somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

......হিমুর বাদল দিনের গান

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চেয়ার টানার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
চোখ খুলে দেখলাম, ফুপা। বিছানার পাশের হাতলবিহীন চেয়ারটায় বসে আছেন। আমার মেসের ঠিকানা উনার জানার কথা না, এটা ভেবে খানিকটা অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলাম না। রাতে ঘুম ভালো হয়নি। আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মিনিট পাঁচেক পর ফুপার ঝাঁঝালো গলার শব্দে নিদ্রা কেটে গেলো।

-হিমু!
গত ২৫ মিনিট যাবত আমি তোমার রুমে বসে আছি। বুঝতেই পারছো ব্যাপার বেশ সিরিয়াস, নাহলে আমি নিজে তোমার মেসে আসতাম না।

আমি চোখ মুছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম- কেমন আছেন ফুপা?
-ফরমালিটি পরে হবে। আগে কাজের কথায় আসি। সমস্যা বাদলকে নিয়ে। কদিন যাবত ওর আচরণ বেশ ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। কয়েকদিন আগে কাউকে কিছু না বলেই বাসা থেকে হাওয়া। তিনদিন কোন খবর ছিলো না। পরে চারিদিকে লোক লাগিয়ে গরু- খোজা খুজে বের করেছি। সুযোগ পেলেই এখন সে বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে চায়।

আমি মুখ ধুয়ে বললাম- সমস্যা তো আসলেই ভয়াবহ মনে হচ্ছে। চলেন, দেখি।
গাড়িতে ফুপা আরও যা বললেন তার সারাংশ হলো- বাদল মানসিকভাবে পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার দেখিয়েও কোন কাজ হচ্ছেনা। আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপারটা হলো- তার ধারনা, আমি নাকি মারা গেছি। আমরা জায়গায় অন্য কেউ আমার বেশ ধরে ঘুরে বেরাচ্ছে। অর্থাৎ, আমি ওর আসল হিমুদা নই। ছদ্মবেশী কোন ঠকবাজ।
এই ব্যাপারটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুললো। বাদলের মাথায় হঠাৎ করে- আমার মৃত্যুর কথা কিভাবে ঢুকলো বুঝতে পারলাম না। ওদিকে ফুপা, ফুপু ভাবছেন- বাদলের বাড়ী থেকে বের হয়ে যাওয়ার এটাই নাকি কারন। কিন্তু, যে মারা গেছে তাকে খুঁজতে যাওয়ার মানেটা কি? ব্যাপার বেশ গোলমেলে।

গাড়ীর জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন ফুপা। কিছুক্ষন পর বেশ কঠিন স্বরে বললেন- দ্যাখো হিমু, আমি জানি ও তোমাকে খুব পছন্দ করে। তোমার ভ্যাগাবন্ড লাইফস্টাইল ওকে বেশ আকর্ষণ করে। এ কারনে আগেও সে এই ধরনের অনেক পাগলামি করেছে। তবে, তুমি মারা গেছো- এই ব্যাপারটা ওর মাথায় কেন ঢুকলো আর কিভাবেই বা ঢুকলো সেটাই বুঝতে পারছিনা। তোমার কি মনে হয়?

-আমার মনে হয়, বাদলের ধারনা সঠিকও হতে পারে।
-মানে?
-মানে, এমন তো হতেও পারে যে আমি সত্যিই মারা গেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ আমার হুলিয়া ধরে আপনাদের বিব্রত করতে চাইছে। আপনাদের দেয়া সুযোগের ফায়দা লুটতে চাইছে। সুযোগ বুঝে আপনাদের বাড়ীতে ঢুকে বাড়ী সাফ করে চলে যাবে, এরকম প্ল্যানও তার থাকতে পারে।
-হিমু, আমাকে বাদল পাওনি যে সহজেই কনভিন্স করতে পারবে। আর হ্যাঁ, আমার সাথে ফাইজলামি করবেনা। তোমার সাথে আমার ফাইজলামির সম্পর্ক না।
-জি আচ্ছা। আরেকটা কথা, বাদল যদি ভেবেই থাকে আমি মারা গেছি, তাহলে আমাকে আবার খুঁজতে বের হবে কেনো?
-আমার মনে হয় তোমাকে নিয়ে ওর যে ধারনাটা হয়েছে, সেটা আসলেই সত্যি নাকি জাস্ট ওর ধারনা, এটা যাচাই করার জন্যই ও বের হচ্ছে। আর তোমাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি এই কারনেই, যাতে বাদল তোমাকে দেখে বিশ্বাস করে তুমি বেঁচে আছো এবং তোমাকে খোঁজার জন্য বাসা থেকে না বেরোয়।
-বাদল যে আমার কথা বিশ্বাস করবে এটা আপনি নিশ্চিত হলেন কিভাবে?
-করবে, কারন তুমি সশরীরে উপস্থিত হয়ে ওকে কথাগুলো বলবে।
-জি আচ্ছা।

গাড়ি থামলো। বাড়ীর পরিবেশ থমথমে। ফুপু আমাকে দেখেই ছুটে এসে বললেন-
-কি সর্বনাশ করলি আমার ছেলেটার। তোকে বলেছিলাম ওর থেকে দূরে থাকতে। আজ সন্ধ্যায়ও বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতে নিয়েছিলো, ভাগ্য ভালো কাজের মেয়েটা দেখে ফেলেছে।
আমি যতোটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে বললাম-
-কেমন আছো ফুপু?
ফুপু আঁচলে মুখ ঢেকে ঘরে চলে গেলেন।
বাদলের ঘর অন্ধকার। জানালার ভারি পর্দাগুলো দিয়ে সব জানালা ঢেকে রাখা হয়েছে। বাদলকে দেখলাম পদ্মাসনে বসে আছে। সম্ভবত মেডিটেশন করছে। বিরক্ত করলাম না। পাশে গিয়ে আমিও বসে পরলাম মেডিটেশন করতে। প্রায় ২০ মিনিট পর বাদলের গলার আওয়াজ কানে এলো,

-আপনি কে? এখানে কেনো এসেছেন?
আমি চোখ বন্ধ করেই বললাম,
-আমি আপনার হিমুদার একজন ভক্ত। বলতেন পারেন তার সবচেয়ে কাছের একজন। কারন, আমার চেহারা হুবহু তার মতো। তার মতোই চুল, দাড়ি, তার মতোই বিভ্রান্তিকর হাঁসি। তবে একথা কাউকে বলা নিষেধ, হিমুদার সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অবশ্য সে বলেছে, একমাত্র আপনি জিজ্ঞেস করলে যেনো সত্যি কথাটা বলে দেই।
-জানতাম। আর আমি এটাও জানি যে আমার আসল হিমুদা বেঁচে নেই। সে মারা গেছে। তাই, তার জায়গাটা এখন আমাকেই পূরণ করতে হবে।
- মানে?
- মানে বুঝবেন না। কারন আপনি ভক্ত। ভক্তরা কখনও গুরু হতে পারেনা।
- আপনি গুরু?
- হ্যাঁ, আর কদিন পর জোছনা। সেদিন রাতে বাসা থেকে আবার বেড়িয়ে যাবো। আর ফিরবোনা। জঙ্গলে যাবো জোছনা দেখতে। সেদিন থেকে পুরোদমে গুরু হয়ে যাবো। অর্থাৎ, হিমুদা হয়ে যাবো।
- আপনি কি কনফার্ম যে আপনার আসল হিমুদা মারা গেছে?
- হ্যাঁ, ১০০ ভাগ কনফার্ম।
- কিভাবে জানলেন এ খবর?
- টেলিপ্যাথির মাধ্যমে।
- তাহলে আপনি বাসা থেকে বেড়িয়ে কাকে খুঁজতে যান।
- আমি কাউকে খুঁজতে যাই না। বাসায় থাকতে আমার ভালো লাগেনা। বন্দী লাগে। একদিন বেড়িয়ে অনেক দূরে চলে যাবো যাতে কেউ আর খুঁজে না পায়।
- কোন দিকে যাবেন?
- ঢাকার বাইরের দিকে। খোলা মাঠ আর সবুজ গাছপালা দেখতে। জঙ্গলে জোছনা দেখতে।
- কবে বের হবেন?
- সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই। আপনি এখন যান, নাহলে বাবাকে আপনার আসল পরিচয় বলে দিবো। সে আপনাকে পুলিশে দেবে।

পদ্মাসন থেকে উঠে ফুপার রুমে গেলাম। ফুপার হাতে হুইস্কির বোতল। কয় নম্বর পেগ চলছে বুঝলাম না, তবে মনে হলো সে ধারনা করতে পেরেছে, আজকে বাদল সুস্থ হয়ে যাবে। তাই সেটাকে সেলিব্রেট করছে। আমাকে রুমে দেখে বললেন-
-হিমু, কাজ হয়েছে?
-জি ফুপা।
-বাদল কি বিশ্বাস করেছে, তুমি বেঁচে আছো আর তুমিই ওর আসল হিমুদা?
-জি। প্রথম দেখাতেই বুঝে ফেলেছে।
-গুড। তোমার কাজ শেষ। তুমি এখন আসতে পারো। কারন, আমি চাইনা বাদল আর এক মুহূর্তও তোমার সাথে কাঁটাক।

বাসা থেকে বেরিয়ে পাশের দোকান থেকে এক খিলি পান কিনলাম। খিদে পেয়েছে। পান খেয়ে খিদাটা নষ্ট করবো কিনা ভাবতে ভাবতে হাঁটা দিলাম।
বাদল আসলেই কঠিন সমস্যায় পড়েছে। তখন এজন্যই কিছু বলতে যেয়েও বলিনি। কারন, বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম, কাজ হবেনা। যা ভেবেছিলাম, তাই হয়েছে। অন্ধকারেও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো না, বাদলের গায়ে ঝুলছিলো চকচকে হলুদ একটা সিল্কের পাঞ্জাবী। মুখে গোঁফ- দাঁড়ির ছড়াছড়ি। মনে- প্রানে আমি কখনোই চাইনি- এরকম কিছু হোক। আমি মারা গেছি- এটা আসলে ও ভাবছে না, এটা ওর বিশ্বাস। মনে গেঁথে নিয়েছে ব্যাপারটা।

কারণটাও বুঝতে পারলাম। দীর্ঘদিন ধরে আমার জীবনযাত্রা ওকে আকৃষ্ট করছিলো। ফুপা, ফুপুর কারনে সেটা এতদিন সুপ্ত থাকলেও এখন আর সেটা সুপ্ত নেই। প্রকাশ্য হতে চলেছে। মন-প্রান থেকে আমার অস্তিত্ব পুরোপুরি সরিয়ে দিয়ে এখন আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করছে বাদল।
পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার।
বাদল এখন নিজেকে হিমু ভাবছে। মহাপুরুষ হওয়ার পরীক্ষায় আমি কতটুক সফল হয়েছি জানিনা তবে বাদলকে নিজের পথে আনতে যে ১০০ ভাগ সফল হয়েছি, সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলাম। যদিও ব্যাপারটা একদমই আমার ইচ্ছাকৃত ছিলো না।
রাত বাড়ছে। আকাশের অবস্থাও তেমন ভালো না। কিছুক্ষন পরপর ডেকে উঠছে মেঘ। যেকোনো মুহূর্তে দুনিয়া ছাপিয়ে নেমে পড়বে জলধারা। আমি দেখেছি, বছরের এ সময়টাতে বিশেষ বিশেষ ক্ষণ ছাড়া বৃষ্টি হয়না। আজকে কোন বিশেষ ক্ষণ কিনা বুঝতে পারলাম না। হাঁটার গতি বাড়ালাম।
ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় পরিচিত রাস্তাটা বেশ অপরিচিত লাগছে।

------------------------------------------------------------------------------
উৎসর্গঃ হুমায়ূন আহমেদ এবং তার হিমু স্বত্বাকে।

(সবার মতো আমিও একসময় নিজের মধ্যে হিমুর কিছু কিছু ব্যাপার খুঁজে পেলাম, যার কারনে নিজেকে এক পর্যায়ে হিমু ভাবা শুরু করলাম। যেদিন মারা গেলেন হুমায়ূন আহমেদ, সেদিন থেকে থেমে গেলো হিমুর পথচলা। ব্যাপারটা মেনে নেয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়লো। সেজন্য, হিমুর একজন অন্ধ ভক্ত হিসেবে কল্পনায় তাকে নিয়ে আবার হাঁটার চেষ্টা করেছি এ গল্পে। হিমুকে নিয়ে কিছু লেখার ক্ষমতা বা যোগ্যতা, কোনটাই আমার নেই। এই গল্পটি হিমুকে নিয়ে সম্পূর্ণ নিজের কল্পনাপ্রসুত একটি গল্প। পাঠকদের কাছে অনুরোধ, আমার ভুল-ভ্রান্তিগুলো ক্ষমা করবেন)
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইনের ফাঁকফোকর-০৩

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২

যেকোনো চাকরির নিয়োগের পরীক্ষা চলছে। সেটা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিভিন্ন সংস্থা, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক বা উপজেলা পর্যায়ের কোনো কার্যালয়ে হতে পারে। এই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×