জুলেখা আমাদের কাজের মেয়ে। বয়স খুব বেশি হলে চৌদ্দ। ও আমাদের বাড়িতে প্রথম এসেছিলো আরো ঠিক সাত আট বছর আগে। ছেলেদের হাফপ্যান্ট, হাতাকাটা নোংরা গেন্জি, আনাড়ি হাতে ছোট করে ছাটা অগোছালো চুলের রোগা পটকা জুলেখাকে প্রথম এনেছিলো আমাদেরই কোন ছোটা কাজের বুয়া। একটু পাগলাটে এবং অস্থির জুলেখাকে দেখে আমার মা খানিক্ষন নাক কুচকে ছিলেন, বোধহয় ভাবছিলেন ওকে রাখলে ঠিক কতটা খাটিয়ে নেয়া যাবে। জুলেখা ঠিক এতসবের পরোয়া না করে ইতিউতি ঘুরে ঘুরে অবাক চোখে দেখছিল শহুরে আসবাব, যত্নে সাজানো নাগরিক বন্দীশালা। এ্যকুরিয়ামের রঙিন মাছ দেখে অবাক চিৎকারে বলেছিলো "এমা এত্ত সুন্দর মাছ বাক্সে, এ গুলান কি সত্যির?"।
নামমাত্র বেতনে সার্বক্ষনিক কাজের লোক-এ বিচারে মা ওকে রেখে দিতে রাজি হলেন। সদ্য গ্রাম থেকে আসা জুলেখা বন্দি হলো ঠিক এ্যকুরিয়ামের রঙিন মাছের মতো। জানতেও পারলোনা ঠিক কতো দামে বিক্রী হলো সে।
মা কালক্ষেপন না করে যত দ্রুত সম্ভব ওকে কাজে লাগিয়ে দিলেন। আনাড়ি জুলেখাকে চেষ্টা করলেন তড়িঘড়ি কাজ শিখিয়ে দিতে যাতে ওর জন্য থাকা খাওয়ার বাবদ খরচটা পুষিয়ে নিতে পারেন শুরু থেকেই। বোকা জুলেখাও ঠিকঠাক শিখে নিতে শুরু করলো সবকিছু, বুঝে নিতে লাগলো নিজের বয়োসের চেয়ে বড় কোন দায়িত্ব। মাত্র সাত বছর বয়সে ওকে জলান্জলি দিতে হলো সব চাওয়া আর পাওয়ার অধিকার, জলান্জলি দিতে হলো ওর ফেলে আসা ছোট্ট্ গ্রাম, সরু নদী , সবুজ মাঠ, দুরের নীল আকাশ, পরিচিত স্বজন-----, কারন ওর জন্মগত অভাব ছিলো।
এভাবেই বয়োসি হতে লাগলো জুলেখার জীবন। খুব সকালে সবার প্রথমে জেগে ওঠা ওকে ঘুমোতে যেতে হয় মধ্যরাতে, সবার শেষে। এই নিয়ম সাতদিনের। কোন ছুটি নেই ওর, আমাদের যেমন থাকে। ঘরের কোনে মেঝেতে কোনরকম ছেড়াফোড়া একটা বিছানাই প্রতিনিয়ত রাত্রিযাপন। বছরে দুটো কাপড় তাও অনেক সস্তার, আর বেশী হলে কারো ব্যবহৃত পুরাতন কাপড়। কোন প্রসাধন নেই, যদিও ওরও খুব সাজতে ইচ্ছা করে যেমন করে সাজে এ বাড়ির আফারা, ভাবিরা। মাঝে মাঝে ভিরুমনে সেও দাড়াই ড্রেসিং আয়নার সামনে, চুরি করে ঠোটে লাগাই লিপিষ্টিক, গালে পাওডার, নিজেকে দেখে খুব গোপনে------,নিজেকে দেখা তাও চুরি করে। হায়--------!
এই মোটামুটি জুলেখা। কখনো স্কুলে না যাওয়া , অশিক্ষিত, আমাদের সস্তা দরের কাজের মেয়ে। কিন্তু গল্পটা ঠিক অন্যখানে।
নাগরিক আয়োজনে ব্যাস্ত আমি ওর খবর ঠিক রাখিনি কখনো। সংসারের আর সব প্রয়োজনিয় আসবাবের মতো ও ছিল আশেপাশে, তবু ঠিক যেন গোচরে ছিলনা। জুলেখার আসলে কেও ছিলনা। জন্মের ঠিক পরপরই হারিয়েছিল বাবা-মা কে। নিষ্ঠুর অবহেলা, অভাব এবং কষ্টে বড় হয়েছিল আর সব ভাই-বোনদের সাথে। এটা কি আসলেই বড় হওয়া?
ভাইবোনের অভাব নেই জুলেখার, কারন ওর মুর্খ-অশিক্ষত বাবা, মানুষ চাষ করেছিল বেহিসাবি । শুধু নেই ওর ভরনপোষন দেবার আর খোঁজ খবর রাখার মতো আপনজন। অভাবক্লিস্ট ভাইবোনদের নিজেদের জীবনটাই এত বেশি ভারি যে অন্য কারো জীবনের ভার নেবার সাহস করেনা কখনো।
তবু জুলেখার খোঁজ হয় ছমাসে-বছরে একবার। মাস শেষে ও খুব সামান্যই বেতন পায় । বাড়তি কোন খরচ নেই বলে টাকাটা জমে আমার মায়ের কাছে, কখনো বড় অংক দাড়াবে এ আশাই, হয়তো কখনো জীবন নিশ্চিত হবে এই স্বপ্নে। কিন্তু হায়, টাকার অংকটা বেড়ে ওঠার আগেই ভাই বোনদের কেওনা কেও এসে দাড়াই জুলেখার সামনে, শোনাই দারিদ্রতার গল্প। ভোলাতে চাই ওকে। বোকা জুলেখা গলে যায়, তারপর উজার করে দেয় নিজের সন্চিত যা কিছু, শরীর খাটিয়ে উপার্জনের পুরোটাই।ও নিশ্বঃ হয়, ফিরে যাই কোন তৃপ্ত মুখ আবার আসবে বলে।
গল্পটা ঠিক এখানেই।
শুধুমাত্র কিছু খাদ্য আর পোষাকের বিনিময়ে টেনে নিয়ে যাওয়া এ জীবনের আসলে মানে কি? ঠিক কতদুর যেতে পারে এমন জীবন? আমরাও ঠিক কোথাই আছি, এই ভন্ড শহুরে মানুষেরা?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৩:৪৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





