টাইটেল দেখেই বুঝতে পারছেন আমি সত্যজিৎ রায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। এই মহামানবের সাথে আমার পরিচয় ক্লাস থ্রীতে। কিন্তু ফেলুদার প্রেমে পড়লাম ক্লাস এইটে। টেনিদার পাঙ্খা অবশ্য তারো আগে। দার্জিলিং শহরটা আমার কাছে কি পরিমান গুরুত্বপূর্ন সেটা বোঝানোর জন্যই আমার এত কথা। প্রথম যেবার সুযোগ এলো, সেবার আমার দোস্তরা সব মিলে গেল সেন্ট মার্টিন। টানা পোড়েনে আমার রোমান্টিক মনের জয় হল। কাজটা ভালো হয়নি। এহেন বেইমানিতে কাঞ্চনজঙ্ঘাও মেঘের আড়ালে সেবার লুকিয়ে রইল। তীব্র শীতে প্রায় ফ্রস্টবাইটের মত অবস্থা হল, কিন্তু সূর্যের একটি রশ্মিও মেঘের আড়াল ভেদ করে চূড়া আলোকিত করতে পারলো না। পরের বার মাফ চেয়ে দোস্তদের সাথেই গেলাম। সেবার কাঞ্চনজঙ্ঘা সূর্যের আলোয় তার পূর্ন সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হল। কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপটি এমন যে জটায়ু তো জটায়ু, আমার মত অভাগার মনও কবি কবি হতে বাধ্য। ওই ভাব আসাই সার, একটি লাইনও বের করতে পারলাম না। মেডিকেলে পড়ে মুখস্তের প্রবনতা এমনিতেই বেশী, তাই জটায়ু কেই কপি মারলাম… “অয়ী কাঞ্চনজঙ্ঘে……..”
প্রথম বার গিয়েছিলাম সরাসরি বুড়িমারি বর্ডার হয়ে। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম নেপাল ঘুরে মিরিক হয়ে। পোখারা থেকে আরেক ভয়াবহ দীর্ঘ জার্নি করে গেলাম ভারত-নেপাল বর্ডারের রানীগঞ্জে। অতঃপর মিরিক। মিরিকও ছবির মত একটা শহর। তার প্রধান আকর্ষন মিরিক লেক। দার্জিলিং-মিরিকে গোরখা সম্প্রদায় দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল তাদের দাবী দাওয়া নিয়ে। আমরা যেদিন মিরিকে ঢুকলাম, সেদিন তাদের উৎসবের দিন। দীর্ঘ ১ মাস তারা সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে ছিল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সহিংস। সেদিন তাদের আন্দোলন শেষ হয়েছে। পুরো শহর উৎসবের আমজে। লেকের পাশে মেলা বসেছে, অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমরাও গিয়ে তাদের সাথে মিশে গেলাম।
মিরিক লেক।
লেকের পাড়ে উপজাতিদের আড্ডা।
মিরিক লেক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কি লিখব ভাবছি। ২ ঘন্টা দৌড়াদৌড়ি করে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি দেখলে যেই ভাব হয়, মিরিক লেক দেখে আমাদের খানিকটা সেরকম ভাব হল। টলটলে পানি, চমৎকার শীতল বাতাস আর সবুজ গাছের ছায়ায় লেকের পানিও সবুজ হয়ে আছে। লেকের পাড়ে নরম সবুজ ঘাস, ক্লান্ত দুপুরে গাছের নরম ছায়া।আদিবাসী মেয়েরা সবাই গোলাপী কাপড় পড়া। জানলাম, ওই পোশাক নাকি গোলাপি, গাঢ় গোলাপী বা ম্যাজেন্টা হয়। (মানে গোলাপি!) আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অবশ্য এতগুলি বান্দর একসাথে থাকলে কবি ভাব বেশীক্ষন থাকার কথা না, থাকলো ও না। ফটোশেসনে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। লেকের আরেকপাশে ছোটো একটা লেক, সেখানে বিশাল সাইজের মৎস সম্প্রদায় ঘোরাফিরা করছে। এদের লোকে খাইয়ে খাইয়ে এই অবস্থা করেছে। কাউকে পাত্তা দেয় না, একটা পাউরুটির টুকরা ফেলতে না ফেলতেই সব কয়টা একসাথে ঝাপিয়ে পরে। চমৎকার সব গোলাপী পাতা সহ গাছ। লেক সংল্গন জায়গা সবই কেমন যেন গোলাপী গোলাপী। লেকের পাশে বিশাল মাঠ, সেখানে ভাড়া করা ঘোড়া পাওয়া যায়। লেকের ওপরের ব্রীজ দিয়ে পুরো লেক ঘুরিয়ে আনবে। সেই প্রথম আমার ঘোড়া চড়া এবং মনে আশা ওই শেষ! জন্তু জানোয়ারে ভীষন ভয় আমার। লেক দেখবো কি, কখন এই জানোয়ারের পিঠ থেকে নামব সেই টেনশনেই অস্থির। তবে ঘোড়াগুলি কিন্তু চমৎকার ঘোড়া। আমাদের কক্সবাজার বা মাধবকুন্ডে যেই বেচারা অপুষ্টিতে ভোগা গাধা জাতীয় ঘোড়া পাওয়া যায়, তেমন না। রীতিমত তেজী এবং অনেক পরিচর্যার ঘোড়া।
গোলাপী পাতার গাছের সাথে গোলাপী দুই তরুনী।
মাছ, সাথে আমাদের ছায়া।
লেক ঘুরে এসে খাওয়া দাওয়া শুরু করলাম! স্ট্রীট ফুড দেখলে আমার মাথা কখনোই ঠিক থাকে না। বিশ্বাসযোগ্য না হলেও সত্যি, আমি হোস্টেলে থাকার সময় প্রায় টানা তিন মাস ব্রেকফাস্ট ফুচকা দিয়ে করার পর দেড় মাস টাইফয়েড হয়ে পরে ছিলাম। দেড় মাস পর সুস্থ হওয়া সেলিব্রেট করলাম কি দিয়ে কেউ আন্দাজ করতে পারবেন? উহু ফুচকা দিয়ে না, কারন আম্মু কথা দিয়ে নিয়েছিল যে ফুচকা এরপর থেকে রয়ে সয়ে খাব। তাই চটপটিই খেতে হয়েছিল। এই হচ্ছে অবস্থা! ইন্ডিয়া কিন্তু স্ট্রীট ফুডের জন্য একেবারে স্বর্গ! মিরিকে মৌসম্বী আর আনারসের যে শরবত খেয়েছিলাম, এখনো আমাদের বেশীর ভাগ সেই স্বাদ ভুলতে পারেনি। খেতে এত বেশী মজা ছিল যে একেকজন ৩/৪ গ্লাস করে খাওয়া শুরু করলাম। বেচারা শরবতয়ালা কিছুতেই এতজনেরটা পেরে উঠছিলোনা, আমাদের তো ধৈর্য নাই! শেষে তারিক গিয়ে নিজেই ফল থেকে জুস বানানো শুরু করলো। এর পর ঝালমুড়ি। দোকানী যখন কাঁদো কাঁদো, তখন তাকে নিস্তার দিয়ে গেলাম মোমোর কাছে। আহা, লিখতে গিয়ে এখনি আমার জীভে পানি চলে আসছে! সে কি মোমো! লিখলাম না, ভুলেও কেউ নজর দিলে আবার অসুখে পড়তে হবে। এরপর সন্দেশ আর গুলাপ জামুন। তুলনা নাই তাদের!
সরবত
ঝালমুড়ির গাড়ী।
এই সেই মোমো!
দোকান থেকে কেনা পিচ্চিদের জুতো। মাত্র ৫০ রুপী।
খাওয়া পর্ব শেষ করে গাড়ীতে উঠলাম, সেদিনই যাব দার্জিলিং। মিরিক থেকে দার্জিলিং এর জার্নির বেশীর ভাগ সময়ে আমরা হা করে ঘুমিয়েছি।(হা করে বলছি কারন সবাই কোন না কোন সময়ে হা হয়ে ছিল, ছবি দ্বারা প্রমাণিত!) এর আগের দিন পোখারা থেকে দীর্ঘ যাত্রার ধকল সামলালাম মিরিক থেকে দার্জিলিং এর রাস্তায়। যখন ঘুম শেষ হয়েছে দার্জিলিং আর ঘন্টা খানিকের পথ। বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। যদিও নেপালে পাহাড় দেখতে দেখতেই এসেছি, দার্জিলিং এর পাহাড়টা কিছু অন্যরকম। গাছ গাছালিতে পার্থক্য। দেবদারু জাতীয় গাছে ভরা। নভেম্বরের ঠান্ডা হাওয়া যেন প্রাণ জুড়িয়ে দিল। তবে উচ্ছ্বাস বেশীক্ষন থাকলো না। বাংলাদেশের মাঝেও সবচেয়ে গরম জায়গায় বাস করে অভ্যস্ত, দার্জিলিং এর ঠান্ডা ধাতে সইল না। সবাই কিছুক্ষন পরেই কাপড়ের বস্তা হয়ে গেলাম। হোটেল তো একেবারে বরফ। আমাদের ভাগ্য ভাল, সেদিন রোদ ছিল, তাতেই এই অবস্থা।আমি তো আগে থেকেই টেনশনে ছিলাম। কারন আগের বার এপ্রিলে এসেই আমি শিলাতে ঢাকা রাস্তা আর ঠান্ডায় কাত ছিলাম। না জানি নভেম্বরে কি অবস্থা হয়। তবে আসার সবচেয়ে ভালো সময় এটাই, নভেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহ। কারন এপ্রিলে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়, মেঘ যেন হাঁটতে নিলেই মুখে বাড়ি দেয়। আর নভেম্বরের শেষে যেই শীতটা পড়ে, ধকল সামলানো মুসকিল।
দার্জিলিং যাবার পথে।
নেয়ে খেয়ে ঠান্ডা হতেই পড়ন্ত বিকেল। তাড়াতাড়ি বের হলাম হাঁটা হাঁটি করতে। কারন ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি যেখানে শুরু সেই ম্যালে যেতে হয় হেঁটে। আর সন্ধ্যা হলে কিছুই দেখা যাবে না। মাত্র ৬ মাস আগে একবার দার্জিলিং ঘুরে গেছি, তাই ভাব নিয়ে সবাইকে গাইড করতে লাগলাম। দার্জিলিং এ গাইড করা কোন ব্যাপার না। মাথায় ছটাক খানেক ঘিলু থাকলেই হবে, কোন ভাবেই হারানো সম্ভব না। একটাই রাস্তা, পাথুরে, পাহাড়ী আর ঠান্ডা। পাহাড়ী রাস্তা, তাই হাঁটতে গিয়ে হাঁফ ধরে গেল। এর মাঝে শপিং তো আছেই। কারন রাত ৮ বাজলে রাস্তায় কুকুর পাওয়াও মুসিবত। আর ম্যালের রাস্তার তো কথাই নেই! কি নেই সেখানে? দার্জিলিং এর সোয়েটার বিখ্যাত। দামে যথেষ্ট কম, আর ডিজাইন আর রঙে অনন্য। আবার কিনলাম বেশ কয়েকটা। ম্যালের রাস্তা বোঝাই টুকরো টাকরা জিনিস আর রঙ বেরঙের ছাতা। এটা দেখি, ওটা দেখি, এইসব করতে করতে যখন ম্যালে পৌঁছলাম, তখন বাজে রাত ৮টা। চমৎকার আড্ডার জায়গা। দার্জিলিং বাসী বুঝি প্রতি বিকেলে এইখানেই জটলা বাধাঁয়। খানিকক্ষন হাঁটা হাঁটি করে ব্যাক করলাম। কারন দার্জিলিং এর বিখ্যাত INOX Complex এ সিনেমা দেখবো। এটাতে আমি প্রথ্মবার রেস দেখেছিলাম। ট্যুর প্লানের সময় সিনেমা মাথায় রাখা হয়েছিল। তখন চলছিল গোলমাল রিটার্ন্স, ফ্যাশন আর কোয়ান্টাম অব সোলেস। ৩৭ খানা টিকেট একসাথে পাওয়া বড়ই সমস্যা। পাসপোর্ট আর স্টুডেন্ট আইডি দেখিয়ে কাটতে হল। আমরা অবশ্য কেউই কাটিনি, বেচারা ইভান এই গুরু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওর আর ম্যালই দেখা হলোনা। গোলমাল রিটার্ন্স দেখলাম। চমৎকার হল, আমাদের সিনেপ্লেক্সের মতই, তবে অনেক বড়। আর সিট গুলো আরো আরাম দায়ক, প্রায় শুয়ে পড়া যায়। ক্যামেরা থেকে শুরু করে সব কিছু জমা নিয়ে নেয়। তাই ওগুলো হোটেলে ফ্রন্ট ডেস্কে জমা রেখে যাওয়াই ভালো। INOX complex এই আছে বিগ বাজার। আর সব ব্রান্ডের দোকান। তবে কালেকশন তেমন ভালো না, শিলিগুড়ী হচ্ছে এদিকের শপিং প্যারাডাইস। রংপুরের অনেকেই আমি জানি শপিং করতে শিলিগুড়ী চলে যায়।
INOX এর সামনে সিনেমা শেষে আমরা।
সিনেমা শেষ যখন হলো, রাত ১০টা, ততক্ষনে পুরো দার্জিলিং ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হলো। রাস্তা গুলি একেবারে ফাঁকা, মাঝে মাঝে কিছু স্ট্রীট লাইট। ভয়ংকর ঠান্ডা, গ্লাভস আর টুপিতেও মানে না। রাতে দার্জিলিং এ হাঁটা আমার জীবনের অন্যতম স্মরনীয় ঘটনা। খুবই নিরাপদ, একা হাঁটলেও কিছু হবে না। অনেকক্ষন হেঁটে দেখলাম আমরা, সম্পূর্ন ঘুমন্ত শহর, আলো-আধাঁরির মাঝে।ভাবজ উঠলেই আমার অর্নবের গানের কথা মনে হয়। “হারিয়ে গিয়েছি” গানটা দার্জিলিং কে ডেডিকেট করে দিলাম।
“গোটা শহর বাতি জ্বেলে সতর্ক…… পায়ে পায়ে হারাবার জায়গা খুঁজে মরি………”
রাত ১২টার দিকে ঠান্ডা চরমে উঠলে হোটেলে ফিরে গেলাম। কারন পরের দিন সব সাইট সিয়িং।
(চলবে)
দার্জিলিং জমজমাট! (দ্বিতীয় পর্ব)