা। গায়ে চাপানো টি-শার্টে হা করে আছে ড্রাগন। গলার চেনে লকেট হয়ে ঝুলছে বেস্নড, চাইনিজ কুড়াল, পায়ের স্যান্ডেল, কফির মগ ইত্যাদি। মাথায় ক্যাপ উল্টো করে পরা। কোয়ার্টার প্যান্ট, পায়ে কেডস আর হাতে কোমরের বেল্টের মতো মোটা বেল্ট, তাতে ঘড়ি বাধা। হিপহপ নামের ভিনদেশী এ ফ্যাশন এখন ঢাকার অলিতেগলিতে। কেউ কেউ আবার প্যান্ট পরার কায়দাকানুনও বদলে নিয়েছেন। দীর্ঘকাল ধরে কোমরের যে জায়গায় প্যান্ট পরা হয়ে আসছিল সেখান থেকে হঠাৎ করেই বেশ কয়েক ইঞ্চি নিচে নেমে এসেছেন তারা। গায়ে শর্ট টি-শার্ট পরায় প্যান্টের ভেতরের আন্ডার গার্মেন্টটিও পরিষ্কার দেখছেন অন্যজন। অনেকেই এতে বিব্রত। কিন্তু বিচিত্র ঢঙে প্যান্ট পরা তরম্নণরা এ নিয়ে ভাবিত নন।
অনুকরণপ্রিয় হয়ে উঠছে বাংলাদেশের সঙ্গীত, নাটক সিনেমাও। অভিযোগ রয়েছে, এখন যতটা গান তার অধিক সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে। ব্যবহার করা হচ্ছে অটো টিউনার। সসত্মা লুপ। কৃষ্ণের হাতে বাঁশি নেই। কাজ চালিয়ে নিচ্ছে সিন্থেসাইজার। দীর্ঘ সময় গুরম্ন ধরে সঙ্গীত শেখার মানে খুঁজে পান না অনেকে। টেলিভিশন চ্যানেলের রিয়্যালিটি শোতে অংশ নেয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। এসএমএস ভোটে দিব্যি তারকা বনে যান, বাড়ির মালিক হন; গাড়ি হাঁকান। কাটতি বাড়াতে গানের সঙ্গে বেদম নাচার জন্য প্রস্তুত থাকেন অনেক গায়িকা। আর তাই লোককাহিনীর রূপবানও রবার জিন্স আর টি-শার্ট পরে 'নাচে কোমর দোলাইয়া।' একই সঙ্গে দোল খায় জনসমুদ্র। ডিসকো ড্যান্সার থেকে অনায়াসে নিজেকে 'ডিসকো বান্দর' ঘোষণা করেন গায়িকা। কোন ধরনের আপত্তি না করে 'বান্দর' বনে যাচ্ছেন শ্রোতাও। গায়ের শার্ট খুলে হাতে নিয়ে লাফাচ্ছেন। অপেৰাকৃত বেশি উত্তেজিতদের গায়িকা কিছুৰণ পরপর শানত্ম হওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অনুধাবন করতে পারেন না_ নিজে তিনি অশানত্ম খুব। দিন দিন শ্রোতাদের রম্নচি এত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, এখন অনন্য সুন্দর ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতসন্ধ্যাটিও শ্রোতাহীন থাকে। এ দুঃখে অনেক বড় বড় শিল্পী বাসায় বসে কাটান, তবু শো করতে রাজি হন না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু শহরে নয় গ্রামের অবস্থাও দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়েছে অশানত্মি। বলিউডের 'মুনি্ন বদনাম হুয়ে' কিংবা 'শিলা শিলাকি জাওয়ানী' এখন বাজছে গ্রামের হাটেঘাটে। অভিযোগ রয়েছে, একশ্রেণীর অসৎ ব্যবসায়ী বলিউডের জনপ্রিয় আইটেম সঙের সুর হুবহু রেখে সেখানে অশস্নীল বাংলা কথা বসিয়ে দিচ্ছেন। সে গানে নির্মিত হচ্ছে মিউজিক ভিডিও। অখ্যাত প্রতিষ্ঠান তো বটেই, ব্যবসায় টিকে থাকতে এসব ভিডিও সিডি সরবরাহ করছে নামী অনেক অডিও ভিডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। এভাবে অশস্নীল সিডিতে সয়লাব এখন দেশ।
টিভি নাটকেও ভারতীয় চ্যানেলের আছড় স্পষ্ট। এক ঘণ্টার কোন নাটক এখন প্রচার হয় কালেভদ্রে। প্রতিদিন চলছে সিরিয়াল। যথারীতি এসবে উঠে আসছে ভারতীয় নাটকের গল্পগুলো। এৰেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে বাংলাভিশনের প্রতিদিনের ধারাবাহিক 'গুলশান এভিনিউ।' পণ্যের বিজ্ঞাপন থেকেও ছড়াচ্ছে নানা ধরনের রোগ। পারফিউমের বিজ্ঞাপনের নামে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে উগ্র যৌনতা। এসব বিজ্ঞাপনের নারী মডেলদের রগরগে উপস্থাপনা দেখে যখন তখন বিব্রত হতে হয় বাংলাদেশের ছেলে-বুড়ো সকলকেই। ওয়াশিং পাউডারের বিক্রি বাড়াতে বাচ্চাদের নর্দমায় নামিয়ে দিতেও দ্বিধা করছে না কোম্পানিগুলো। ময়লায় দাপাদাপি শেষে বাচ্চারা বলছে, দাগ নাই তো শেখাও নেই! অনেক মোবাইল অপারেটর ছেলেমেয়েদের লম্বা সময় ধরে কথা বলায় উৎসাহী করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কোন কোন বিজ্ঞাপনে গুরম্ন ধরে সঙ্গীত শেখার প্রয়াসকে তাচ্ছিল্য করে গান ডাউনলোডের পরামর্শ দিচ্ছে।
পুরো বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, পুঁজিবাদীরা বিভিন্ন দেশে নিজের পণ্য বিক্রির জন্য বাজার সৃষ্টির চেষ্টা করে। হিন্দী সিরিয়াল, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র, নগ্ন নৃত্য সবই পণ্যের অংশ। বাংলাদেশ এসবের বাজার। তিনি বলেন, টিভি নাটকে একটি পোশাককে বিশেষভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরি করা হয়। পরে তা ছেড়ে দেয়া হয় বিভিন্ন দেশের বাজারে। বাংলাদেশের বেলায়ও তাই হচ্ছে। ভিনদেশী পোশাক, ফ্যাশন ও আগ্রাসনের প্রতিবাদে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করা কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ব্রিটিশদের খুশি করতে এক সময় হিন্দুরা ধুতির উপরে কোর্ট পরতেন। মুসলমানরা কোর্ট পরতেন পায়জামার উপর। এ অবস্থা এখনও বিরাজমান। এখন একশ্রেণীর মৌলবাদী ইসলামী সংস্কৃতির নামে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি আমদানি করছে। আবার একশ্রেণীর নতুন বড়লোক পশ্চিমী অপসংস্কৃতি আমদানিতে ব্যসত্ম। মধ্যবিত্তরা ছুটছে হিন্দী সংস্কৃতির পেছনে। এর ফলে ভবিষ্যত প্রজন্ম নিজস্বতা ধরে রাখতে পারবে না। একই সঙ্গে পারবে না অন্যেরটা নিয়ে জীবন কাটাতে। এর ফলে সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর বৈচিত্র্যহীন অনুষ্ঠানই দর্শককে বিদেশী টিভি চ্যানেলের দিকে ধাবিত করছে মনত্মব্য করে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, আমাদের টিভিগুলো অনুকরণে বেশি ব্যসত্ম। তারা ঘুরেফিরে শুধু নাটক প্রচার করছে। নিম্নমানের ওসব নাটক দিয়ে দর্শক ধরে রাখা কঠিন।
সুত্রঃ দৈনিক জনকন্ঠ

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




