কাজের ব্যস্ততায় কয়েকদিন আমার আত্মজীবনীমূলক ধারাবাহিক রচনা একজন সাবেক শিবিরের (বর্তমানে জামাতী) আত্মকাহিনী লিখতে পারিনি। আজকে থেকে আবার শুরু করলাম।
৭. রাজাকারের মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসা
স্কুলে পড়ি, ক্লাস সেভেনে। এক ছুটির দিনে ছোট মামা এলেন সকাল বেলা। তিনি কাজ করতেন রাজশাহীর একটি সরকারী অফিসে। আপনাদেরতো বলাই হয়নি আমার বাবার বাড়ীর মতো আমার নানার বাড়ীর সবাইও জামাতে ইসলামীর একনিষ্ট ভক্ত। ছোটরা শিবির বড়রা জামাত এটা আমাদের মাতুল ও পিতৃ পরিবারের ঐতিহ্য।
নাস্তা করার সময় বড় চাচা রসিকতা (আমার জামাতী বড়ভাই শব্দটি রশিকতা লিখেন, উনি আবার বিরাট ইঞ্জিনিয়ার, কিছু দিন ডাক্তারিও পড়েছেন, বোর্ড ষ্ট্যান্ড করা ছাত্র। উনারতো ভুল হওয়ার কথা নয়, আমার মনে হয় আমারটাই ভুল) করে বললেন, কি বেয়াই এই অবেলায় দেখা! মামা বললেন, তিনি একটা কাজে এসেছেন। অফিসে একটা সুযোগ এসেছে। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দেখাতে পারলে বেতন বাড়বে। তিনিতো ছিলেন জাত রাজাকার। আবার বেতন বাড়ার সুযোগটাও হারাতে চান না। তিনি আমার বাবা এবং চাচার কাছে বুদ্ধি চাইলেন।
বিকালে মামা ও আমাকে নিয়ে আমার চাচা মতলব রাজকার গেলেন পরিচিত একজন রাজাকার কমান্ডারের কাছে। তিনি আবার জামাতে ইসলামীর ব্যানারে একবার এমপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন (নাম বললে আপনারা অনেকে তাকে চিনবেন)। তিনি বললেন কোন চিন্তা কইরো না সার্টিফিকেট ব্যবস্থা হবে। আসল মুক্তিযুদ্ধারা সার্টিফিকেট না পেলেও প্রকৃত রাজাকারদের মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট এর অভাব হয় না। তিনি আরো বললেন কিছুদিনের মধ্যে আমরা নিজেরাই মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট প্রকাশ্যে দেয়া শুরু করব। উনারা নাকি শীঘ্রই মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ গঠন করতে যাচ্ছেন। যাই হোক উক্ত রাজাকার কমান্ডার মামাকে একটা মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু উক্ত সার্টিফিকেট পরবর্তীতে ভেজাল প্রমাণিত হওয়ায় মামার বেতন বৃদ্ধিতো হয়নি উল্টো অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল।
ঘটনাটা হয়তো তেমন কিছুই নয়। কিন্তু, রাজাকারদের প্রতি আমার মনের মধ্যে যে স্থানটা ছিল, তা এই ঘটনায় তা আরো দৃঢ় হলো। আমি সেদিন দেখেছিলাম রাজাকারদের অসাধ্য এ দেশে কিছুই নেই। হোক না জাল তবুও তো তিনিই সার্টিফিকেটটির ব্যবস্থা করেছিলেন। সত্যি রাজাকারদের প্রতি শ্রদ্ধায় ভক্তিতে আমার মাথা নুয়ে আসে।
৮. নতুন বন্ধু নতুন আলো
ক্লাস নাইনের শুরুর দিকে ক্লাসে একজন নতুন ছেলে আসলো। তার বাবা সরকারী চাকুরী করে বিধায় তাকে নাকি প্রায়ই স্কুল বদলাতে হয়। তার সাথে আমার খুবই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
তার নাম ছিল মাসুদ। সে ছিল খুবই শান্ত স্বভাবের ছেলে। পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিল। আমি বেশী ভাল ছাত্র না হলেও আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হলাম। সে খুব হেল্পফুল ছিল। ক্লাস চলাকালিন যখন নামাজের সময় হতো আমরা সবাই মসজিদে চলে গেলেও সে কখনো মসজিদে যেত না। আমাদের বাসায় ছোট বেলা থেকেই নামাজের জন্য ছিল প্রচন্ড কড়াকড়ি। কিন্তু আমিও তার সাথে বসে থেকে মাঝে মাঝে নামাজ কামাই করতাম। ক্লাস শেষে মাঝে মাঝে আমরা হাঁটতে বের হতাম। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী। সে নদীর তীর ধরে আমরা হাটতাম আর গল্প করতাম। তার গল্পগুলো এত সুন্দর ছিল আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আর তার ছিল নানা বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য। আমার বয়সী একটা ছেলে এত কিছু জানে! মাঝে মাঝে তাকে দেখে আমার ঈর্ষা হতো।
ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার কোন আগ্রহ ছিল না। বাড়ীতে বই বলতে ছিল দু'একটা কোরান শরিফ, হাদীসের কিছু বই আর মাওলানা মওদূদী ও আমাদের নেতা গোলাম আযমের লিখিত কিছু বই। আমাদের বাড়ীতে গল্প-উপন্যাস, কবিতা, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম - ইত্যাদি বই এর কোন বালাই ছিল না। বন্ধু- বান্ধবের দেখাদেখি গল্প-উপন্যাসের প্রতি সামান্য ঝোঁক থাকলেও এগুলো পড়ার তেমন সুযোগ হতো না। শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এদের লেখা শুধু পাঠ্য বইতেই পড়েছি। তখন মানিক, বিভূতিভুষণ, গোর্কি কিংবা দস্তয়ভস্কির নামও শুনিনি।
পরীক্ষা শেষ হলে মাসুদ আমাকে তাদের বাড়ীর লাইব্রেরী থেকে কয়েকটা বই দেয়। বইগুলো অনেকটা এক নিঃশ্বাসে পড়ার মত পড়েছিলাম। সেই বইগুলোই পরবর্তীতে আমার জীবনে অনেক প্রভাব রেখেছিল, তা শুনাব পরবর্তীতে।
(চলবে ....)