জাহিদুর রহমান, ঢাকা থেকে : পরিবেশ দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন পরিবেশবিদ ও নগর বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা। সূত্র ফোকাস বাংলা।
বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী পরিবেষ্টিত ঢাকায় বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার জন্য ছিল ৪৩টি খাল। খাল দখল করে শহর বাড়ানো হয়েছে, পাশাপাশি শুরু হয়েছে নদী দখলের প্রতিযোগিতা। নদী খেকো দস্যুরা নদীর পাড়ে অবৈধ স্থাপনা গড়ে বা গড়তে দিয়েই ক্ষান্ত হইনি, নগরীর বর্জ্য ফেলে ফেলে ভরাট করছে নদীর বুক, বিষাক্ত হয়েছে নদীর পানি। পরিবেশ দূষণের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী দশ বছরে ঢাকা পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। এর আগে জাতিসংঘের একটি মূল্যায়ন নিরিখে বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় ‘কনজাস্টেড’ নগরীতে পরিণত হবে ঢাকা।
১ কোটি বাসিন্দা ছাড়াও এই রাজধানী শহরে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করছে অসংখ্য মানুষ। ফলে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন বর্জ্য সৃষ্টি হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ এই বর্জ্যের কারণেও ঢাকা নগরী মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। কারণ আধুনিক নগরীতে কার্যক্রম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। নগরীতে প্রয়োজন ২৬০ বর্গকিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন, কিন্তু রয়েছে মাত্র ১৫০ বর্গকিলোমিটার। তার ওপর বছরের পর বছর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ লাইনের বিরাট অংশই ভেঙে গেছে কিংবা ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়েছে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মাতুয়াইলে যে একটি ল্যান্ডফিল রয়েছে, সেখানে ১৭ ’শ টন বর্জ্য দৈনিক ফেলা হচ্ছে। বাকি ১৩শ’ টন বর্জ্য রাজধানী ও তার আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। ডিসিসির নিয়ন্ত্রণাধীন রাজধানীতে বর্তমানে ৪ হাজার ৫০০ ডাস্টবিন, এগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। ডাস্টবিন উপচে যত্রতত্র বর্জ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থেকে দূষণ ঘটাচ্ছে পরিবেশের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ফোকাস বাংলা নিউজকে বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে বিপর্যস্ত মহানগরী ঢাকা। তিনি ঢাকাকে রক্ষা করতে রাজধানীর ন্যায় সকল সুযোগ-সুবিধার সমন্বয় ঘটিয়ে প্রতিটি বিভাগীয় শহরকে স¤প্রসারিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট যশোরসহ প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় শহরকে রাজধানীর আদলে গড়ে তুলতে পারলে নগর কেন্দ্রিকতা বহুলাংশে কমে আসবে। শহরের পরিধি বাড়লে রাজধানীর উপর জনসংখ্যার চাপ কমবে। একই সঙ্গে রাজধানী ঢাকা থেকে অফিস আদালতসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিতে হবে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ঢাকাকে পুনরায় মানুষের বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, রাজধানী ঢাকায় ৬০ শতাংশ আবাসন নির্মাণে কোনো পরিকল্পনা কিংবা নিয়ম অনুসৃত হয় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতার কারণে প্রতি বছর তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। নিরুপায় এইসব উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠী শহরে এসে আবাসন ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে প্রতি বছর। তিনি বলেন, আজ আমরা ঢাকা নগরীর যে সম্প্রসারিত চেহারা দেখি, তার অনেকখানি অপরিকল্পিত নগরায়নেরই কুফল। ঘুরিয়ে বলা যায়, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে উন্মুক্ত ঢাকার অনেকটাই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, খালবিলের মাটি নরম। কিন্তু ঢাকায় সেগুলো অবাধে ভরাট করে ভবন তৈরি করা হচ্ছে। এসব ভবন তৈরিতে প্রকৌশল ও স্থাপত্য জ্ঞানের প্রয়োগ হয়েছে কি না, কিংবা মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে কি না তা পরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্যই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, রাজধানীর পরিবেশ দূষণ এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, তা রোধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের পরামর্শ চেয়েছেন।
সাংবাদিক মাহফুজ আনাম বলেন, দেশের জন্য শিল্প এবং দূষণমুক্ত পরিবেশ উভয়ই প্রয়োজন। দু-টোর মধ্যে এমনভাবে সমন্বয় করতে হবে যাতে দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। তিনি বলেন, বর্তমানে শিল্পসহ অন্যান্য বর্জ্য নির্গত হওয়ায় বুড়িগঙ্গা ময়লা বহনকারী ড্রেনে পরিণত হয়েছে। রাজধানীবাসী নদীর বা ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহার করতে না পারায় ভূগর্ভস্থ পানির উপর অত্যাধিক চাপ পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় ঢাকার ভূগর্ভ পানি শূন্য হয়ে পড়বে। তখন আরও মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। ফলে নদী দূষণ রোধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন এর সদস্য ও সাংবাদিক মশিউর রহমান রুবেল বলেন, ঢাকাকে এবং ঢাকার মানুষকে বাঁচাতে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। কোনো প্রতিহিংসা চরিতার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থ নয়-সব সিদ্ধান্তই আসতে হবে জনগণের স্বার্থে।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী রাজধানী ঢাকাকে সবার জন্য বাসযোগ্য একটি আধুনিক, পরিকল্পিত, ঝুঁকিমুক্ত এবং পরিবেশ ভারসাম্য মহানগরীতে গড়ে তোলার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা দ্রুত বাস্তবায়িত হবে। সেখানে অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও দেশের কোটি সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের জীবন নিরাপত্তা, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিষয় অধিক গুরুত্ব পাবে। রাজধানীর প্রায় দেড় কোটি মানুষ মৃত্যুঝুঁকি থেকে মুক্তি পাবে।
রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে ঢাকা। ঢাকায় নির্মিত শতকরা ৯০ ভাগ ভবনই রাজউকের নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মিত। তিনি বলেন, বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া রাজধানী ঢাকাকে রক্ষা করা সম্ভব। চেয়ারম্যান বলেন, রাজধানী ঢাকাকে মানুষের বসবাসের যোগ্য করে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাজউক ঢাকা মহানগরীর মহাপরিকল্পনা হিসাবে ডিটেইলড এরিয়া প্লান (ড্যাব) হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক পর্যায়ে ১৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চলতি মাসেই প্রকাশিত হবে। রাজউক চেয়ারম্যান রাজধানীকে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সংস্থা ও ডেভেলপার কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
রিহ্যাব সভাপতি প্রকৌশল তানভিরুল হক প্রবাল বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসাবে গড়ে তুলতে হলে পরিকল্পিত নগরায়নের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ঢাকায় যেভাবে সমন্বয়হীনতার সাথে বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠাসহ হু হু করে জনবল বাড়ছে তাতে করে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ঢাকা পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হবে। প্রতিদিন ঢাকার রাজপথে অসংখ্য মানুষ নেমে আসে জীবন ও জীবিকার অন্বেষায়। রিহ্যাব সভাপতি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থা ইআইইউ’র এক রিপোর্টে বিশ্বের ১৪৪টি শহরের উপর যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, বাসযোগ্যতার বিবেচনায় সবচেয়ে খারাপ শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। দূষণের কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ঢাকা। যানজট নগরবাসীর জীবন থেকে প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে মূল্যবান সময়। রিহ্যাব চেয়ারম্যান ঢাকার মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন, ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা জোরদার, সুস্থ সুন্দর এবং পরিকল্পিত আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত নগর গড়ে তুলতে সরকারের পাশাপাশি ডেভেলপারদের নগর উন্নয়নের কাজে সম্পৃক্ত করে পাবলিক প্রাইভট পার্টনারশীপ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান বলেন, জনসংখ্যার চাপে ঢাকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া ঢাকাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি ৮২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৬০টিই ঢাকায়। ৩৮টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে ৩২টিই ঢাকায়। দেশের সেরা স্কুল, কলেজ, সরকারি সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভিন্ন বিভাগের প্রধান কার্যালয়, বেসরকারি বড় বড় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান এই শহরে। প্রধান প্রধান ও বিশেষায়িত সব হাসপাতাল, ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিদেশি দূতাবাস, শিল্প কলকারখানা, গার্মেন্টস ঢাকায় অবস্থিত। এসব কারণে দেশের মানুষকে ঢাকামুখী করছে। তিনি বলেন, ঢাকাকে রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজধানীর বাইরে স্থানান্তরিত করা দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





