বাড়ির চারপাশটা বেশ সাদামাটা। ভেতরে কয়েকটা ধানের গোলা। পাশেই গরুর গোয়াল। 8টা সব মিলিয়ে। একটা গাভী। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে পাকার ধানের গন্ধে বাড়ির চারপাশটা ভরে ওঠে। তার মাঘে দাঁড়িয়ে কাতব শুন্যের দিকে তাকিয়ে গালি দিয়ে ওঠে অস্ফুটে, ছোটলোকের বাচ্চা। দেখে যা এখন আমার কত ধান। শেয়াল কুকুরে খায় আমার ভাত। আর তোকে মরতে হলো ভাতের অভাবে।
গালাগালটা কাতবের মৃত বাপের উদ্যেশ্যে। ভাতের অভাবে মাঠের মাঝখানে হা করে মরেছিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে। খিদেটা যেন আকাশের মতই বিশাল ছিল। কাতব তখন 7 বছরের। প্রথমটা কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। কান্নার বদলে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল বাপের হা হওয়া মরা মুখটার দিকে। ওপাড়ার মহাজনের বৌটা বলেছিল, হারামজাদার কান্ড দেখছ? বাপাটা তো মরেছে। চোখে একফোটাও পানি নেই।
তারপর মহাজনের কষে দেয়া চড়টা দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছিল তার। তারপর চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়েছিল চোখ থেকে। কাতবের কান্না দেখে নিমেষেই পাল্টে গিয়েছিল আশপাশের সবার দৃষ্টি। কান্নাটা যেন মহৎ ব্যাপার, এমন দৃষ্টিই ছিল সবার। কিন্তু তখন দৃষ্টি পরিস্কার হয়ে আসলেও, বা গালটা বেশ জ্বলছিল কাতবের।
তারপর কেটে গেছে একে একে 25টি বছর। বদলে গেছে অনেক কিছু। বাঁশের ব্যবসা পাল্টে দিয়েছে কাতবের জীবন। আস্তে আস্তে জমি জিরাত হল, গরু হলো হালের। ফসলের বাড়ন্ত অবস্থায় ঝাড়ের বাঁশ কেটে গোটা দুই বড় বড় গোলাও তৈরি করতে হল। এখন বাঁশের ব্যবসাটা ছেড়ে দিয়েছে কাতব। তার বদলে চাষ করা মাটির বুনো গন্ধটাই বেশি টানে তাকে। মাঝে মাঝে চাষ দেয়া লাঙ্গলের ফলাতে দু'ভাগ মাটিতে উবু হয়ে বুকভরে মাটির গন্ধ নেয় সে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাপের মরা মুখটা খোঁজে। মাঝে মাঝে মনে হয় পুরো আকাশটাই যেন বাপের মরা মুখ। মুখের হা টা আর দেখতে পায় না সে। কিন্তু তবুও গত 25 বছরে একদানা ভাতও মুখে দিতে পারেনি কাতব। ভাত দেখলেই বমি আসে। পেটের নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসতে চায়।
'ও বাবা। একমুঠো ভাত দিবা?
হঠাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ে কাতবের। পেছনে জীর্ন কাপড়ের এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। শীর্ণ দেহ।
-আজ 5দিন ভাত খাই নি। পরাণডা বাইর হই যাতি চায়। এটউ ভাত দিবা বাবা?
চেহারাটা যেন চেনা চেনা লাগে। হঠাৎই চিনতে পারে। মহাজনের বউ! কাতবের মনে পড়ে, ভাতের জন্য বাপ গিয়েছিল মহাজনের বাড়িতে। বউটা বাপের ুধিত চোখের সামনে কুকরকে ভাত ঢেলে দিয়ে বলেছিল, নে ভাত খা।
ঋণের দায়ে জমিগুলো আগেই গিয়েছিল মহাজনের পেটে। তারপর ভিটে মাটি টুকুও কড়ে নিল। পরের দিনগুলো কুকুরের মতই কেটেছিল বাপের। অপমান , অভিমানে আর লজ্জায়। তারপর সব শেষ। সে সময় কাতব ছিল বকুল মাসির বাড়িতে। সেখানে দু' বেলা খাবার জুটত। আর এই খাবার টুকুর লোভেই বাপের কাছে যেতে চাইতনা সে। তবুও দেখতে পেলেই বাপ বুকে জড়িয়ে ধরত কাতবকে। বলত- তুই অনেক বড় হবি বাপ। তোর অনেক জমি-জিরাত হবে। তুই অনেক ভাতির মালিক হবি। তখন সবাইকে ভাত খেতে দিস। কাউকে যেন ফিরি দিস্ না খোকা।
আজ এতদিন পর মহাজনের বউটাকে দেখে রাগে শরীরটা চিড়বিড়িয়ে ওঠে কাতবের। ইচ্ছে করা ভাতের ওপর দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে বলতে- নে মাগি। ভাত খা।
কিন্তু হঠাৎ করেই বাপের মরা হা করা মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাতবের। সেই মুখ যেন বলে ওঠে, ভাত দে কাতব। রাগ করিস নে বাপ।
বাড়ির ভেতর থেকে এক সানকি ভাত এনে মহাজনের বউটাকে দেয় কাতব। নেও চাচী, ভাত নেও।
আজ কেন যেন ভাতের গন্ধটাকে বড় ভালো লাগে কাতবের।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৩:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



