somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিবর্তনের সহজ পাঠ ৩: বৈচিত্র্য ও প্রজাতির উৎপত্তি

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিবর্তনের সহজ পাঠ ১: জৈব-বিবর্তন পরিচিতি
জৈববিবর্তনের সহজ পাঠ ২: মিউটেশন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন

বিবর্তনের মাধ্যমে বৈচিত্র্য সৃষ্টিঃ


আগের দুই পর্বে জৈব-বিবর্তন কি এবং কিভাবে ঘটে তা আলোচনা করেছিলাম।জৈববিবর্তনের ফলে যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয় সেটা আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাই। আমাদের গোটা মানবজাতি একই প্রজাতিভুক্ত। নর্ডিক, জার্মান, ইতালিয়ান, আরব, চায়নিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ, ইথিওপিয়ান, নুবিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, মারাঠি, বাঙালি সকল জাতিরই পূর্বপুরুষ একই। অথচ এই জাতিগুলোর দৈহিক কিছু সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর দৈহিক বৈশিষ্ট্য যেহেতু জন্মগত, তাই এগুলো জেনেটিক কোড থেকেই উৎসারিত। প্রশ্ন হচ্ছে, একই পূর্বপুরুষ থেকে উৎপন্ন মানবজাতির মধ্যে এত ভ্যারিয়েশনের কারণ কি? এককথায় উত্তর হচ্ছে, জৈব-বিবর্তন।

মানুষ যখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরলো, মিউটেশনের কারণে বৈচিত্র্যও বাড়তে লাগলো, কিন্তু ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে জিন আদান প্রদান সম্ভব হলো না। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিচ্ছিন্ন মানবগোষ্ঠিগুলোর জেনেটিক কোড আলাদা আলাদা ভাবে পরিবর্তিত হওয়ার কারণে আলাদা বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট রূপ ধারণ করলো। সাথে আলাদা আলাদা প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে প্রাকৃতিক নির্বাচনও চললো। কালচারাল কারণে কৃত্রিম নির্বাচনও হয়েছে অনেক। আর এসব কারণেই মানবজাতির মধ্যেও তৈরী হয়েছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য।

বিবর্তনের মাধ্যমে কি নতুন প্রজাতি তৈরী সম্ভব?:


প্রজাতি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা আর জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ধারণার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে কুকুর এবং নেকড়ে আলাদা প্রজাতি হলেও জৈব-শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে তারা উভয়েই একই প্রজাতিভুক্ত (Canis lupus)। আবার আমাদের দৃষ্টিতে হাতি একই জাতিভুক্ত মনে হলেও আফ্রিকান বনের হাতি , আফ্রিকান সাভানা হাতিএশিয়ান হাতি সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতি।



তাহলে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রজাতি কি? প্রজাতি হচ্ছে বৈচিত্র্য পরিমাপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক। একই প্রজাতিভুক্ত জীবেরা শুধু জেনেটিক কোডই শেয়ার করে না, তারা নিজেডের মধ্যে প্রজননকাজেও অংশ নেয়। এককোষী বা অকোষীয় জীব, যারা যৌন প্রজনন করে না, তাদের ক্ষেত্রে প্রজাতির সীমা নির্ধারণ করা কষ্টকর। তবে যৌন প্রজননকারী জীবের ক্ষেত্রে প্রজাতির সংজ্ঞা সাধারণত এভাবে দেয়া হয়:
একটি প্রজাতি হচ্ছে সেসকল জীবসমষ্টি, যারা নিজেদের মধ্যে প্রজনন করে প্রজননক্ষম সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম।

উদাহরণস্বরুপ: দুটি বিপরীত লিঙ্গের গরু প্রজননের মাধ্যমে যে বাছুর জন্ম দেয়, যেটি বড় হয়ে আবার প্রজনন করতে পারে। তাই গরুরা সব একই প্রজাতির। আবার ঘোড়া ও গাধা সংকরায়ন করে খচ্চর, বা বাঘ ও সিংহ সংকরায়ণ করে লাইগার/টাইগন জন্মানো সম্ভব হলেও তারা সকলেই অনুর্বর, অর্থাৎ প্রজনক্ষম নয়। একারণে ঘোড়া ও গাধা, বা বাঘ ও সিংহ আলাদা প্রজাতি।

কিন্তু প্রজাতির এই সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে রিং স্পেসিস নামের একটি বিশেষ অবস্থা (রিং স্পেসিস নিয়ে পরের পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করবো)। রিং স্পেসিস এর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, দুটি জীবগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে প্রজননে অক্ষম হলেও তাদের মধ্যবর্তী কিছু ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে জিন আদান-প্রদান সম্ভব। তাই তাদেরকে একই প্রজাতিভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ, টাইপ এ ও টাইপ ডি হয়তো নিজেদের মধ্যে প্রজনন করে উর্বর সন্তান জন্মাতে পারে না, কিন্তু টাইপ এ পারে টাইপ বি এর সাথে, টাইপ বি পারে টাইপ সি এর সাথে, টাইপ সি পারে টাইপ ডি এর সাথে। এভাবে কয়েক প্রজন্ম পরে টাইপ এ-টাইপ-ডি উর্বর সংকর সম্ভব, যদিও তাতে বি ও সি এর জিনও থাকবে।

রিং স্পেসিসকে আওতায় ধরলে উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতির সংজ্ঞা দাড়ায়ঃ প্রজাতি হচ্ছে এমন একটি জীবগোষ্ঠী, যাদের মধ্যে প্রজন্মান্তরে জিন আদান-প্রদান ঘটে।

বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতি তৈরী বিভিন্নভাবে হতে পারে। আফ্রিকান হাতি ও এশিয়ান হাতির মধ্যে অনেক বৈশিষ্ট্যে মিল থাকলেও কিছু অমিল থাকার কারণে তারা পরস্পরের সাথে প্রজননে অক্ষম হয়েছে। সুতরাং, কোন জীবের দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য বাড়তে বাড়তে এরা নিজেদের মধ্যে প্রজননে অক্ষম হয়ে পরলেই নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হতে পারে।

ক. ধরুন, একটি প্রজাতি মিউটেশন ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করছে। কিন্তু একই স্থানে থাকা এবং প্রজননের কারণে বৈশিষ্ট্যগুলো সবার মধ্যেই ছড়িয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রজাতিটি নতুন প্রকরণের জন্ম না দিলেও আস্তে আস্তে সবাইকে নিয়েই আদি অবস্থা থেকে পরিবর্তিত হতে থাকবে, এবং একসময় আদি অবস্থা থেকে ভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত হবে। এক্ষেত্রে আদি প্রজাতিটি বিলুপ্ত হলো না, কিন্তু বিবর্তিত হয়ে অন্য প্রজাতিতে পরিণত হলো। আদি প্রজাতির কোন সদস্য যদি আদি বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকতো, তবে নতুন প্রজাতির সাথে সফল প্রজনন করতে পারতো না।

খ. ধরুন, একটি প্রজাতির দুটি আলাদা জনগোষ্ঠি ভৌগোলিকভাবে আলাদা স্থানে বসবাস শুরু করলো। বিবর্তনের কারণে তাদের পরিবর্তনগুলো শেয়ার করা সম্ভব হলো না, অর্থাৎ জিন-ফ্লো বন্ধ থাকলো। সময়ের সাথে সাথে এদের মধ্যে পার্থক্য প্রকট হয়ে আলাদা দুটি প্রজাতির সৃষ্টি হবে। একটি প্রজাতি হয়তো আদি প্রজাতির বৈশিষ্ট্য বেশি করে ধারণ করে সেই প্রজাতির অংশই থাকতে পারে, আবার সম্পূর্ণ নতুন দুটি প্রজাতিও তৈরী হতে পারে।

গ. উপরের উদাহরণের রিং স্পেসিসের ক্ষেত্রে ধরুন, টাইপ বি বা টাইপ সি হটাৎ কোন কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেল। টাইপ এ ও টাইপ ডি যেহেতু নিজেদের মধ্যে সফল প্রজনন করতে পারে না, আবার তাদের মধ্যে জিন আদান প্রদানের মাধ্যম যেহেতু বিলুপ্ত, তাই তারা আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হলো।

[চলবে......]
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২৩
১৪টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×