তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি ঢাকা কলেজে । একদিন ছোট খালার কাছ থেকে একজনের ফোন নাম্বার পেলাম । মেয়েটা আমাদের নাকি দূর সম্পর্কের আত্মীয় । শুধু জানতাম তার চোখ দুটি আকাশের মতো নীল । তার নাম হতে পারে নিলাঞ্জনা। ফোন নাম্বার পেয়েই তাকে ফোন দিলাম । তার সাথে সেদিন আধা ঘণ্টার মতো কথা হয়েছিল। সেদিনই বুঝেছিলাম ও আমার কতো আপনজন । এরপর ওর সাথে নিয়মিতই কথা হতো। ও আমার নাম দিয়েছিল কুদ্দুস আলী আর আমি ডাকতাম ওকে জমিলা বেগম নামে। ও তখন ক্লাস সেভেনে পড়ত তাই বাসায় কথা বলা খুব প্রবলেম ছিল। টি এন টি ফোনে কথা বলতাম দুজন। ফোন করলেই ওর মা ফোন ধরত । কতদিন গেছে সারাদিন ফোন দিয়ে গেছি একবারও ওকে পাইনি। বারবার ওর মা ফোন ধরত । ও হয়তো ফোনের পাশে বসে থাকতো ফোনটা ধরার জন্য কিন্তু বাচ্চা মানুষ ফোনটা ধরার সাহস পেত না। এমনই করে চলে গেছে অনেকদিন। ও কিন্তু তখনো আমাকে চিনতো না ।শুধু জানত আমি কুদ্দুস আলী আর ও জমিলা বেগম ।
ওর সাথে যেদিন দেখা হোল ও একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল উল্টো করে শাড়ি পড়ে। কতো বোকা ছিল ! শাড়ি যে সোজা করে পড়তে হয় তাও সে জানত না ।সেদিন ওর সাথে কথা হয়েছিল অনেকক্ষণ । সেদিন বুঝেছিলাম ও তো আমার জন্যই ।এরপর আমাদের নিয়মিতই কথা হতো। কথা হতে হতেই একদিন ও আমাকে বলেছিল ও আমাকে ভালোবাসে । সেদিন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ছিলাম আমি । সেদিন ওকে নিয়ে লিখেছিলাম ...
চন্দ্রিমা রাত্রিতে রুপালি চন্দ্রতাপে
এক স্নিগ্ধ কোমল চাঁদের ছায়ায় , তুমি আসবে , তোমাকে আসতেই হবে
কারন আমি যে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি ।
এরপর আমাদের দিনগুলি ছিল স্বপ্নের মতো । কলেজে সারাক্ষণ ভাবতাম তার কথা । বন্ধুদের কাছে সবসময় ওর গল্প করে বেড়াতাম । বাসা থেকে ফোন দিলে মা ঝামেলা করতো তাই কলেজে রিকশায় না গিয়ে যেতাম বাসে। যে টাকা বাঁচত তা দিয়ে কখন ওকে ফোন দিবো সারাক্ষণ তাই ভাবতাম। এমন সপ্তাহ গেছে যতবার ওকে ফোন দিতাম ততবার ওর মা ধরত ।সারা সপ্তাহ ওর সাথে কথা হতো না। যেদিন ওর সাথে দশ-পনের মিনিট কথা হতো সেদিন মনে হতো দুনিয়াটাই মনে হয় আমার । যা খুশী তাই করতে চাইতাম । এমনই করে দিনগুলি চলছিলো প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে। এর মধ্যে ওর সাথে দেখা হয়েছিল ২ বার ।
আমি তখন ইউনিভার্সিটি তে পড়ি। আগেরদিন ওর সাথে কথা হয়েছিলো , ও বলেছিল ওর সাথে দেখা করার জন্য । সকালে চলে এসেছি ক্লাস এ । আমার কাছে তখন বাড়তি কোন টাকা ছিল না । এক বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে চলে এসেছিলাম ওর সাথে দেখা করতে । ও আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো ওর এক বান্ধবীর বাসায়। ওর জন্য এক বাক্স চকলেট আর একটা কার্ড নিয়ে গেছিলাম। দুজন একসাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। আসার সময় ও বলেছিল ওর হাত টা একটু ধরতে । আজ ৮ বছর হইছে সেই সময় ধরা নরম ,ভয়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে থাকা হাতের স্পর্শ এখনো ভুলিনি। এরপর ওর সাথে আরও একবার দেখা হয়েছিলো। সেই দিনগুলি ভুলতে পারিনি আজও।
এমন করে আমাদের সম্পর্কটা ছিল ছয় বছর ।ও আমাকে কখনো তুমি করে কথা বলেনি। সবসময় তুই করে বলতো , যাতে ওর মা বুঝতে না পারে কার সাথে কথা বলছে। এই তুই বলার অভ্যাসটা ওর কখনো যায়নি। আমি ওরে অনেকভাবে তুমি করে বলতে বললেও ও কখনো সেতা করেনি । রাগ , অভিমান , অনুরাগ মিলে ভালই কাটছিল আমাদের জীবন। কেমন করে যেন এই জীবনের সুতা টা একদিন ছিঁড়ে গেল। ও আমাকে কখনো বলেনি কেন এমন করল , শুধু বলেছিল ওর পক্ষে সম্পর্ক রাখা সম্ভব না । ওকে অনেক বুঝাইছি , বুঝেনি । একদিন ওর বাসার ফোনটাও বন্ধ হয়ে যায়। ওর সাথে সম্পর্ক রাখার আর কোন উপায় ছিল না। ২ বছর পর একদিন ও আমাকে ফোন দিয়া অনেক কাঁদছিল । কিন্তু সে কান্না কিসের জন্য তা আমাকে বলেনি।
এরপর ১ বছর আমার সাথে ওর কোন যোগাযোগ ছিল না। মাঝে মাঝে বিভিন্ন ভাবে ওর খবর নিতাম। ও নাকি অনেক বড় হয়েছে, ইউনিভার্সিটি তে পড়ে। একদিন হটাৎ করে ওর ফোন,শুধু অবাক হয়েছিলাম। এরপর আমাদের নিয়মিত ফোনে কথা হত।তখন ভাবতাম পুরানো ছিঁড়ে যাওয়া সুতাটা আবার হয়তো জোড়া লাগবে। কিন্তু তা আর হয়নি। কেন জানি ও সব ভুলে গেছে। খুব মন খারাপ হলেই মাঝে মাঝে আমাদের কথা হয় । নিলাঞ্জনা সব ভুলে হয়তো নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। নতুন করে ভাবতে শিখেছে। কিন্তু আমি এখনো অপেক্ষায় আছি একদিন নিলাঞ্জনার ঘুম ভাঙবে । কোন এক সকালে আমাকে ফোন দিয়ে বলবে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করা যায় না????
“আমার দুঃখগুলোকে স্পর্শ করে এই যন্ত্রণার পাহাড়টাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে গভীর আবেশে। আমার জলে ভেজা চোখে চোখ রেখে জলমগ্ন দ্বীপের জলমগ্নতা ভুলে যাবে।”