প্রথম পর্বঃ জীবন যেমন-১ (একটি সাধারণ কাহিনী)
৪.
সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল-ওর যাওয়ার দিন যত নিকটবর্তী হচ্ছিল ততই ও ক্লাসে আসা কমিয়ে দিচ্ছিল। ভার্সিটিতে আসত, তবে শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য। এসময় আমাকে যখন ফোন করত, বিভিন্ন অজুহাতে দেখা করাটা এড়িয়ে যেতাম। মনে হত, কেন দেখা করব, কি যুক্তিতে? তার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে হয়ত বেঁধে রাখতে পারব না, মনের আড়ালে চলা যুদ্ধটা উন্মোচিত হয়ে যাবে এই ভয়ে। অথচ ঠিকই দুর হতে তাকে লক্ষ্য করতাম-কখনো গেটের আড়ালে দাঁড়িয়ে, কখনো লিফটের লাইন থেকে, আবার কখনো বা ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে, যখন সে সবার সাথে গল্প করত। নিজেকে সামলাতে না পারলে ছুটে যেতাম বেসিনের কাছে, কল খুলে দিয়ে কাঁদতাম, যাতে কেউ তা শুনতে না পায়। ক্লাসে মন বসাতে পারতাম না, ক্লাসরুমে ঢুকলে বুকটা হু হু করে উঠত এই ভেবে যে আর তো তাকে এখানে দেখব না মনোযোগ দিয়ে লেকচার শুনতে, বা পাশের বন্ধুকে পড়া বুঝিয়ে দিতে। ক্লাস শেষে যখন দেখতাম সে নিচে দাঁড়িয়ে আছে, তখন অন্যপাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতাম যেন আমাকে দেখতে না পায়। এভাবেই চলছিল আমাদের মাঝে এক অলিখিত লুকোচুরি খেলা......
৫.
একদিন দুপুরে ল্যাব ক্লাসে ফোন করল সে, দেখা করতে চায় আমার সাথে, কারণ তার যাওয়ার বাকি শুধুই ২টি দিন, অথচ আমার সাথে তার দেখা হচ্ছিল না। মিথ্যে করে বললাম, ক্লাস শেষ হতে অনেক দেরি হবে, সে যেন অপেক্ষা না করে চলে যায়, যদি দেখা না-ও হয়। ভেবেছিলাম সে এতক্ষণ অপেক্ষা করবে না, তাই নিশ্চিন্ত হয়ে গেট থেকে বেরোতেই দেখি, সে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, তাকে এড়ানোর আর উপায় নেই। বলল ক্যান্টিনে যেতে ওর সঙ্গে, কাজেই কী আর করা, পিছু পিছু চললাম তার, লিফটে উঠলাম, সে কথা বলছিল আর আমি হুঁ হাঁ করে যাচ্ছিলাম। ক্যান্টিনে বসেও একই ব্যাপার, একদিকে সে কথা বলছে, অন্যদিকে আমার অশান্ত হৃদয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কী কী সব বলল ভাল ভাবে শুনিও নি, শুধু ঐ কথাটা ছাড়া যে সে যাওয়ার দিনে সকালে শেষ দেখা করার জন্য ভার্সিটিতে আসবে। আমাকে অনুরোধ করল ঐ দিন থাকার জন্য, আমি উত্তরে কেবল একটা শুকনো হাসি ছাড়া কিছুই উপহার দিতে পারলাম না তাকে। ততক্ষণে মনস্থির করে ফেললাম যে ঐদিন ক্লাস থাকলেও ভার্সিটি কিছুতেই যাব না, কারণ একটা দুর্বল মুহূর্তের স্বীকারোক্তি সব পন্ড করে দিতে পারে আমাদের দু'জনের জন্য। ওর বাইরে যাওয়া, আমাদের বন্ধুত্ব, ওর নুতন জীবন, সবই টালমাটাল হয়ে যেতে পারে আমার ঐ একটি ভুলের জন্য, এতে শুধু দুঃখই পেতে হবে আমাদের। তাই তো ওর শেষ বিদায়ের দিন, যখন আমি একাকী আমার রুমে বসে, ওর সাথে থাকা সব স্মৃতির পাতা উল্টে যাচ্ছি আর আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অশ্রু হয়ে বর্ষিত হচ্ছিল, তখন ওর ফোন পেয়ে, অসুস্থতার মিথ্যে ভান করে দেখা করাটা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করতে কষ্ট হলেও, নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।
৬.
ফ্লাইট ছিল রাতে, কিন্তু সন্ধ্যা হতেই কল আসছিল তার, এমনকি চেক-ইনের আগ মুহূর্তেও আমাকে ফোন করে সে বলল, "তোদের (ততদিনে তুমি থেকে তুই-তে চলে গিয়েছিল আমাদের সম্বোধন) ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে রে, জানি না কিভাবে পারব থাকতে।" যদিও এটা আমাদের সব বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলা, তবুও ওর আকুতি শুনে মনটা ভেঙ্গে গেল। তারপরেও নিজেকে সংবরণ করে, স্বাভাবিকতার মুখোশ এঁটে তাকে প্রবোধ দিলাম, বুঝালাম যে জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশেষে ফোন রেখে দিল সে, আর আমি, চুপচাপ বসে রইলাম টিভির সামনে। একসময় শুনলাম বাইরে বিমানের গর্জন, ভাবলাম এটা হয়ত তারই ফ্লাইট, আর না হলেই বা কী, সে তো চলেই গেল আমাকে ছেড়ে, একাকী রেখে আমায়। আবার এটাও ভাবলাম, সে তো আমার ছিলই না কখনো, তবে কেন এই বৃথা কষ্ট পাওয়া? নিজের রুমে এসে চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম, মনের অজান্তেই কখন কাঁদতে শুরু করলাম জানি না, একসময় কান্নার তীব্রতা বেড়ে গেল, বালিশে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কাঁদলাম আমি শিশুর মত। মনে হচ্ছিল যে ও একা যায় নি, আমার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে সেটার বড় একটা অংশ নিয়ে গেছে নিজের সাথে......
.....(চলবে)