মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
অল্প বিলম্বে হলেও আপনাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। বৈশাখের এই তপ্ত গরমে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আশা করি আপনি কুশলেই আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আসুন একটু কষ্ট করে আমাদের মহান সংবিধানের দিকে একটু দৃষ্টি দিই -
সংবিধানের ৮(১) ধারায় রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে বর্নিত আছে- " সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার-এই নীতি সমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভুত এই ভাগে বর্নিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগনণত হইবে।"
সংবিধানের ২(ক) ধারায় বর্নিত আছে - " প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।"
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কোন সভ্য দেশের সংবিধানে কিভাবে এরুপ সাম্প্রদায়িক বিষয় সন্নিবেশিত হতে পারে ? এ ধারা দুটো সুস্পষ্টভাবেই আমাদের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শ্লোগান বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালী। ধর্ম দিয়ে নয় মানুষের পরিচয় হবে তার মনুষ্যত্ব দিয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ হিন্দুর, মুসলমানের, খ্রিস্টানের, বৌদ্ধের বা উপজাতি কারোর একার নয়; সবারই। কিন্তু আমাদের ব্যবচ্ছেদকৃত সংবিধানে এটি প্রতিফলিত হয় না।
দুই জন স্বৈরশাসক নিজেদের অপকর্ম হতে জাতির দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর লক্ষ্যে স্টান্টবাজি হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করে আমাদের পবিত্র সংবিধানকে স্রেফ ধর্ষন করেছে। ১৯৭৮ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে সংযোজন করা হয় - " সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার-এই নীতি সমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভুত এই ভাগে বর্নিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগনণত হইবে।" যাদের তথাকথিত সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা নেই তাদের জন্য কি এদেশ নয়, কিংবা যারা আল্লাহ ব্যাতিত অন্য কোন ঐশ্বরিক শক্তিতে বিশ্বাসী তাদের জন্য কি এদেশ নয়? এদেশ কি শুধু ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য?
আরেক স্বৈরশাসক বিশ্ববেহায়া তার পতনের বছর দু'য়েক পূর্বে নিজের আপদমস্তক দূর্নীতি ও পন্কিল চরিত্র হতে জাতির দৃষ্টি ফেরানোর লক্ষ্যে সস্তা স্টান্টবাজি হিসেবে সংবিধানের ৮ম সংশোধনীতে ১৯৮৮ সালে সংযোজন করেন- " প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।" এই ধারার পরবর্তী অংশটি লক্ষ্যনীয়- তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে- অর্থাৎ এ ধারাটি সংযোজনের সময়ই শাসক গোষ্ঠি জানত ধারাটি সংবিধানে সংযোজিত হলে অন্য ধর্ম শান্তিতে পালনে বিঘ্ন ঘটতে পারে। লক্ষনীয় যে সংবিধানের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে - প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এখানে অন্যান্য ভাষাও শান্তিতে ব্যবহার করা যাইবে এরুপ কোন কিছু সংযোজন করার প্রয়োজন হয়নি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, উপরোক্ত দুই স্বৈরশাসকের কেহই ইসলামকে ভালবেসে সংবিধানের এরুপ সংশোধন করেননি। তার নিছকই নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্ধশিক্ষিত, নিরক্ষর সাধারণ মানুষের সহানুভুতি লাভের আশায় পবিত্র সংবিধানে এরুপ দুটো মধ্যযুগীয়, সাম্প্রদায়িক ধারা সন্নিবেশিত করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদ, জঙ্গী গোষ্ঠীর উত্থান সংবিধানে এ ধারা দুটো সংযোজনের পরেই হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখনই সময় সংবিধানের হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার। যথাশীঘ্রই সংবিধানের এ ধারা দুটো বাতিল করা হোক। বাংলাদেশ কোন একক সম্প্রদায়ের দেশ নয়, এদেশ সবার। আমি জানি আপনি এ পদক্ষেপ নিতে গেলে আপনার দলেরই এক শ্রেণীর নেতা-কর্মী জনমতের কথা বলে বাধাঁর সৃষ্টি করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি তথাকথিত জনমতের তোয়াক্কা করবেন না। জনগণ সবসময়ই ন্যায়ের পথে আছে। কিন্তু দুয়েকজন নরপশু ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে বারবরই বিভক্ত করার অপচেষ্টা করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একশ্রেণীর ধর্মান্ধ জঙ্গীগোষ্ঠীর কারনে আজ বাংলাদেশ বিশ্বে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু সংবিধানের এ ধারা দুটো বাতিল পূর্বক বাংলাদেশকে একটি ধর্মিনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা দিলে বর্হিবিশ্বে অবশ্যই আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের জন্য এটি একটি চরম চপেটাঘাত হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জাতির জনকের কন্যা। তাঁর রক্ত আপনার শরীরে প্রবাহমান। আপনি বেশকয়েকবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন সুতরাং আপনি সাহসী হবেন না তো কে হবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এখনই সময় সাহসী হবার, দেশকে তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি উদার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার। মানুষ ব্যাক্তিগতভাবে অবশ্যই ধর্ম মানতে পারবে কিন্তু সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রিকভাবে, সরকারীভাবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এদেশে যেন কোন ধর্ম না থাকে। রাষ্ট্র যেন কোন বাংলাভাই, শায়খ রহমানের জম্ম না দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৯:৩২