কিছু কিছু মানুষের সাথে আমার চরম বন্ধুত্ব হয়ে যায়, তেমনি মালিবাগ বাজারের মুরগী বিক্রেতা 'ফারুক ভাই' একজন, আমাদের বন্ধুত্ব প্রায় ৮/৯ বছরের কাছাকাছি, আমি মালিবাগে বাসা নিয়ে এলে বাজার করতেই তার সাথে পরিচয়, এবং তার কাছেই আমি দেশি বা ফার্মের মুরগী কিনি! এবার আমার মুরগী কেনার ধরন বলি, ধরেন আমি নয়াপল্টনে আছি, রিক্সায় উঠছি, ফোন করলাম ফারুক ভাইকে, '৪টা দেশি ৪টা ফার্মের, সাফাই করে ব্যাগে ভরেন, আসতেছি, দুই হাজারের বেশি যেন না হয়, দেশি গুলার সাইজ ভাল হতে হবে'! এবার আমার যেতে যতক্ষন, সব পিস করে রেখে দিবে, আমি গিয়েই টাকা দিয়েই বাসায় নিয়ে যাই। এখানে বলে রাখা ভাল টাকা না থাকলেও অসুবিধা নেই বা আমি যদি বলি বাসায় দিয়ে যেতে তাও ব্যাপার না। তিনি আমার চরিত্র বুঝেন, টাকার চিন্তা করেন না, বাসাও চিনাইয়া দিচ্ছি!
যাই হোক গত কয়েকদিন আগে রিক্সায় কাকরাইলে বসে ফোন দিলাম, আমারে কয়, সাহাদাত ভাই আমি আর ঐ মুরগী দোকানে কাজ করি না। আমি বললাম, মানে? ফারুক ভাই কয়, আমি আসলে সেই দোকানের মালিক ছিলাম না, কর্মচারী ছিলাম, আমার এক আত্মীয়ের দোকান ছিলো, আমিই চালাতাম, আমিই কেনা বেচা করতাম, উনাকে উনার লাভ দিয়ে বাকী টাকা আমরা নিতাম। প্রায় ৯ বছর এই দোকান চালাইছি নিজের মত করে, এখন সেই আত্মীয় উলটা পালটা কয়, জগন্য ভাষা ব্যবহার করে, এর পরে রাগ করে ছেড়ে দিচ্ছি। আমি বললাম আরে ফারুক ভাই বলেন কি, আমি তো আপনাকে সেই দোকানের মালিক মনে করতাম, তা এখন কি করেন, কোথায় আছেন, আমি মুরগী কিনতে আসতাছি, মুরগী লাগবো! ৪টা ফার্মের, বড় সাইজ!
ফারুক ভাই বলেন, আসেন, রেললাইনের ধারে খোলা জায়গায় একটা ছোট দোকান নিচ্ছি, দেশি এখনো উঠাইতে পারি নাই, ফার্মের আছে, আসেন, রেলগেইট এসে ফোন দিয়েন দোকানে নিয়ে আসবো।
আমি যেয়ে (দোকান খুঁজে বের করতে ৫/৬টা কল করতে হয়েছে) দেখি, হ্যাঁ, শান্তিবাগের শেষ মাথায় সত্যি একটা ছোট খোলা মুরগী দোকান নিয়ে বসেছেন, আমার মুরগী গুলো এক সাইডে রাখা। বললেন, চলেন চা খাবেন, আমি চা খেতে চাই না! আমি জানতে চাইছি, কেন কি হল কেন এমন করে সেই দোকান থেকে চলে এলেন, আর আমি তো আপনাকেই সেই দোকানের মালিক ভাবতাম! অনেক আফসোসের কথা শুনালেন, বললেন ৯ বছর সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত ছুটি ছাড়া কাজ করেছি, তবুও মালিকের মন ভরাতে পারি নাই! কি আর করবো ফলে এখন নিজে এই ছোট দোকান নিয়ে বসলাম, দেখি আল্লাহ ভাগ্যে কি রেখেছেন! আরো জানালেন আপনাদের মত যারা ফোন দিয়ে আসেন তারা সবাই আসছেন বলে সাহস পাচ্ছি!
হাতে ব্যাগ নিয়ে হাসি মুখের ফারুক ভাইকে বিদায় জানাতে আমিও মনে মনে ভাবছিলাম, আরে এ যেন আমারই গল্প! ৯টা বছর চাচার ফার্মে কাজ করে আমিও আমার চাচার মন ভরাতে পারলাম না, এই ৯ বছরে উনাকে শুন্য থেকে কোটিকোটি পতি হতে দেখলেও বাস্তবে আমি লক্ষপতিও হতে পারলাম না অথচ তাকে এমন ধনী বানিয়ে দিতে আমার চেষ্টার সামান্য কমতি ছিলো না, ছিলো না আমার সকাল সন্ধ্যা রাত! ভাবছিলাম চাচা ভাতিজা মিলে বাকী জীবন কাটিয়ে দিবো অথচ চাচা আমাকে কর্মচারীর চেয়ে আর বেশি কিছু ভাবতে পারেন নাই!
হ্যাঁ, আমি এখন ফারুক ভাইয়ের মতই, এই ৯ বছরে যেহেতু এই একটা কাজ শিখেছি ফলে এই কাজ ফেলে নুতন কাজে যেতে মন চাইছে না, এখন ছোট পরিসরে আমিও নুতন দোকান নিয়ে বসেছি আজ মাসখানেক! বাকী বিধাতার খেলা এবং আপনারা সাক্ষী!
(২০২০ সালে মালিবাগ বাজারের একটা ভিডিও করেছিলাম, সেখানে ফারুক ভাই সেই মুরগী দোকান থেকে হাত নেড়েছিলেন, ভিডিওটা ইউটিউবে আপ্লোড করেছিলাম, মালিবাগ বাজার দেখতে চাইলে লিঙ্কে ক্লিক করতে পারেন, কমেন্টে লিঙ্ক)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৫