একি বললেন পানিসম্পদমন্ত্রী!
পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন বলেছেন, পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগে দলীয় লোকজন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও পুলিশ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য দলীয় ছেলেমেয়েদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও বর্ষীয়ান এ আওয়ামী লীগ নেতা চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করার ঘটনা উল্লেখ করে বলেছেন, সরকার আরো কয়েকটি চ্যানেল বন্ধ করার চেষ্টা করছে। তাঁর মতো পূর্ণ মন্ত্রীরা কোনো দুর্নীতি করেন না, তবে প্রতিমন্ত্রীদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার ইঙ্গিত করেছেন তিনি।
গত ১২ মে সন্ধ্যায় ঠাকুরগাঁও জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। সেখানেই তিনি এসব কথা বলেন। সরকারের একজন কেবিনেট মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে খোদ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। মন্ত্রীর এ বক্তব্য সপ্তাহজুড়ে টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়। ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের 'চাপে' কোনো সাংবাদিক মন্ত্রীর বক্তব্যের এ সংবাদটি খবরের কাগজে পাঠাননি। কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও নয়। সম্মেলনে অংশ নেওয়া দলীয় কর্মীদের ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ থেকে মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে অনুসন্ধান করেই এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এসব বক্তব্যের সত্যতা জানতে চাইলে গত সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশে কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগে দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়োগের কথা আমি বলিনি। তবে যুবকদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের কথা বলেছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধ ও প্রতিমন্ত্রীদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে মন্ত্রী দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সাংবাদিকতা করার অনুরোধ জানান।
ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহামুদ চৌধুরী এমপি, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি দবিরুল ইসলাম, সাবেক এমপি ইমদাদুল হক, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা কামরুল হাসান খোকন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন প্রমুখ। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ইসরাফিল আলম বিশাল। সম্মেলনে জেলার পাঁচটি উপজেলা থেকে দুই সহস্রাধিক ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
এসব নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে মন্ত্রী বলেন, 'কিছু দিন আগে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যে সার্কুলার আমরা দিলাম, তার সবই আমাদের। এক-আধটা হয়তো স্লিপ হতে পারে ভুলক্রমে, ঠিক জানি না। তবে সবই আমাদের। পুলিশের চাকরিগুলোও ঠিক এভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমাদের ছেলেদের। আরো এই যে ২০ তারিখে পুলিশের চাকরির নিয়োগ হবে, অবশ্যই আমরা আমাদের নিজেদের ছেলেদের দেওয়ার ব্যবস্থা করব। তা ছাড়া সামনে এই ১৮ তারিখ থেকে আমাদের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ হবে। হেড মাস্টার নিয়োগ হবে। সেগুলোর আমরা তথ্য নিচ্ছি। এই তথ্যগুলো নেওয়ার পরে আমরা অবশ্যই আমাদের ছেলেদের প্রাধান্য দিয়ে কাজ করব।'
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সরকার বিভিন্ন শূন্যপদে লোক নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তর, পুলিশ, স্বাস্থ্য সহকারীসহ বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এসব পদে লোক নিয়োগে দলীয়করণের অভিযোগ ওঠে। ছয় হাজার ৩৯১ স্বাস্থ্য সহকারী পদে লোক নিয়োগের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পুলিশের এসআই পদে নিয়োগ পেতে ব্যাপক তদবির শুরু হয়েছে। এসব তদবির সামাল দিতে পদ সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে ৪০০ পদে এসআই নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পরে তা বাড়িয়ে এক হাজার করা হয়েছে। এসব অতিরিক্ত এসআই নিয়োগের জন্য আলাদা কোনো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়নি। সাব-ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করার পরপরই পুলিশের কনস্টেবল, সহকারী পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) ও সাব-ইন্সপেক্টর পদে ১৩ হাজার ৩৯১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব পদে ১৫ হাজার শূন্যপদ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু সাব-ইন্সপেক্টরেরই দেড় হাজার পদ শূন্য রয়েছে। দলীয় নেতাদের চাকরি দিতে না পারায় ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের নিয়োগ প্রক্রিয়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে কম্পট্রোলার অব অডিটর জেনারেলের প্রায় এক হাজার পদে নিয়োগ।
পানিসম্পদমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে মিডিয়ার কঠোর সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে জানান, চ্যানেল ওয়ানের মতো আরো কয়েকটি চ্যানেল বন্ধ করার চেষ্টা করছে সরকার। গত ২৭ এপ্রিল তরঙ্গ বরাদ্দের শর্তভঙ্গ করার অভিযোগে সরকার চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়। যমুনা টেলিভিশনেরও সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।
মন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, 'আমরা এত উন্নয়নের কাজ করছি, সব কি মিডিয়ায় আসে, আসে না। দু-একটি পেপার-পত্রিকা আমাদের কাজ করে। বাকিগুলো আমাদের বিপক্ষে কাজ করে। এর কারণ বিএনপি-জামায়াত সরকার প্রতিদিন ১৫ লাখ টাকা খরচ করে, যেটা চিন্তাই করা যায় না। এই যে মিডিয়াগুলো আছে, লক্ষ্য করে দেখবেন, যখনই খালেদা জিয়ার নাম আসে তখন সময়টা বেশি দেয়। যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো প্রোগ্রাম আসে তখন সময় কম দেয়। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, যেমন_চ্যানেল ওয়ান বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে আরো কিছু চ্যানেল আমরা বাতিল করে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি।'
বক্তব্যে রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, 'আমরা ২৩-২৪ জন যে কেবিনেট মন্ত্রী আছি, কেউ বলতে পারবে না আমরা কেউ ১০ টাকা খেয়েছি। প্রতিমন্ত্রীদের বেলায় আমি বলতে পারব না। তাঁরা আমাদের অধীনে থাকেন। চেষ্টা করি তাঁদের ভালো করে রাখার।'
ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রলীগের নতুন সভাপতি জুয়েলের কাছে মন্ত্রীর এসব বক্তব্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'মন্ত্রীর বক্তব্যের সময় আমি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সেই মুহূর্তে উপস্থিত না থাকার করণে মন্তব্য করতে পারছি না।'
সম্মেলনে উপস্থিত একজন আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, পানিসম্পদমন্ত্রী এসব বক্তব্য দিয়ে সরকারকে বিব্রত করেছেন। তাঁর কথায় চাকরি বাজারের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে। মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়েও সতর্ক হয়ে মন্তব্য করা উচিত ছিল তাঁর।
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





