বেশ কয়েকদিন যাবৎ দেশ পার করছে এক গুমোট পরিবেশ । গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের রেডিশন হোটেলের সমানে পরিবহনের জন্য অপেক্ষারত শাহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হওয়ার পর থেকে ই নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছোট ছোট স্কুল কলেজের ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে । নিরাপদ সড়কের দাবি যে শুধু মাত্র ইউনিফর্ম পরা ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের এমন টি ই নয় । এই দাবি বাংলাদেশের ছোট বড় সকল মানুষের । ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর বাংলাদেশের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে নিরাপদ সড়ক নিরাপদ জীবন শ্লোগানে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন নিয়ে সমাজের বিভিন্ন মানুষের সম্পৃক্ততায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন।
যত সামাজিক ও সরকারী সংগঠন ই কাজ করুক না কেন আজো আমাদের সড়ককে কোন ভাবেই নিরাপদ করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি । কেন আমাদের সড়ক আজ ও নিরাপদ হয়ে উঠেনি তার প্রায় সব উত্তরই মিলিছে ছোট ছোট বাচ্চাদের আন্দোলনের মাধ্যে । যানজটের বাংলাদেশে সড়ক বা মহাসড়কে কোন আইন শৃংখলা আছে কি না সেটাই প্রশ্ন ? যার যে ভাবে খুশি রাস্তা দখল করে নেয় কোথায় বাস কোথায় ট্রাক কোথায় রিক্সা কোথায় ই বা জীবন রক্ষাকারি পরিবহন সবই তাল গোল পেচানো । অথচ আমাদের ছোট ছোট স্কুল কলেজের ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীরা ওদের আন্দোলনে দেখিয়া দিয়েছে কিভাবে রাস্তায় শৃংখলার সাথে আইন মেনে গাড়ী চালাতে হয় । ওরা দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ মন্ত্রী ও যেমন নিজ ক্ষমতার বলে গাড়ীর কাগজ পত্র ছাড়া গাড়ী চালান পুলিশ থেকে সাংবাদ কর্মী তারা ও কাম ক্ষমতাবান নয় । ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের তল্লাসি তে অনেকের ই থলের বিড়ার বাহির হয়ে এসেছে । আসা যাক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কথায় , দুই সহপাঠির মৃত্যুর পর বেপরোয়া যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে আর যেন কেউ সড়কে প্রাণ না হারায় সেই দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তারা নয় দফার একটি যৌক্তিক দাবি নামা ঘোষনা করে । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ সরকারি দলের নেতারা তা মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন সেই সাথে নিহতদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান ও শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের পরিবহনের জন্য বাস প্রদান করেন । এর পর ও কার কারনে একটি সু-শৃংখল ও একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের এমন করুন পরিনতি হলে তা অবশ্যই আলোচনার বিষয় । আমি এটিকে ঐতিহাসিক আন্দোলন বলবো এই কারনে পূর্বে আমরা যত আন্দোলন দেখেছি তা ছিল তুলনা মুলক ভাবে বয়স্কদের কিছুটা উশৃংখল আন্দোলন । ২০১৩-১৪ বা তার আগে ও আমরা দেখেছি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের ক্ষমতালোভী জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন । আমাদের এই কিশোর-কিশোরীরা রাজনীতি বোঝে না। তাদের প্রতিবাদ সরকারের বিরুদ্ধেও নয়। তারা চেয়েছে গণপরিবহন তথা আমাদের রাস্তায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হোক।
শিক্ষার্থীদের নয়দফা দাবিনামায় কোথাও কোন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি না থাকলেও রাজপথে শিক্ষার্থীরা তাদের স্লোগানে পরিবহনমালিক-শ্রমিকনেতা ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবি উঠে। কারন দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর সংবাদের পর পর ই সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শাজাহান খান হাস্যোজ্জল ভঙ্গিতে বলেছিলেন ভারতে ৩৩ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল তা নিয়ে ওরা এত কথা বলছে না আর আপনারা ৩ জন মারা যাওয়া নিয়ে এত কথা বলছেন । এতেই সবার মনে বেদনার দাগ কাটে কারন একজন দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রীর কাছ থেকে এমন মন্তব্য কোন সভ্য মানুষের ই কাম্য নয় । এর আগে ও তিনি বিভিন্ন সময় এই ধরনের নানা উক্তি করে জাতির কাছে সমালোচনার পাত্রে পরিনত হয়েছিলেন । এর থেকেই নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের প্রতি সাধারন মানুষের ক্ষোভের কারনেই তার পদত্যাগের দাবি উঠে । কারো দাবির মুখে একজন মন্ত্রী পদত্যাগ করবেন এটা কোন যৌক্তিক বিষয় হতে পারে না । তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা কোন কর্তা ব্যক্তির আচার ব্যবহার কথা বা চালচলনে রাষ্ট্রে মধ্যে কোন বিশৃংখলার জন্ম নিলে বা সাধারন মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম নিলে নৈতিক ভাবেই ঐ ব্যক্তির উচিত সম্মানের সাথে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করা ।দেশ ও জাতির স্বার্থে অনেক সময় অতি উঁচু পদ থেকেও অনেকে পদত্যাগ করেন । যেমন টি আমরা দেখেছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের বেলায় ।যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী সভায় যোগদেয়ার পর ও দলের সভাপতি মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে সাংগঠনিক কাজে বেশি সময়দের জন্য মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে বললে বঙ্গবন্ধু কালক্ষেপন না করেই পদত্যাগ করেন ।স্বাধীনতার পর ও বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমালে ও তাজউদ্দীন আহমদ সহ বেশ করেকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেন ।এমন কি পরাধীন ভারতবর্ষে ও লর্ড কার্জন, স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার বা স্যার ওয়েভেলের মত শাসকরা জনমানুষের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেছেন ।
পদত্যাগই যে সব সমস্যার সমাধান এটা যেমন সঠিক নয় তেমন ই শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে যে ভাবে বন্ধ করতে চেয়েছে সেটা ও সঠিক পদ ছিল না । শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা মাধ্যমে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের মনে আতংকের জন্মদিয়েছে অন্যদিকে আন্দোলনে অংশগ্রহনের উৎসাহ ও দিয়েছে । প্রতিটি আন্দোলনের মত এই আন্দোলনে নানান গুজব কাজ করেছে । তাই এক দিকে সরকারকে যেমন আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে হয়েছে অন্য দিকে গুজব । স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামনে কেন গুজবের এত ডাল পালা গজায় ? কেন ই বা জনগন গুজবের প্রতি আকৃষ্ট হয় ? যখন ই কোন সরকারের প্রতি সাধারন মানুষের ক্ষোভের মাত্র বারতে থাকে এবং মুলধারার সংবাদ মাধ্যম সঠিক সংবাদ প্রচারে ব্যর্থ বা বাধাঁগ্রস্হ্য হয় তখন সাধারন মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমের প্রতি আস্হাশীল হয়ে উঠে এই তখন ই একশ্রেনীর সুবিধা ভোগী মিথ্যার মাধ্যমে এই সুযোগ কে কাজে লাগায় ।আবার কখনো ক্ষমতা প্রাপ্তরা ও নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য গুজবের জন্মদেয় যেমনটি আমরা দেখেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের গুজব । তার বাসভবনের সমস্ত দায় দিলেন আন্দোলনকারীদের কিন্তু প্রমান দিতে ব্যর্থ হলেন । কখনো কখনো গুজব মানুষকে উৎজীবিত করে যেমন টি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গুজব । সেই সময়ের অনেক গুজবই পাকিস্হানী হানাদারদের মনোবলে আঘাত করেছিল তাতে আমাদের মুক্তি যুদ্ধারা তাদের সহজে পরাস্ত করতে পরেছে । একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধী জামাত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি ও কার্যকর করতে হয়েছিল এই গুজবের কারনেই । যখন ই প্রচার হলো সরকার জামাতের সাথে আতাত করে কাদের মোল্লাকে ফাঁসির হাত থেকে রক্ষা করেছে তখন ই মুক্তিযুদ্ধে পক্ষের সকল শক্তি এক হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমেই কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতে পেরেছিল । আবার কখনো কখনো এই গুজবেই দেশের মধ্যে নানান গজব নেমে এসেছে । তার প্রমান রামু , নাসির নগর সহ দেশের বিভিন্ন স্হানে ধর্মা অবমাননার গুজবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে জান মাল । এবারের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গুজব ই ছিল বিশেষ হাতিয়ার । সরকার বিরোধী কিছু মানুষ গুজবের মাধ্যমে যে প্রচার করেছে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের খুন ধর্ষন পঙ্গুকরা বা চোখ তোলার মত সংবাদ । আবার সরকার পক্ষ ও আন্দোলন দমানোর নামে পুলিশের সহযোগী হয়ে শিক্ষার্থী ও সাংবাদ কার্মীদের উপর অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে হামলাকারী বিশেষ হেলমেট বাহিনীকে সরকার বিরোধী বিশেষ বিশেষ দলের কর্মী হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করছে । বাস্তবিক অর্থে সবাই চায় গুজবের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নানান ধরনের মিথ্যা ও গুজবের আশ্রয় ।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের মাধ্যমে কি অর্জিত হয়েছে এটা বড় কথা না । তবে তারা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমরা আইন প্রয়োগ করতে শিখেছি কিন্তু মানতে শিখিনি. আমরা বুলিতে অনেক সৎ উপদেশ অন্যকে দিতে পারি যা নিজের জন্য নয় ।একুশ শতকে এসেও আমরা সভ্য হতে ব্যর্থ হয়েছি । আন্দোলন মানেই উশৃংখলতা নয় শৃংখলা শিখেয়ে ও আন্দোলন করা যায় । ওদের এই ঐতিহাসিক আন্দোলন ভবিষ্যতে জাতিকে আন্দোলনের নতুন পথ দেখাবে ।