somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার লাল টমেটো এখন কার?

০১ লা আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সন্ধ্যা বেলা চা পানরত অবস্থায় পুরনো স্মৃতিচারনের শৌখিনতা আমার নতুন। সেই নতুন শখের দাস হয়ে আজ স্মৃতি রোমন্থনকালে মনে পড়লো সাবিতা ভাবীর কথা।

ভরা দেহ, কালো কোমর অবধি কেশ, কাঠালের কোয়ার মতো আখি আর পুষ্ট অধর সাবিতা ভাবীর শারীরিক সৌন্দর্যের বর্নণা। যৌবনকালে আমাকে আকৃষ্ট করার জন্য অতটুকুই যথেষ্ট ছিলো, কিন্তু তিনি ছিলেন এর থেকেও বেশি কিছু। অসাধারণ গানের গলা ছিলো তার। দরজা বন্ধ করে ভাইয়ার জন্য গান গাওয়ার সময় কতবার যে দরজায় কান পেতে শুনেছি তার কোন ইয়াত্তা নেই। তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো মিষ্টি খাবার তৈরীতে। দুধ, তাল, নারকেল এসব দিয়ে সেমাই, পিঠা, পায়েস আর কত কি যে বানাতেন। তিনি চিনির বদলে মধু প্রচুর ব্যবহার করতেন। তার সবচেয়ে শখের বিষয় ছিলো গাছ গাছালি। গাছ লাগানোর ব্যাপারে যেমন আগ্রহী ছিলেন তেমনি নিজেই গাছে চড়ে ফল পাড়ায় সমান আগ্রহ দেখাতেন। শখ করে ক্ষেতে হরে ফল আর সবজির চাষ করতেন। নিজেই সব কিছুর দেখভাল করতেন।

আমার বয়স তখন আঠারো কি উনিশ হবে, বছরখানের জন্য গ্রামে ছিলাম। আমার সেই সময় পুরোটাই কেটেছিলো সাবিতা ভাবীর আঁচলে আঁচলে। তিনিও বেশ মাথায় তুলে রাখতেন আমাকে। সবাই আমাকে ভাবীর নেওটা বলতো। আড়ালে আবডালে কটু কথা বলতো। আমি বা ভাবী কেউ গায়ে লাগাতাম না। আমরা আমাদের মত সময় কাটাতাম। যেমন তার বাজার লাগবে, এসে বাজারের থলে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন,
"যাও তো বাজার নিয়ে এসো"
এরপর আমাকে বিশাল এক বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিতেন। এমনো হত গোসল করতে যাবেন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন,
"বিছানার উপর থেকে আমার শাড়িটা নিয়ে আসোতো"
ভাবী কখনো আমাকে তুই করে বলতেন না, বেশি রেগে গেলে আপনি আপনি বলতেন। তবে খুব একটা রাগ করতেন না আমার সাথে। ভাইয়া তিনমাস পরপর বাড়ি আসতেন। তাই ভাবীর অনেক ব্যাপারে আমিই ডান হাত ছিলাম। আমার সাথে ভাবীর একটা নিজস্ব সংসার চলছিলো। আমার প্রায় রাতে ঘুম হতো না। ভাবীরও একই অবস্থা। আমি অথবা তিনি একজন আরেকজনের শয়নকক্ষে গিয়ে শুয়ে থাকতাম। কতরাত্রি যে এভাবে পার করেছি তার হিসেব নেই। আমার শরীরের ব্যাপারে ভাবী ছিলেন বিশেষ যত্নবান। একবারের কথা মনে আছে, সবাই বেড়াতে যাবে কোথায় যেন আমার এলো ভীষণ জ্বর। ভাবী থেকে গেলেন আমার সাথে। আমি আর ভাবী তিনদিন বাড়িতে কাটালাম। আমাকে খাওয়ানো, জলপট্টি দেয়া, গা মুছিয়ে দেয়া, ধরে ধরে শৌচাগারে নেয়া সব করেছিলেন তিনি। যেদিন জ্বর ছাড়লো, পুকুরে নিয়ে গেলেন গোসল করিয়ে দিবেন বলে। দুজনে একসাথে গোসলে নামলাম। আমি পুরো পুকুর দাপিয়ে বেড়াতে লাগলাম। ভাবী ডাক দিলেন আমি শুনলাম না। তিনি কান্না করা শুরু করলেন। আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। পাড়ে আসতেই আমার পিঠে বুকে কিল দিলেন, আমি বললাম,
"কি হলো কাদছো যে?"
ভাবী ফুফিয়ে ফুফিয়ে উত্তর দিলেন,
"মাত্র জ্বর ছাড়লো, যদি কিছু হতো?"
আমি হাসলাম, বললাম,
"একটা গান শোনাবে আমাকে?"
তিনি গান ধরলেন, বধূ কোন আলো লাগলো চোখে। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, চুল ভিজে লেপ্টে আছে পিঠের সাথে, কপাল বেয়ে পানি পড়ছে, পুকুরে পাড়ে বাধানো সিড়িতে বসে আছেন পা দুটো পানিতে আর হাত হাটুর উপর ভাজ করে গান গাইছেন। তার ভেজা গালে সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে।
একবার গ্রামে মেলা বসলো। ভাবীর খুব শখ মেলায় যাবেন। কিন্তু সেদিন বাসায় মেহমান আসবে তাই অনেক কাজ পড়ে গেলো ভাবীর ঘাড়ে কিন্তু আমি সাঝের বেলায় ছুটলাম মেলায়। অনেক রাত করে সেদিন বাড়ি ফিরলাম। ভাবীর জন্য মেলা থেকে কাঁচের চুড়ি আর বেলি ফুলের মালা কিনেছিলাম। বাড়ির সদর দরজায় পৌছাতে দেখি ভাবী তার চুল মেলে অগ্নিমূর্তি হয়ে বসে আছেন। আমি কিছু না বলে তার কোলের উপর চুড়ি আর মালা রেখে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। কাপড় ছেড়ে পরিষ্কার হয়ে শুয়ে পড়লাম। খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু ভাবীর চেহারা দেখে ভয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ পর ভাবী এসে বললো,
"খেতে এসো"
আমি উঠে ভাবীর পিছে পিছে গেলাম। ভাবী টেবিলে প্লেটে সব বেড়ে রেখেছেন। আমি খেতে বসতেই ভাবী চলে গেলেন। আমি খাবার শেষ করে ফেলেছি প্রায় এসময় ভাবী এলেন আবার। সবুজ শাড়ি পড়েছেন তিনি। তার হাতে চুড়ি গুলো আর বেলি ফুলের মালা দিয়ে চুলের খোপা বাধা। আমি মুচকি একটা হাসি দিলাম। খাবার শেষ করে উঠে আমার শয়নকক্ষে ফিরে গেলাম। ভাবী খাবার গুছিয়ে রাখতে লেগে গেলেন। আমি শুয়ে আছি ভাবী দরজায় এসে বললেন,
"ঘুম পাচ্ছে খুব?"
"না"
"চল ক্ষেতে যাই"
শুকনো ক্ষেত, বিকেলে ছেলেপুলেরা ক্রিকেট খেলে। আমি অবাক হয়ে বললাম,
"এত রাতে!"
"কেন ভয় লাগে?"
"না কিন্তু..."
"তাইলে উঠো চল"
আমি উঠে ভাবীর সাথে গেলাম। আকাশে অর্ধশশী, মিটিমিটি আলো খুব হালকা লয়ে বাতাস বইছে। আমি আর ভাবী ক্ষেতের আইলের মধ্যে বসে পড়লাম। ভাবী এবার বললেন,
"আর কদিন আছো আমাদের সাথে?"
"এইতো আর দু'মাস"
ভাবী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন,
"চল বাড়ি যাই"
দুজনে বাড়ি ফিরলাম। আমি আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ভাবীও আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো চুপ করে। আমি কিছুই বললাম না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম ভেংগে দেখি ভাবী পাশেই শুয়ে আছে। আমি তাকে ডেকে তুললাম, ভাবী আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাংগতে বললো,
"জানিস আমার লাল টমেটো এখন কার?"
আমি অবাক হয়ে বললাম,
"মানে?"
তিনি হাসতে হাসতে বললেন,
"আরে গাধা আমার যে টমেটো ক্ষেতটা যে আছে ঐটা কার জানিস?"
আমি কিছুমাত্র বিস্ময় না লুকিয়ে বললাম,
"কার সেটা?"
"ঐটা এখন থেকে তোর"
আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম, ভাবী হাত দিয়ে আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে উঠে চলে গেলেন। পরের দু'মাস আগের মতোই কাটলো। ভাবী আমাকে তুই করেই বলেন এখন। একবার ভাইয়া বাড়িতে এলে তাকি জমির ব্যাপারটা বলা হলো, তিনি আমাকে জমিটা দেয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করলেন। আমি জমি দিয়ে কি করবো বুঝে পেলাম না। আমি চলে আসার পর জেনে ছিলাম ভাবীর একটা ছোট ভাই ছিলো, বাবা মা না থাকায় সে আর ভাবী একসাথেই থাকতো। ভাবী তাকে অনেক স্নেহ করতো। ভাইটাও তার নেওটা ছিলো। ভাবী আর ভাইয়ার বিয়ের মাস ছয়েক আগে তার ছোট ভাই পুকুরে গোসল করার সময় ডুবে মারা যায়। ছোট ভাইটা পাকা টমেটো বেশ পছন্দ করতো। যেদিন মারা যায় সেদিন তার বড় বোনকে বলেছিলো,
"আপু আজ কিন্তু দুপুরে টমেটোর চাটনি দিয়ে ভাত খাবো"
বড় বোন খেপে বলেছিলো,
"বাসার কাজের কোন রা নাই জাহাপনা হুকুম করেছেন চাটনি দিয়ে তিনি ভাত খাবেন। যা ভাগ এখান থেকে।"
সাবিতা ভাবী টমেটোর চাটনি নামানোর সময় খবর পেলেন তার ভাই পানিতে ডুবেছে। দৌড়ে গেলেন কিন্তু সে আর বাচলো না।

আমি ফিরে আসার বছর দুই পরে ভাবী কর্কট রোগে মারা যান। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষেতে কিছুই চাষ করি নি। এবার আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সেখানে টমেটোর চাষ হবে। এখন পর্যন্ত তাই হচ্ছে। এখনো আমার মেলায় যাওয়ার শখ আগের মতোই আছে। আমি মেলায় গেলে আনমনে কাচের চুড়ি আর বেলি ফুলের মালার দামদর করি কিন্তু কখনো কিনি না।

সময়ের পরাকাষ্ঠে সাবিতা ভাবীকে ভুলে গিয়েছো হয়তো কিন্তু তার মমতা, স্নেহ সব কিছু এখনো তৃপ্তির অনুভূতি হয়ে অন্তরের কুঠিরকে মুড়িয়ে রেখেছে কোমলতার চাদরে।


বিঃদ্রঃ অনুরোধের ঢেকি গেলা আর আমার এই লেখা সমার্থক। টাইটেল খানা একজনের সাজেস্টেড আর তা দিয়ে গল্প লেখার অনুরোধ ছিলো। কিন্তু এইরকম নষ্ট লেভেলের লেখা বাইর হবে বুঝলে লেখা থেকে বিরত থাকতাম। :)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:২৮
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×