৯.১ সেই সব বইগুলো
বন্ধু মাসুদ যে বইগুলো দিয়েছিল তা পড়ে মনে হলো, আমার মনের অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। অসম্ভব ধারালো যুক্তি ছিল বইগুলোতে।
একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, পারিবারিকভাবে আমরা অসম্ভব ধার্মিক ছিলাম। একটু খোলসা করে বলি। বাবা এক বেলা নামাজও কাজা করতেন না। মনে পড়ে মা একবার এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ দিয়েছিল বলে মাকে বাবার সে কি মার! মিলাদ পড়া, পীর-ফকির, মাজার - ইত্যাদি বাসায় লেগেই থাকতো। ছোটবেলায় অনেক কিছু যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাওয়ার একটা প্রবণতা আমার মধ্যে ছিল। কিন্তু বাবা জামাতে ইসলাম এবং ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন যুক্তি মানতে চাইতেন না।
বইগুলোতে অনেক শক্তিশালী প্রশ্ন ছিল। মহাবিশ্বের সৃষ্টি তত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন, যুক্তি ইত্যাদি বিষয়ে ছিল নানা প্রশ্ন। হঠাৎ বই গুলো পেয়ে একনাগাড়ে
পড়তে থাকলাম। মানিক, বিভুতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ, গোর্কী, দস্তয়ভস্কি নানা লেখকের বই। ও আমাকে আর একজন লেখকের বই দিয়েছিল নাম তার প্রবীর ঘোষ। ধর্ম বিশ্বাস অবিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার তত্ত্ব ছিল এ বইগুলোতে। কিন্তু বিধি বাম হঠাৎ একদিন বইগুলো বাবার হাতে পড়ে যায়। বাবার সে কি চিৎকার চেঁচামেচি আর কি প্রচন্ড মার যে দিয়েছিল ভাবলে এখনো শরীর ব্যাথা করে। এসব কাফের, ইহুদি, নসরাদের বই পড়ছি বলে বাবা আমাকে একদিন ভাত খেতে দেয়নি। মাসুদের অনেক গুলো বই বাবা পায়ের নীচে দিয়ে ছিড়ে ফেলেছিল।
বইগুলো আর মাসুদকে ফেরত দেয়া হয়নি। তখনকার পড়া বই এর অনেক কিছু আমার এখনো মনে পড়ে। আমার প্রায়শই মনে হয় বাবা যদি সেদিন এমন কঠোরভাবে এসব বই পড়তে বাধা না দিতেন তবে কি আমার জীবন টা অন্য রকম হতো ?
৯.২ শিবির জীবন
ক্লাস নাইনে উঠার পর শিবিরের সাথে ওৎপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেলাম। এর আগে শিবির করলেও তা ছিল কর্মী সমর্থক পর্যায়ে । ক্লাস নাইনে উঠার পর প্রথম নেতৃত্বের স্বাদ পেলাম। আমি তেমন ভাল ছাত্র না হলেও শিবির করার সুবাধে সকলেই আমাকে বেশ সমীহ করতো।আর পরীক্ষার সময়ও শিক্ষিকদের কাছ থেকে এক্সট্রা সুযোগ সুবিধা পেতাম।
শিবিরের নেতা হওয়া বেশ কিছু পরিবর্তন আসলো জীবনে। অনেক দায়িত্বও বেড়ে গেলো। আগে আমি একজন দায়িত্বশীল ভাইয়ের অধীনে ছিলাম বর্তমানে আমার অধীনেই অনেক কর্মী রয়েছে। আমাদের মাঝে মধ্যেই কর্মী বৈঠক করতে হতো। তাছাড়া ছিল দায়িত্বশীলদের বৈঠক। এটি ছিল একান্ত গোপনীয়। কেবলমাত্র নেতৃত্ব স্থানীয়রা এ বৈঠকে অংশ নেয়ার সুযোগ পেতো। এ বৈঠকে আমাদের দলের বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিষয়ে সিন্ধান্ত নেয়া হতো। শিবিরের প্রতিটি কাজকর্মই ছিল খুবই গোছালো। এলাকার কোন স্কুলে বা কলেজে শিবিরের দাপট কম বা অন্য দলের দাপট বেশী, কোন দলের কে শিবিরের জন্য হুমকি, কাকে কাকে টার্গেট করতে হবে ইত্যাদি সিন্ধান্ত নেয়া হতো দায়িত্বশীলদের বৈঠকে। শিবিরের অফিসে আরো একটি রুম ছিল যেখানে কিছু নির্বাচিত কর্মীদের বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দেয়া হতো। আমাদের ট্রেনার ছিল বোমা জামাল। আহা কি যে বুদ্ধি ছিল তার। বোমা বানাতে গিয়ে তার একটি হাত উড়ে গিয়েছিল। এক হতে বোমা জামাল এত সুন্দর ক্ষুর চালাতো আমরা অবাক হয়ে যেতাম। শরীরের কোন শিরা (রগ) কিভাবে কোন জায়গায় কাটতে হবে ইত্যাদি শিখাতো এই বোমা জামাল। যদিও শিবিরকে অনেকে ব্যঙ্গ করে রগ কাটা শিবির বলে কিন্তু আমার মনে হয় শিবিরের মতো এত নিখুঁত ভাবে প্রতিপক্ষকে কেউ সাইজ করতে পারে না। এই একটি ক্ষেত্রে আমরা এখনো অদ্বিতীয়।
শিবিরের আরেকটি সিস্টেম আমার জীবনে খুব ভালো প্রভাব ফেলেছিল। প্রতি মাসের শুরুতে পুরো মাসের একটা প্লান করতে হতো। কখন কোথায় কাকে সাইজ করবো, কাদের মিটিং পন্ড করা হবে, কাকে গুম করা হবে, কোথায় আগুন লাগানো হবে ইত্যাদি মাসের শুরুতেই প্লান করা হতো। এই অভ্যাসটা আমার এখনও আছে। অফিসেও আমার প্রতিদ্বন্দী কলিগদের কিভাবে সাইজ করতে হবে, কাকে ডিঙিয়ে প্রমোশন নিতে হবে এসব প্লান আমি মাসের শুরুতে করি। ফলে তার অনেক সুফলও পাচ্ছি।
শিবিরের সাথে যুক্ত হবার ফলে কিছুদিনের মধ্যেই আমি খুব ভালো ক্যাডারের সাথে সাথে ভালো বক্তাও হয়ে উঠলাম। এ জন্য আমাদের আলাদা ট্রেনিং দেয়া হতো। বাবা প্রায়ই এসে বলতেন, তার পরিচিতজনেরা তার কাছে আমার খুব প্রশংসা করেছেন। আমি বাবার বিভিন্ন বন্ধু বান্ধবের টেন্ডার পাইয়ে দেয়া, জমি দখল ইত্যাদিতে সহায়তা করতাম। এক্ষেত্রে আমার দায়িত্বশীল ভাইয়েরাও বেশ ভূমিকা রেখেছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে ছোট জেলা শহরটিতে আমার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্য দলের কোন লোকের কোন সমস্যা হলেও আমার কাছে সাহায্য চাইলে আমি সাহায্য করতাম। তবে অবশ্য পার্টির জন্য এবং আমার জন্য কিছু হাদিয়া দিতে হতো। দিনে দিনে চলন বলনে আমার অনেক পরিবর্তন ঘটতে লাগলো।
আমার এ সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকে শিবিরে যোগ দিয়েছিল।
চলবে ......
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৯:৪১