এ দেশে কী বলা যাবে, কী যাবে না, তা নির্ধারিত হয় অন্যদের সিদ্ধান্তে। রাষ্ট্র নয়, নাগরিকই এখানে প্রতিপক্ষ অন্য নাগরিকের। সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিই। একজন বড় সম্পাদক ফোন করতেন মাঝেমধ্যে। অন্তত একটি লেখা দিতেই হবে তাঁকে। তিনি বলেন, ‘যা খুশি লিখেন, যা আপনার ইচ্ছা হয়।’
আগের দিন টিভিতে দেখেছি, বিএনপি আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবরের দুর্ভোগ। পুলিশের সাহায্য নিয়ে বিধ্বস্ত শরীরে হাঁফাতে হাঁফাতে চলছেন তিনি আদালতে। আদালত তবুও বারবার রিমান্ডে দিয়ে চলেছেন তাঁকে। বাবরের যা অবস্থা, তাঁর আর টেকার কথা নয় বেশি দিন। আমি সম্পাদককে বলি, বাবরের রিমান্ড নিয়ে লিখব। আঁতকে ওঠেন তিনি— এটা লিখবেন! লোকজন কী ভাববে? বোঝানোর চেষ্টা করি তাঁকে। বাবর অপরাধী হলে তাঁর অবশ্যই সমুচিত শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু প্রায় মুমূর্ষু একজন মানুষকে এতবার রিমান্ডে নেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন। তা ছাড়া রিমান্ডের বিষয়ে হাইকোর্টের যে নির্দেশনা আছে, সেটা পালন করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখাও আদালতের কর্তব্য। তিনি আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু অন্যরা কী ভাববে এ নিয়ে বিব্রত তিনি। ‘অন্যদের’ চটানোর সাহস নেই তাঁর। আমাকে আর লিখতে অনুরোধ করাও বন্ধ করে দেন এরপর। সেই পত্রিকায় আমার আর লেখা হয়নি।
অতএব, এ ধরনের পত্রিকায় বাবরের বিষয়ে বলতে মানা। অতি প্রগতিশীলেরা রুষ্ট হন—এ রকম আরও কিছু বিষয়ে লিখতে মানা। বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে সত্যিকারের ইতিহাস চর্চা মানা। শেখ হাসিনার মামলা কেন প্রত্যাহার হলো, সজীব ওয়াজেদ জয় কেন ক্ষমতাবান—এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে মানা। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইনটির আরও সংস্কার প্রয়োজন—এটি লিখতে মানা। ভারতীয় সীমান্তে বাংলাদেশিদের নির্বিচারে মেরেই চলেছে, তা বলতে মানা।
মানা আছে অন্য পক্ষেও। মনে আছে, টিভিতে একবার বলেছিলাম, ‘তারেক রহমানকে দেখে শহীদ জিয়ার সন্তান মনে হয় না, মনে হয়, মামুনের বন্ধু।’ বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত একজন সাংবাদিক ফোন করে জানান, বিএনপির লোকজন দারুণ খেপেছেন এতে। এসব কী বলি আমি! মনে মনে আরেকটা লিস্ট করি। তারেক রহমান বিএনপির এবং দেশের কী কী ক্ষতি করেছেন, তা কোথাও কোথাও বলতে মানা। খালেদা জিয়া কীভাবে জিয়ার রাজনীতি, আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব থেকে বিচ্যুত্ হয়েছেন, তা লিখতে মানা। বিএনপির আমলে কেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন, তা নিয়ে অনুসন্ধান করা মানা, জামায়াতের বর্বরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানা। বিএনপি এখন ক্ষমতায় নেই। এখন হয়তো আপাতত বলা বা লেখা যাবে অ-বিএনপি পত্রিকা বা টিভিতে। কিন্তু ক্ষমতায় এলেই এসব লেখালেখির মাসুল দিতে হবে। জেলখানায় পচতে হবে কিংবা দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।
মানা মানে যে সরাসরি মানা, সব সময় তা নয়। তবে এসব নিয়ে লিখলে বা বললে নানা রকম বিপদ হতে পারে। সবচেয়ে বড় ভয়, ভুল বোঝাবুঝির শিকার হওয়ার। আওয়ামী লীগের স্তাবক না হলে বিএনপি কিংবা রাজাকারের লেবেল দিয়ে দেওয়া হবে এক পক্ষ থেকে। বিএনপির স্তাবক না হলে ভারতের দালাল বলে গালি দেবে অন্য পক্ষ।
অতি প্রগতিশীল বা অতি প্রতিক্রিয়াশীলদের থেকে রক্ষা নেই। মাঝামাঝি কিছুতে বিশ্বাস নেই তাদের।
- ড. আসিফ নজরুল

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





