somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যে আলো নেভেনা কখনও...(এক মুক্তিযোদ্ধার গল্প)

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সন্ধ্যা ৭টা। দাড়িয়েছিলাম মিরপুর ১১ নাম্বার ব্যাস স্ট্যান্ডে।
আমার বাসা পুরান ঢাকায়। মিরপুরে এসেছিলাম আমার মেজো ফুপুর বাসায়। এখন বাসায় যাবো। কিন্তু কোন সি.এন.জি অথবা বাস দেখছি না। ১৫ মিনিট ধরে দাড়িয়ে আছি। শেষে কি মনে করে যেনো ঠিক করলাম, রিক্সায় যাবো। জানি এতদূর কোনও রিকশা যেতে চাইবে না তারপরও। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

কয়েকটা রিক্সাকে জিজ্ঞেস করাতে তারা তো আকাশ থেকে পরলো! একজন তো বলেই বসলো, ভাইজান কি ঢাকায় নতুন নাকি? আমি কথা বাড়ালাম না। আমি জানি, আমার মধ্যে কিছু পাগলামি আছে যা মাঝে-মধ্যে নাড়া দেয়। তখন যেটা করতে ইচ্ছা হয় সেটা করে ছাড়ি। আজকেও ঠিক করলাম, যত রাতই হোক; রিক্সা করেই বাসায় যাবো।
আরও ১৫ মিনিট পার হয়ে গেলো। আমি তখনও দাড়িয়ে। হাল ছাড়ছি না। দেখি, কি হয়। অনেকক্ষণ ধরেই এক বুড়ো রিক্সাওয়ালা দূর থেকে আমাকে দেখছিলো। আমি জিনিষটা পরে খেয়াল করেছি। কিছুক্ষন পর সে আমার সামনে এসে হাসিমুখে বলল- কোথায় যাবেন বাবা? আমি একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম- যেখানে যাবো সেখানে কি আপনি যেতে পারবেন? সে বলল- বলেন না বাবা, যদি সাধ্যে কুলায় তো যাবো আর না পারলে তো নাই। আমি বললাম- যাবো পুরান ঢাকা, সুত্রাপুর। যাবেন আপনি? রিক্সাওয়ালা তখন একগাল হেঁসে বলল- আপনি সত্যিই যাবেন? আমি তখন একটু কড়া গলায় বললাম- না গেলে কি ইয়ার্কি করার জন্য এখানে দাড়িয়ে আছি? যদি পারেন তো চলেন আর না পারলে বিদেয় হন। রিক্সাওয়ালা খানিক কি যেন চিন্তা করে বলল- ঠিক আছে বাবা। চলেন। আপনের যেহেতু সাধ হইসে। পূরণ কড়া দরকার। তবে বাবা একটু ধীরে যাবো। আমার একটু সমস্যা আসে। আমি ভাবছিলাম বুড়ো মানুষ, এতদূর টানতে পারবে কিনা, রাজি তো হয়ে গেলাম। রিক্সাওয়ালাটা বুড়ো হলেও তার দৈহিক গঠন খুবই ভালো। বেশ লম্বা, চওড়া আর পেটা শরীর। কি মনে করে যেনো চড়ে বসলাম।
আনুমানিক একটা হিসাব করলাম। যদি সাধারন গতিতেও যাই তারপরও বাসায় পৌঁছাতে প্রায় ৩ ঘণ্টা লেগে যাবে। আরও বেশিও লাগতে পারে। সেটা ব্যাপার না। বাসায় পৌঁছাতে পারলেই হলো। রিক্সাওয়ালাকে দেখলাম একটা টোকাই পিচ্ছিকে দিয়ে পাশের দোকানটা থেকে কয়েক খিলি পান কিনালো। এরপর বাচ্চাটাকে খুশি হয়ে ২ টাকা দিলো। বাচ্চাটা খুশিমনে ২ টাকা নিয়ে নাচতে নাচতে চলে গেলো।
দীর্ঘ এই যাত্রায় পানগুলো হয়তো তার নিশ্চুপ সঙ্গির ভুমিকা পালন করবে। ভাড়া ঠিক করে উঠিনি। বুড়ো মানুষ। ঠিক করলাম, ভালো একটা রকম দিয়ে দেবো। ঠকিয়ে লাভ নেই।

রিক্সা চলতে শুরু করলো। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। শীত নামতে শুরু করেছে। বাতাস ভালই ঠাণ্ডা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে হয়তো পুরোপুরি শীত নেমে যাবে। ভালই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ রিক্সা জ্যামে পড়লো। এতো প্রশস্ত ফাঁকা রাস্তায় কিসের জ্যাম বুঝলাম না। সামনে ঝুকে দেখলাম, দুইজন রিক্সাওয়ালা নিজেদের মধ্যে মারামারিতে ব্যাস্ত। তাই জ্যামটা লেগেছে। এদিকে পিছন থেকে একটা এ্যাম্বুলেন্স সমানে সাইরেন দিয়ে যাচ্ছে। কারও কোনও মাথা ব্যাথা নেই। সবাই রিক্সাওয়ালাদের মারামারি দেখায় ব্যাস্ত। কয়েকজনকে দেখলাম বেশ মজাও পাচ্ছে। উস্কানিমূলক কথাও বলছে কেউ কেউ। এরকম অসহায় অবস্থায় একটা এ্যাম্বুলেন্স পরে আছে দেখে নিজেই নামলাম। অবশ্য, ততক্ষনে দেখলাম তাদের মারামারিও শেষ হয়ে গেছে। একজন আরেকজনকে হুমকি দিতে দিতে চলে গেলো। জ্যাম ছুটলো। রিক্সা আবার চলতে শুরু করলো। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। কি দেশে বাস করি আমরা! এখন পর্যন্ত যানজটই নিরসন হলো না। চরম বিপদগ্রস্ত অবস্থায়ও মানুষের জ্যামে পরে থাকতে হয়। কারও একটু মাথা ব্যাথা নেই। কি হবে এই দেশের? ধুর...
শেষের কথাগুলো কিছুটা জোরেই বলে ফেললাম। রিক্সাওয়ালা ঘাবড়ে গিয়ে বলল- কি হলো বাবা? হঠাৎ দেশের উপর এতো ক্ষিপ্ত হলেন কেন? আমি বললাম- আর কি করবো বলেন? রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে দুইজন রিক্সাওয়ালা হিন্দি ফিল্মের মতো মারামারি করে আর সবাই বসে বসে মজা দেখে। কেউ একটু এগিয়ে আসে না। পিছনে যে একটা এ্যাম্বুলেন্স আঁটকে আছে সেদিকে কারও খেয়ালই নেই! দেশের মানুষগুলো যেনো কেমন হয়ে গেছে। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি মায়া উঠে গেছে। নাহ, এই দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
রিক্সাওয়ালা বলল- বাবা, একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না। আপনারা এ যুগের ছেলেপেলে। তরুন প্রজন্ম। দেশপ্রেম কি, সেটা আপনারা এখনও ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেন নাই। তাই দেশকে নিয়ে কিছু বলার আগে চিন্তা করে বলবেন বাবা। কারন, আমরা জানি দেশ কি জিনিষ! কত বড় সম্পদ! এটা আপনাদের বোঝার বাইরে।
আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম- চাঁচা, আপনার কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় আপনি পড়ালেখা করেছেন। তা কতদূর পরেছেন? রিক্সাওয়ালা একটু হেঁসে বলল- তা বাবা, এইট পাশ বলতে পারেন। ভালো ছাত্র ছিলাম। নাম্বারও ভালো ছিলো। বৃত্তিও পেয়েছিলাম। পড়ার খুব শখ ছিল বাবা, কিন্তু এরপর আর পড়া হয়নি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কেনো চাঁচা? কি সমস্যা ছিলো? রিক্সাওয়ালা বলল- সে আরেক কাহিনী বাবা। আপনাদের মতো তরুন প্রজন্ম কি সেই কাহিনী শুনতে আগ্রহি হবে? আমি বললাম- আরে চাঁচা, নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন। আর আপনি যেরকম ভাবছেন আমি সেরকম না। দেশপ্রেম আমার মধ্যেও আছে। তখন মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তাই ওরকম কথা বলেছিলাম। তাছাড়া, আমার লেখালেখিরও অভ্যাস আছে। আপনার কাহিনী ভালো লেগে গেলে হয়তো সেটা নিয়েও লিখে ফেলতে পারি। মনে মনে ভাবলাম- যাক, দীর্ঘ যাত্রাটা খুব একটা বোরিং হবে না।

রিক্সাওয়ালা মুখে এক খিলি পান ঢুকিয়ে শুরু করলো তার কাহিনী-
১৯৭১ সাল, তখন আমার বয়স ১২ কি ১৩।
বাবা মা’র দ্বিতীয় সন্তান আমি। আমার বড় আরেক ভাই আছে। সে তখন যুবক। সেও পড়াশুনা করে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার ছিলো আমাদের। বাবা ছিলেন গ্রামের একজন গণ্যমান্য ব্যাক্তি। পঞ্চায়েতে বিচার-আচার করতেন। যাই হোক, আমি তখন ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়ে সবে নাইনে উঠেছি। মনে টানটান উত্তেজনা, কবে ম্যাট্রিক পাশ করবো, কবে কলেজে যাবো? মনে অনেক স্বপ্ন।
হঠাৎ করেই দেশে শুরু হয়ে গেলো গণ্ডগোল। যাকে বলে স্বাধীনতার যুদ্ধ। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু কেমন যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো। শোনা গেলো- পাকিস্তানি মিলিটারিরা নাকি গ্রামে ঢুকে গেছে। চোখের সামনে যাকে পাচ্ছে, গুলি করে মারছে। গ্রামের তরুন যুবকেরা হাওয়া। পরে শুনেছিলাম, তারা দলে দলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছে।
যোগ দিলো আমার বড় ভাইও। কাউকে কিছু না বলেই চলে গেলো। অবশ্য বাবা- মা’র কাছে নাকি একটা চিঠি লিখে গিয়েছিলো। সেই চিঠি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। যাই হোক, আমার বাবা –মা তো কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। অনেক আদরের ছিলো আমার বড় ভাই। আমিও চোখের পানি বিসর্জন দিয়েছিলাম নীরবে। ঘরে আমরা তখন খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। যে কোন মুহূর্তে মিলিটারিরা আমাদের গ্রামেও চলে আসতে পারে। অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। আমার বাবা কোনমতেই গ্রাম ছাড়তে রাজি হলেন না। আমরাও আর বৃথা চেষ্টা করলাম না।
এর মধ্যে একদিন আমাদের গ্রামের আরেক গণ্যমান্য লোক; বাবার বন্ধুই ছিল লোকটা, নাম- রমিজ উদ্দিন- এলেন আমাদের বাসায়। বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করতে লাগলেন বাবাকে। জানতে চাইলেন, আমার বড় ভাই কোথায়? বাবা আসলে বুঝতে পারেননি রমিজ উদ্দিনের মনে কি ছিলো। তিনি উত্তরে বলেছিলেন- ‘আমার ছেলে যেখানেই থাকুক, আল্লাহ্‌ ওদের সাথে আছেন। আমি ওদের জন্য দোয়া করি’।
এই কথা শুনে রমিজ উদ্দিন চলে যায়। তার দিন তিনেক পর আমাদের গ্রামেও মিলিটারিরা ঢুকে পরে। অবাধে হত্যা চালাতে থাকে। আমরাও ঘরে বসে আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষা করছিলাম। বাবা অবশ্য এক মুহূর্তের জন্যও ভয়ে পাননি। আমরা ভিতরের ঘরে ছিলাম। বাবা ছিলেন সামনের ঘরে। হঠাৎ আমাদের দরজা ভাঙ্গার শব্দ হলো। ঘরে রমিজ উদ্দিন-এর গলা শুনতে পেলাম। সাথে কয়েকজন পাকিস্তানি মিলিটারি। তারা বাবা কে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করতে লাগলো আমার বড় ভাইয়ের কথা। কোথায় গেছে, সাথে কয়জন আছে এইসব।
বাবা তখনও একই উত্তর দিয়েছিলেন। সাথে সাথে বিকট শব্দে তাদের রাইফেল গর্জে উঠলো। বাবা কে মেরে ফেলা হলো। মা সইতে না পেরে ছুটে গেলেন। তাকেও সাথে সাথে প্রান দিতে হলো। আমিও সইতে পারলাম না। ছুটে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিলো, মরার আগে রমিজ উদ্দিনের হৃদপিণ্ডটা টেনে বের করে ফেলবো। পারলাম না। মাথায় বেশ জোরে কেউ ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করলো। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলাম।

যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলাম আমি আমাদের স্কুলের একটা ঘরে বন্দি। হাত বাধা। আমাকে তারা মেরে ফেলল না কেনো বুঝতে পারলাম না। হয়তো তারা ভাবছিলো, আমি আমার ভাইয়ের ব্যাপারে তাদেরকে কিছু বলবো। কিছুক্ষন পর ঘরে ঢুকলো দুইজন মিলিটারি, সাথে রমিজ উদ্দিন। ওকে আমি একদমই সহ্য করতে পারছিলাম না। শালা নিজের দেশের মানুষের সাথে বেঈমানি করলো। রাগে- ক্ষোভে আমার শরীর কাঁপছিলো। সুযোগ খুঁজছিলাম, কি করা যায়। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এক মিলিটারি আমার হাতের বাঁধনটা হালকা করে দিলো। আমি আসতে আসতে উঠে দাঁড়ালাম। রমিজ উদ্দিন আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলো। আমি কোন কিছু চিন্তা না করে দৌড়ে গিয়ে রমিজ উদ্দিনের বুকে প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি মারলাম। সাথে সাথে সে তার ভারী শরীরটা নিয়ে লুটিয়ে পড়লো। মনে এক ধরনের শান্তি পেলাম। মিলিটারিগুলোও মজা পেলো। তারা রমিজ উদ্দিনকে পড়ে যেতে দেখে জোরে জোরে হাঁসতে লাগলো। রমিজ উদ্দিন উঠে এসে আমাকে প্রচণ্ড জোরে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করলো। আবার জ্ঞান হারালাম।
এরপর থেকে শুরু হলো আমার উপর অমানবিক নির্যাতন। সারাদিন ঘরটাতে বন্দি করে রাখতো। ঠিকমতো খেতে দিতো না। কোন রকম অত্যাচার বাদ দিলো না। তবে যথেষ্ট প্রানশক্তি থাকায় সেগুলো কোনরকমে সয়ে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে একদিন পালানোর সুযোগ পেলাম। মৃত্যু তখন আমার কাছে তুচ্ছ তাই, রাতের অন্ধকারে জানালার শিক গলে চরম বিপদজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে পালিয়ে গেলাম। আমার দেশের পথ তারা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে ভালো চিনবে না। বুকে ভর দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। কেউ টের পেলো না। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা না থাকলে এটা সম্ভব হতো না। অনেক কষ্টে লাঠিতে ভর করে হেঁটে পৌছালাম পাশের একটা গ্রামে। দূরে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে হারিকেনের আলো দেখতে পেলাম। সেদিকেই এগোলাম। জানিনা সেখানে কারা আছে। প্রচণ্ড খিদা আর ক্লান্তির জন্য এসব চিন্তা তখন মাথায় আসেনি। কুঁড়ে ঘরটার সামনে যেয়ে আরও একবার জ্ঞান হারালাম।

যখন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম, আমি একটা ছোট্ট খাটে শুয়ে আছি। পাশে আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু ‘শফিক’ ভাই। বুঝলাম, আমি এখন একটা মুক্তিবাহিনীর দলের সাথে আছি। এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। শফিক ভাইকে আমার ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করাতে সে কোনও উত্তর না দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার গাল বেয়ে পানি পড়ছিলো। ঘটনা বুঝতে পেরে আমিও আর কথা বাড়াইনি। যোগ দিলাম সেই মুক্তিবাহিনীর দলে। অনেক অপারেশনে গিয়েছি। তবে আমার একটা সমস্যার কারনে বড় অপারেশনগুলোতে যেতে পারিনি। শফিক ভাই-ই যেতে দেননি। নিজের ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন তিনি।
যাই হোক, যুদ্ধ করলাম। ছিনিয়ে আনলাম বিজয়। চোখের সামনে অনেক কিছুই দেখলাম, হারালাম, পেলাম। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে সবচেয়ে বড় যেটা পেলাম তা এই স্বাধীন বাংলাদেশ। তাই দেশ নিয়ে উলটা-পালটা কিছু শুনলে খুব খারাপ লাগে, বুঝলেন বাবা।
দেশের কোন দোষ নাই। যারা দেশটাকে চালাচ্ছে দোষটা তাদের দেন। তারা ঠিকমতো চালাতে পারছেনা বলে আজকে তরুন প্রজন্ম দেশের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম কমে যাচ্ছে। দেশটা ঠিকমতো চালানোর দায়িত্ব আপনাদের। আপনারা ইচ্ছা করলেই পারেন দেশকে সুন্দরভাবে চালাতে। আমারা তো আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি বাবা, বাকিটা আপনাদের তরুন প্রজন্মের দায়িত্ব। কিছু করেন বাবা, কিছু করেন......

ঘটনা শুনতে শুনতে কখন যে বাসার সামনে চলে এসেছি খেয়ালই করিনি। চাঁচার ঘটনা শোনার পর কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বাসার দরজার সামনে রিক্সা থামালাম। কিছু প্রশ্ন মনে উকি দিচ্ছে। রিক্সা থেকে নেমে বললাম- চাঁচা, আপনি তো দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আপনি কেন রিক্সা চালাচ্ছেন? আপনি সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন দয়া করে, না হলে আমাকে বলেন, আমি সব করে দিচ্ছি।
রিক্সাওয়ালা চাঁচা খানিকটা হেঁসে বললেন- কি লাভ বাবা! সরকারকে বললে সরকার কি করবে? সম্মান দিবে? টাকা দিবে? ঘোষণা করে দিবে যে ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা’ এ-ই তো? আমার এগুলোর প্রতি কোনও লোভ নেই বাবা। আমি এসব চাই না। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি দেশকে ভালবাসি বলে, দেশের মানুষকে ভালবাসি বলে। তাদের ভালবাসার প্রতিদান আমি এভাবে আদায় করতে চাই না বাবা। আমি জানি আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। লোকে জানুক, না জানুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

আমি মানতে পারছিলাম না। আমাদের দেশের সরকাররা কি এখনও উনাদের প্রাপ্য সম্মান উনাদেরকে দেবেন না? নাকি তারা সম্মান প্রদানে অক্ষম? জানি, এই প্রশ্নের জবাব কেউ দেবে না। যাই হোক, চাঁচাকে আমার ছাড়তে ইচ্ছা করছিলো না। আরও অনেকক্ষণ তার সাথে কথা বললাম। তার সম্পর্কে আরও যা জানতে পারলাম তা হলো, সে নিউমার্কেটের কাছে এক বস্তিতে থাকে। একা মানুষ। বিয়ে করেননি। সারাদিন বস্তির বাচ্চাদের বিনামূল্যে পড়ান আর রাতে রিক্সা চালান। গ্রামে তাদের যে বাড়িটা ছিলো সেটার বেশীরভাগই দখল হয়ে গেছে। যতটুক তিনি পেয়েছেন সেখানে তার একটা স্কুল করার ইচ্ছা আছে। এজন্য তিনি টাকা জমাচ্ছেন। শেষ একটা প্রশ্ন তাকে না করে পারলাম না।
-আচ্ছা চাঁচা, আপনি যে রমিজ উদ্দিনের বুকে লাথি মেরেছিলেন, সে আপনাকে কিছু না বলে এভাবেই ছেড়ে দিলো?
জবাবে তিনি ডান পা’টা সামনে এনে দেখালেন। পা’টা গোড়ালি থেকে কাঁটা.....................
হতভম্ব হয়ে গেলাম।
একবারও জিনিষটা চোখে পরেনি। এক পায়ে রিক্সা চালিয়ে তিনি আমাকে এতদূর নিয়ে আসলেন, আমি একমুহূর্তের জন্যও বুঝিনি! এজন্যই সে ধীরে আসার কথা বলছিলো। আর পারলাম না। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো।
এ কেমন দেশপ্রেম তাদের!
কোন মাটি দিয়ে তৈরি এরা? নিজের সবকিছু হারিয়েও তারা দেশের সেবা করে যাচ্ছে, দেশের মানুষের সেবা করে যাচ্ছে! দেশের জন্য যুদ্ধ করে এখন সে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত। তার যুদ্ধ এখনও থামেনি। এ যুদ্ধ কি আদৌ থামবে? তবু তার কোনও দাবি নেই, নেই কোন অভিমান এমনকি অভিযোগ! কোন উত্তর খুজে পেলাম না। মানিব্যাগ বের করে ভাড়া দিলাম। খুশি হয়ে যা ভাড়া তার চেয়ে ১০০ বেশি দিতে চাইলাম কিন্তু সে কিছুতেই নিলো না। পরে অনেক কিছু বলে- কয়ে বুঝালাম যে, ভাতিজা হিসেবে অন্তত নেন। তখন সে টাকাটা নিলো। তার ঠিকানাটাও রেখে দিলাম। মনে-প্রানে চাইলাম, তার সাথে আবারও দেখা হোক।
এরকম দেশপ্রেমিক যোদ্ধার সাথে আমাদের মতো তরুন প্রজন্মের যেনো আজীবন দেখা হতে থাকে- এই আশা নিয়ে বাসায় ঢুকলাম।
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×