somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফতোয়া ২৬ - প্রসঙ্গ - স্বামীর ওপর স্ত্রীর অধিকার

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১২:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রশ্ন : এমন এক ব্যক্তির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, যে লোকটি আমার চেয়ে বিশ বছরের বড়ো, কিন্তু বয়সের এই পার্থক্য আমার জন্যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। বয়সের এই ব্যবধানকে আমি কিছুই মনে করতাম না যদি তার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো হতো। তিনি আমার ভরণ পোষণের কোনো অভাব রাখেননি বরং আমার জন্যে যথেষ্ট টাকা পয়সা খরচ করেন। তিনি আমার সাথে কখনও ঝগড়াও করেন না। কিন্তু এসব ছাড়াও তো অন্য কিছু রয়েছে, যা আমার প্রয়োজন। তার মুখের দুটি ভালোবাসার কথা শোনার জন্যে আমি ছটফট করি। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে প্রেম ভালোবাসা আবেগ আন্তরিকতার সম্পর্ক থাকে তার মধ্যে এসবের কিছুমাত্র নেই। এক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে বিরাজ করে শীতল সম্পর্ক। তিনি আমাকে মনে করেন রান্না করার এবং সন্তান জন্ম দেয়ার মেশিন। এসব বিষয়ে একবার তার কাছে আমি অভিযোগ করেছিলাম। তিনি আমাকে জবাব দিলেন, আমি কি তোমার ভরণ পোষণের কোনো অভাব রেখেছি?

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে আমার অধিকার কি শুধু ভরণ পোষণ পাওয়া পর্যন্ত? আমার স্বামী আমার সাথে ভালোবাসা এবং আবেগ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন, এ অধিকার কি আমার নেই? আমার স্বামী আমার মানষিক চাহিদা পূরণ করবেন এ অধিকার কি আমার নেই? আমার ধারণা আমার অধিকার রয়েছে। আমার এ ধারণা কি সঠিক?


উত্তর : আপনার ধারণা একশত ভাগ ঠিক। কেননা ইসলামী শরীয়ত স্ত্রীদের বস্তুগত, শারীরিক প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি মনস্তাত্তিক প্রয়োজন পূরণও স্বামীদের জন্যে ওয়াজেব করেছে। এ জন্যে বিশেষ তাকিদ দেয়া হয়েছে। কোরআনে নারী জাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে মানষিক শান্তি প্রেম ভালোবাসার কথাই বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
'তার (কুদরতের) নিদর্শনসমূহের (মাঝে) এও একটি যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে (তোমাদের) সঙ্গিনীদের বানিয়েছেন, যাতে করে তোমরা তাদের কাছে সুখ শান্তি লাভ করতে পারো, (উপরন্তু) তিনি তোমাদের মাঝে ভালোবাসা ও (পারস্পরিক) সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন।' (সূরা আর রোম, আয়াত ২১)

এই আয়াতে বিবাহিত জীবনের উদ্দেশ্য লক্ষ্যের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সংসারে ভালোবাসা, প্রেম, শান্তির পরিবেশ কায়েম করার কথাই বলা হয়েছে। বিবাহিত জীবনে যদি মানসিক শান্তি এবং আবেগ উচ্ছ্বাসের উপাদান না থাকে তবে সেই বিবাহিত জীবন কোরআনের ইপ্সিত বিবাহিত জীবন হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
'তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন করো। (সূরা আন নেসা, আয়াত ১৯)

এই আয়াতের আলোকে সেই সকল স্বামী প্রচন্ড ভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন, যারা মনে করেন যে, স্ত্রীকে ভরণ পোষণের অর্থাৎ ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিয়েই স্বামীর দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এ রকম স্বামীরা ভুলে গেছেন যে, স্ত্রীরা ভাত কাপড় ছাড়াও আরো কিছু পেতে চায়। স্ত্রীর জন্যে ভাত কাপড় যতোটা প্রয়োজন ঠিক ততোটাই প্রয়োজন হাসি তামাশা আদর সোহাগ ছোটোখাটো দুষ্টুমি, প্রেম ভালোবাসা এবং যৌন সম্পর্ক ইত্যাদি।

হযরত রসূল (স.) তাঁর স্ত্রীদের সাথে আচার ব্যবহারে এই মানসিক দিকটির প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। নীচে রসূল (স.)-এর পবিত্র জীবনের কিছু খন্ডচিত্র উল্লেখ করা যাচ্ছে -

বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রসূল (স.)-এর কোনো কোনো স্ত্রী কখনো তার সাথে রুক্ষভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু তিনি স্ত্রীদের তিক্ত কথার জবাব প্রেমপূর্ণভাবে দিতেন।

হযরত রসূল (স.) স্ত্রীদের সাথে হাসি তামাশাও করতেন। স্ত্রীর বুদ্ধি বিবেচনা অনুযায়ী তাদের সাথে ব্যবহার করতেন। তাদের সাথে ক্রীড়া কৌতুক করতেন। এ রকম বর্ণনাও রয়েছে যে, রসূল (স.) হযরত আয়শা (রা.)-এর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। রসূল (স.) বলেন, সেই ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা ঘৃণা করেন, যে ব্যক্তি নিজের পরিবারের লোকদের সাথে রূঢ়ভাবে কথা বলে এবং নিজের মধ্যে অহংকার পোষণ করে।

হযরত রসূল (স.)-এর উদাহরণ আমাদের জন্যে উত্তম উদাহরণ। তিনি নিজেও নবুওতী দায়িত্ব এবং বহুমুখী রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও স্ত্রীদের অধিকার আদায়ে কখনো কার্পণ্য করতেন না। তিনি সব সময় স্ত্রীদের আবেগকে গুরুত্ব দিতেন এবং তাদের মনস্তাত্তিক প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। ইমাম ইবনে কাইয়েম এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, স্ত্রীদের সঙ্গে রসূল (স.)-এর ব্যবহার ছিলো সৌহার্দপূর্ণ এবং আন্তরিক। আনসার বালিকারা হযরত আয়শা (রা.)-এর সাথে খেলাধুলা করতে আসতো। রসূল (স.) কখনোই হযরত আয়শা (রা.)-কে ওই বালিকাদের সাথে খেলতে নিষেধ করেননি। আপত্তিকর কোনো বিষয় হলে সেটা ছিলো ভিন্ন কথা। হযরত আয়শা (রা.) বরতনের যে জায়গায় পানি পান করতেন, রসূল (স.) সেই জায়গায় ঠোঁট লাগিয়ে পানি পান করতেন।

তিনি হযরত আয়শা (রা.)-এর কোলে মাথা রেখে কোরআন পাঠ করতেন। তার কোলে মাথা রেখে আরাম করতেন। মাসজিদে নববীর কয়েকজন হাবশী ক্রীড়া কৌতুক প্রদর্শন করছিলো। রসূল (স.) হযরত আয়শাকে সেই খেলা দেখান। রসূল (স.)-এর পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে হযরত আয়শা (রা.) সেসব ক্রীড়া কৌতুক উপভোগ করেন।

হযরত রসূল (স.) বলেন, তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আমি আমার ঘরের লোকদের জন্যে উত্তম। (যাদুল মাআ'য়েজ)

আছরের নামাজের পর রসূল (স.) সকল স্ত্রীদের ঘরে যেতেন এবং কিছু সময় তাদের সান্নিধ্যে কাটাতেন। তারপর যার পালা থাকতো তার ঘরে রাত্রি যাপন করতেন। এ বিষয়ে তিনি কখনোই অমনোযোগিতা প্রদর্শন করেননি। তবে তিনি হযরত আয়শা (রা.)-এর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। কারণ হযরত আয়শা (রা.) ছিলেন সবার চেয়ে কম বয়সী এবং কুমারী। এটা কোনো গোপন কথা নয় যে, বিধবা এবং তালাকপ্রাপ্তাদের চেয়ে অল্পবয়স্ক কুমারী স্ত্রীর প্রতি বেশী মনযোগ দেয়া স্বাভাবিক কারণেই প্রয়োজন ছিলো।

আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, রসূল (স.) স্ত্রীদের বস্তুগত প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি কিভাবে তাদের মানসিক চাহিদা পূরণ করতেন। এ ব্যাপারে তিনি কতোটা আন্তরিক ছিলেন।

সাহাবায়ে কেরামও রসূল (স.)-এর পদাংক অনুসরণ করতেন। রুক্ষ্ম স্বভাব এবং কঠোর মেজাজের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, স্বামীদের উচিত স্ত্রীদের সাথে শিশুর মতো আচরণ করা, তাদের সাথে খেলাধুলা করা এবং তাদের সাথে ভালোবাসা স্থাপন করা।

আমাদের জন্যে রসূল (স.) এবং সাহাবায়ে কেরামের উদাহরণের চেয়ে বড়ো উদাহরণ আর কি হতে পারে?



*** জবাব দিয়েছেন শায়খ ইউসুফ আল কারদাওয়ী ***
*** অনুবাদ করেছেনঃ হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ ***
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১২:৫২
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

লিখেছেন আবু ছােলহ, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৮

ব্লগ লিখেছি: কথাটার পরে ভাসছে ১১ বছর ১১ মাস... কথাটা

গুগল থেকে নেয়া ছবি।

সামুতে মাল্টি নিক নিয়ে অনেকেই কথা বলেন। অনেকের কাছে মাল্টি যন্ত্রণারও কারণ। শুধু যন্ত্রণা নয়, নরক যন্ত্রণাও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×