জনৈক দরবেশ এবং তার এক অল্প বয়ষ্ক শাগরেদ শহর থেকে দূরে এক জঙ্গলে বাস করতো। দরবেশ সবসময় আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকতো আর শাগরেদ ভক্তিভরা চিত্তে দরবেশের খেদমত করতো। খাবারের দরকার হলে শাগরেদ আশপাশের লোকালয়ে চলে যেত এবং চেয়েচিন্তে যা পেতো তাই এনে দরবেশকে দিতো এবং নিজেও খেতো।
এই দরবেশের হৃদয় ছিল বড় কোমল এবং মানব প্রেমে পরিপূর্ণ। সকাল সন্ধ্যায় দরবেশ গভীর আবেগে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতো, ওগো আমার পরওয়ার দিগার, আমি একজন নিরূপায় আশ্রয়হীন মানুষ। তাই তোমার বান্দাদের কোন খেদমত করতে পারিনা। কিন্তু তুমি যদি আমাকে বাদশাহ বানিয়ে দাও, তাহলে আমি জীবনভর গরীব দুঃখী মানুষের খেদমত করবো। এতিম, মিসকিন, দুঃস্থ ও সহায়-সম্বলহীন মানুষকে সাহায্য করবো। অভাবগ্রস্থ মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খুলে দেবো এবং মানুষের মাঝে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবো। মজলুমের সহায়তা করবো আর অত্যাচারী ও ব্যাভিচারী লোকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করবো। আমি সমাজ থেকে সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া এবং সব ধরনের পাপকাজ ও বেহায়াপনা উচ্ছেদ করবো। ভাল কাজে আমি মানুষকে উৎসাহিত করবো, সকল কল্যাণকর কাজে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করবো। আমি সারা দেশে মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করবো।
তরুন শাগরেদ গভীর নিষ্ঠা ও আগ্রহ নিয়ে দরবেশের এ প্রার্থনায় শরীক হতো। সে ভাবতো, একদিন অবশ্যই মুর্শিদের দোয়া কবুল হবে এবং তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। কিশোর শাগরেদ যৌবনে পদার্পন করল। মহাপ্রান দরবেশের চেহারায় বার্ধক্যের চিহ্ন দেখা দিল, কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হলো না।
দেখতে দেখতে শাগরেদটির বিশ্বাসে চিড় ধরল। দরবেশের দোয়ায় আর তার কোন আগ্রহ রইল না। আস্তে আস্তে তার মধ্যে ভাবান্তর এলো এবং সে দরবেশের উল্টো দোয়া করবে বলে মনস্থির করলো। একদিন যখন দরবেশ দোয়ার জন্য হাত তুলল, তখন সে তার কাছাকাছি না বসে কয়েক কদম দূরে গিয়ে বসল এবং নীচু স্বরে এই দোয়া শুরু করল, ওগো আমার পরওয়ারদিগার! আমার মুর্শিদ বুড়ো হয়ে গেছে তার চুল দাড়ি সব ফকফকা সাদা। দাঁত পড়ে গেছে; দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়েছে। বলতে গেলে তার এখন কবরের ডাক এসে গেছে। এখন আর সিংহাসন দিয়ে তিনি কি করবেন?
হে প্রভু, তার সারা জীবনের দোয়া তুমি কবুল করোনি। আমার মনে হয় কোন মহৎ হৃদয় ব্যক্তিকে বাদশাহ বানানো তোমার পছন্দ নয়। তাই যদি হয় তাহলে খোদা তুমি আমার দোয়া কবুল করো। দরবেশের পরিবর্তে আমাকেই তুমি বাদশাহ বানিয়ে দাও। আমি তোমার কাছে শপথ করছি, আমার প্রতিটি কাজ আমার মুর্শিদের কামনা-বাসনার বিপরীত হবে। আমি ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে ওয়াদা করছি, অসহায়দেরকে আরো অসহায়, নিরাশ্রয়দের আরো নিরাশ্রয় এবং মজলুমদেরকে আরো মজলুম বানাবার জন্য আমি সর্বদা সচেষ্ট থাকবো। আমি চোর-ডাকাতদের পৃষ্ঠপোষকতা করবো। শরীফ ও ভদ্র লোকদেরকে আমি অপদস্ত করব। আমি সুদখোর ও পাপিষ্টদেরকে পুরস্কৃত করব। নির্বিচারে মসজিদ ও মাদ্রাসায় তালা লাগিয়ে সারা দেশে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার বন্যা বইয়ে দেবো।
প্রথম দিকে শাগরেদটি চুপে চুপে এ দোয়া করত। কিন্তু ধীরে ধীরে তার সাহস বৃদ্ধি পেতে থাকল। কিছুদিন পর মুর্শিদ যখনই দোয়ার জন্য হাত তুলত; তখনই সে তার কাছে বসে উচ্চস্বরে নিজের দোয়ার পুনরাবৃত্তি করতে থাকতো। দরবেশ যখন অশ্রুসজল চোখে বলত, আমি বাদশাহ হলে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করব তখন শিষ্য বলত, আমি বাদশাহ হলে জুলুম ও পাপের পতাকা উড়িয়ে দেব। দরবেশ বলত, আমার ভান্ডার থেকে অসহায় নিরাশ্রয় লোকদেরকে ভাতা দেবো; শাগরেদ বলত, আমি এমন লোকদের ওপর জরিমানা আরোপ করবো। শিষ্যের এ অধপতনে দরবেশ মনে খুব কষ্ট পেতেন এবং তাকে ধমক দিতেন। এমনকি কোন কোন সময় লাঠি নিয়ে মারতেও উদ্যত হতেন। কিন্তু শাগরেদ নিজের ভূমিকার ওপর অটল ও অবিচল হয়ে থাকত।
ইতিমধ্যে সে দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে যায়। বাদশাহ তার ইহলীলা সাঙ্গ করলে পরিত্যাক্ত সিংহাসন দখলের জন্য কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী তলোয়ার হাতে একে
অন্যের বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষায় ময়দানে অবতীর্ণ হয়।
সে দেশের উজীরে আযম ছিলেন খুবই বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ। তিনি দীর্ঘদিন মন্ত্রীত্ব করলেও কখনো বাদশাহর দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে বাদশাহর অনুপস্থিতিতে তিনি খুব অসহায় ও বিচলিত বোধ করেন। রাতকে রাত তিনি এ নিয়ে চিন্তা করলেন। অবশেষে সিংহাসনের সকল দাবীদারদের একত্র করে তিনি বললেন, দেশকে নিশ্চিত গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, শহরের সমস্ত ফটক বন্ধ করে দেয়া হোক। কাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম পুব দিকের প্রবেশদ্বারে করাঘাত করবে তাকেই আমরা দেশের বাদশাহ হিসেবে বরণ করে নেবো।
এ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। অধীর আগ্রহে সবাই আগামী কালের অপেক্ষা করতে লাগল। ঘটনাক্রমে সে আল্লাহভক্ত দরবেশের সাগরেদ ভিক্ষার অন্বেষণে সেদিন কোন ছোটখাট জনপদের দিকে না গিয়ে একবারে দেশের রাজধানীর দিকে রওয়ানা দিল। কাকডাকা ভোরে সে এসে শহরের পূর্ব দরজায় করাঘাত করল। দ্বাররক্ষীরা আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে সালাম জানিয়ে পাশে সরে দাঁড়াল। ওমরাহগণ আগত সৌভাগ্যবান মেহমানকে অভিবাদন জানিয়ে অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে শাহী মহলে নিয়ে গেল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দেয়া হলো।
নতুন বাদশাহ সিংহাসনে আরোহন করেই ফরমান জারী করলেন, আমার সাম্রাজ্যে যত ফকীর-দরবেশ ও সাধু-সন্যাসী আছে তাদের সবাইকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে রাজদরবারে হাজির করা হোক। বাদশাহর নির্দেশ সঙ্গে সঙ্গে কার্যকরী করা হল। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ নবনিযুক্ত বাদশাহর সে মুর্শিদ এ গ্রেফতারীর হাত থেকে রক্ষা পেল। কারণ সে তার এক ভক্ত মারফত জানতে পারল, তার শিষ্যের দোয়া আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে গেছে এবং সে দেশের বাদশাহ হয়ে গেছে। মুর্শিদ শাগরেদের মনোভাব জানতো, তাই সে ভয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলো।
তারপর যা ঘটেছে তা কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। নতুন বাদশাহ পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে নিজের সকল ওয়াদা পূরণ করতে শুরু করল। রাজ্যের সমস্ত ঝরণা ও ফোয়ারা বন্ধ করে দিল। কূয়া ও পুকুরসমূহ তাবৎ নাপাকি ও ময়লা-আবর্জনা দিয়ে ভর্তি করে দিল। জেল-হাজত থেকে সকল চোর-ডাকাতদের মুক্তি দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের নিযুক্ত করল। আল্লাহ তায়ালার ভক্ত অনুগত বান্দাহদেরকে ইবাদতখানাগুলো থেকে বের করে এনে কয়েদখানার অন্ধকারে আবদ্ধ করল। মোটকথা, যারা সাম্রাজ্যের মঙ্গল কামনা করে একজন ভিখারীকে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন সে সব জ্ঞানী-গুণীজনদের আত্মগোপন করারও নিরাপদ জায়গা কোথাও ছিল না।
নতুন বাদশাহর অত্যাচার, উৎপীড়ন যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল তখন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ তার নতুন বাদশাহর বংশ পরিচয় জানার তীব্র প্রয়োজনবোধ করল। সাবেক উজিরে আযমের নেতৃত্বে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল গোপন অনুসন্ধানের পর তার পরিচয় পেয়ে তারা বাদশাহর প্রাক্তন মুর্শিদের নতুন ঠিকানায় গেল এবং দরবেশের কাছে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে বলল, হুজুর, দয়া করে আপনি আমাদের জনগণকে এবং দেশকে এ অবাঞ্ছিত আপদ থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করুন।
বয়োবৃদ্ধ দরবেশ তার শিষ্যের সামনে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিনিধি দলের সদস্যদের অশ্রুসজল মিনতি ও অনুরোধে প্রভাবিত হয়ে তিনি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে হলেও শাগরেদের সাথে দেখা করেতে সম্মত হলেন। তিনি রাজ দরবারে গিয়ে পৌঁছলে মহামান্য বাদশাহ মুর্শিদকে দেখেই চিনতে পারলেন এবং তার নিজের অতীত জীবনের স্মৃতি মনের মনিকোঠায় ভেসে উঠল। তিনি ভীত-বিহ্বল কন্ঠে বলে উঠলেন, আমার শ্রদ্ধেয় পীর ও মুর্শিদ। আদেশ করুন, আমি আপনার কি খেদমত করতে পারি?
জবাবে দরবেশ বললেন, আমি আমার নিজের জন্য তোমার কাছে কিছুই চাই না, আমি শুধু তোমার কাছে তোমার প্রজাসাধারণের পক্ষ থেকে এ আবেদনই করতে চাই যে, তুমি তোমার প্রজাদের সাথে একটু সদয় আচরণ করবে। তুমি আজকের এ সম্মানজনক পদ লাভ করে অতীতকে ভুলে গেছ, ভুলে গেছ তুমি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে বেড়াতে। আল্লাহ তায়ালার ভয় মন-মগজে বদ্ধমূল রাখতে চেষ্টা করো। এ দুনিয়ার জীবন একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। তাই যদি পার তবে মরার আগে কিছু ভাল কাজ করে নিতে চেষ্টা করো।
এ আবেদনে বাদশাহ অত্যান্ত বিরক্ত হলেন। তিনি রাগতস্বরে হুংকার ছাড়লেন, দেখুন কিবলা হুজুর, আপনি আমার সহ্যশক্তির পরীক্ষা নিতে চেষ্টা করবেন না। আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি আমার আবাল্য মুর্শিদ বলে আজ আমি আপনার ওপর হাত তুলতে ইতস্ততঃ করছি। আপনি আমাকে ইচ্ছামত গালাগালি দিতে পারেন, কিন্তু আল্লাহর ওয়াস্তে এ লোকদের সাথে কোন ভাল ব্যবহার করার পরামর্শ দিতে পারেন না।
আপনার স্মরণ থাকার কথা, একসময় আমরা উভয়েই একই সাথে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতাম। আপনার দোয়া আল্লাহ কবুল করেন নি, অথচ আল্লাহ তায়ালা তাঁর অপার কুদরতে আমার দোয়া কবুল করে আমাকে একবারে বাদশাহ বানিয়ে দিয়েছেন। এ লোকদের আমল যদি ঠিক হতো এবং তারা কোন কল্যাণ লাভের উপযোগী হতো তবে আপনাকেই আল্লাহ তাদের বাদশাহ বানাতেন। কিন্তু এরা বড়ই দুর্ভাগা! এদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দের পার্থক্য করারও কোন যোগ্যতা নেই। তাইতো আল্লাহ তায়ালা তাদের বদকর্মের শাস্তি দেয়ার জন্য আমাকেই তাদের বাদশাহ মনোনীত করেছেন।
আপনি জানেন, এদের কষ্ট ও দুর্গতি বাড়ানোর জন্য আমি আল্লাহর কাছে ওয়াদাবদ্ধ। আল্লাহর কাছে দেয়া ওয়াদা অনুযায়ী আমি আমরণ নিজের সেইসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে থাকব, যা তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য আল্লাহ আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য যদি তাদের আর্তনাদ ও অসহায় অবস্থার ওপর আল্লাহর করুণা হয় এবং আমারও জীবন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, তবে সে তো আলাদা কথা। আর যদি তা না হয় তবে এ ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে কোন প্রকার কাপ্যণ্য বা শৈথিল্য প্রদর্শন করার কোন প্রশ্নই উঠে না।
এতক্ষণে দরবেশ মুখ খুললেন এবং বললেন, বৎস, তুমিই প্রকৃত সত্যের অনুসারী, তুমি যথার্থই বলেছো। যদি এই লোকরা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন পুরষ্কার অথবা উন্নত আচরণের যোগ্য হতো; তবে আমার সারা জীবনের দোয়া বিফল হতো না। এই লোকেরাই আমার পরিবর্তে তোমার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছে। কাজেই এখন তাদের ওপর অনুগ্রহ করার কোন যুক্তি নেই। অতএব তুমি উৎসাহের সাথে তোমার দায়িত্ব পালন করে যেতে পার।
(নসীম হিজাযী-র 'কিং সায়মনের রাজত্ব' বইয়ের ভূমিকা হতে সংগৃহিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





