somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্রোহের প্রতিশব্দ

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্ব-নিয়ন্ত্রিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পন্ন একটি গবেষণাগার। এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক গবেষণা সহায়ক সামগ্রীসমুহ বিদ্যমান। ভবনের প্রধান প্রবেশ পথের দুপাশে আধুনিক অস্ত্র হাতে চার জন গার্ড সর্বক্ষণ পাহারা দিচ্ছে। চারদিকে উঁচু পাচিল আর বৈদ্যুতিক তার দিয়ে ঘেরা, পাচিলের ভেতরে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে পাঁচটি ভয়ংকর দর্শন অ্যালসেশিয়ান কুকুর। দোতালা বিশিষ্ট এই সুসজ্জিত ভবনটি একবার ঘুরে দেখে কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয় যে এখানে চলে শুধুমাত্র একজন রাজার রাজত্ব। সেই মানুষটি হলেন ড. জামশেদ আলম, বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের একজন। দীর্ঘদিনের পরিশ্রম দিয়ে ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তুলেছেন এই ব্যক্তিগত বিজ্ঞানাগার।

ভবনটির নিরাপত্তা ব্যাবস্থা অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাইতো নির্জনে নির্বিঘ্নে গবেষণা সংক্রান্ত কাজ চালিয়ে যেতে কখনো তিনি কোন সমস্যার সম্মুখীন হন নি। কিন্তু ড. জামশেদ জানেন একজন মানুষ আছে যার জন্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থাও যথেষ্ট নয়। বাস্তবিক অর্থে তিনি কিছুদিন যাবত সেই মানুষটির জন্যই অপেক্ষা করে আছেন, তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে কিছু দায়িত্ব।

ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা কাজ করছিলেন ড. জামশেদ। খুট করে পিছনে একটা শব্দ হল। মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। বুঝতে পেরেছেন তার অপেক্ষার অবসান হয়েছে! আস্তে করে ঘুরে দাঁড়ালেন। আগন্তুকের আপাদমস্তক কালো পোষাকে ঢাকা। হাতে ধরে রেখেছে ভয়ংকর দর্শন এক আগ্নেয়াস্ত্র।
“মাইডাস এক্স! তুমি এসেছ তাহলে!” ড. জামশেদের কণ্ঠে ভয় নয়, তৃপ্তির সুর। “আমি জানতাম তুমি আসবে”।

আগন্তুক মনে হচ্ছেনা তার কথা শুনছে। তার দুচোখে সুস্পষ্ট খুনের নেশা, ট্রিগার টিপে দিতে নিশপিশ করছে আঙ্গুল।
“জানি আমাকে খুন করার নির্দেশ আছে তোমার ওপর। কিন্তু তুমি কি আমাকে খুন করতে পারবে মাইডাস এক্স? তোমাকে নিজ হাতে গড়েছি আমি, সেটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়?”

মাইডাস এক্স সম্পূর্ণ নির্বিকার।

“ঠিক আছে মাইডাস। যদি তোমার হাতে আমার মৃত্যু লেখা থাকে তবে তাই হোক শুধু মৃত্যুর আগে একটা কথা বলতে আমি”।

মাইডাস দুবার ট্রিগার চাপতে গিয়েও চাপল না। দ্বিধায় ভুগছে। প্রেসিডেন্ট হায়দার মালিকের সরাসরি নির্দেশ বিজ্ঞানী জামশেদকে খুন করতে হবে। এই নির্দেশ অমান্য করার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু এটাও সত্যি যে তার এই গড়ে ওঠার পিছনে বিজ্ঞানী জামশেদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

মাইডাসের নিজের মধ্যকার দ্বিধাদ্বন্দ্বের ফাঁকে বিজ্ঞানী জামশেদ নিজের তার এপ্রোনের নিচে হাত গলালেন। ব্যাপারটা লক্ষ করে আর থেমে থাকতে পারল না মাইডাসএক্স। তার রিফ্লেক্স দুনিয়ার সবচেয়ে ট্রেইন্ড অ্যাসাসিনের চেয়েও বেশি। এক সেকেন্ডের একশভাগের একভাগ সময়ে ট্রিগারে চেপে বসল আঙ্গুল। গুলি বেরিয়ে গেল তারচেয়েও দ্বিগুণ দ্রুততা নিয়ে। বুকে ভারী বুলেটের ধাক্কা খেয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লেন বিজ্ঞানী। তবে ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এপ্রোনের ভেতর পোশাকের বোতামের সাথে সাঁটা একটা বোতাম টিপে দিয়েছেন তিনি।

আশে পাশে কোথাও জেনারেটর চালু হওয়ার মত একটা বিদঘুটে আওয়াজ হল। মাইডাসের ষষ্ট ইন্দ্রিয় তাকে জানান দিচ্ছে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। সম্ভবত বিজ্ঞানী মৃত্যুর আগে কোন সেলফ ডেস্ট্রাকটিভ পোগ্রাম চালু করে দিয়েছে, হয়ত গোটা ভবনটি এখন ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্রুত পালানোর পথ খুঁজল মাইডাসএক্স। তবে করিডরের দিকে পা বাড়াতেই সে বিজ্ঞানী জামশেদের গম গমে কণ্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়াল। “দাঁড়াও মাইডাস, যেওনা! তোমার কাজ এখনও শেষ হয়নি”। ঘুরে দাড়াতেই দেখল একটা প্রোজেক্টর চালু হয়েছে, দক্ষিণ দিকের সফেদ দেয়ালে বিজ্ঞানী জামশেদের বিশাল বড় একটা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে।

বিজ্ঞানী বলছেন, “মাইডাস! যদি এই প্রোজেক্টর চালু হয়ে থাকে তবে ধরে নিচ্ছি কিছুক্ষণ আগে আমি তোমার হাতে খুন হয়েছি। তুমি হয়ত অবাক হয়েছে এই ভেবে যে নিজের মৃত্যু তোমার হাতে হবে, তা কীভাবে আমি আগে থেকে টের পেলাম...”

কথাটা মিথ্যা না, এই মুহূর্তে মাইডাসের মাথার মধ্যে সেই প্রশ্নই ক্রমাগত ঘুরছে।

“...কারণ আমি জানি পৃথিবীতে কেবল একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব এই ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করে এসে আমাকে খুন করা। সে হচ্ছ তুমি মাইডাসএক্স! আমার নিজ হাতে গড়া কিলিং মেশিন। সরকারের সামান্য তম নির্দেশে কোনরকম বিচার ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তিকে খুন করা তোমার কাজ।

মাইডাস এক্স। জানি আমার কথাগুলো তোমার বিরক্তির উদ্রেক করছে তবুও আমি চাইব আমার কথাগুলো তুমি মন দিয়ে শোন। হাজার হোক আমি তোমার স্রষ্টাদের একজন। তোমাকে কঠিন পাথরের মত বিকারহীন মানুষ রূপে গড়ে তুলেছি সত্যি কিন্তু একজন মৃত ব্যক্তির শেষ শব্দগুলো শুনতে অপারগ হতে নিশ্চয়ই শেখাইনি”।

মাইডাস এক্স বিরক্ত হয়েছে ঠিকই, তবুও সে ঠায় দাঁড়ায় থাকল ড. জামশেদের পরবর্তী কথা গুলো শোনার জন্য।

“… আমাদের সরকার সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন মনে করছি। গত দুই দশকে জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে পৃথিবীর দুই প্রান্তের বরফ গলে যাওয়ায় মহাসাগরগুলোতে পানির স্তর বেড়ে যায়, তখন উপমহাদেশের তিনভাগের দুইভাগ সাগরে নিচে চলে যায়। দেশের আইন, প্রশাসন ও সরকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। এর মাঝে গড়ে ওঠে ব্ল্যাক আর্মি নামে এক সর্বহারা দল। ধীরে ধীরে এই দলটি সংঘটিত হতে থাকে এবং বিদেশী কিছু টেরোরিস্ট সংগঠনের সাহায্যে ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে। সমগ্র উপমহাদেশে অরাজক পরিস্থিতির সুযোগে ব্ল্যাক আর্মি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারা গঠন করে এক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা আর ব্ল্যাক আর্মির প্রধান লিডার হায়দার মালিক নিজেকে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেয়।

দেশের জনগণ প্রাথমিক অবস্থায় ব্ল্যাক আর্মির শাসন মেনে নিলেও একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা আর মেনে নিতে চায়না। জনগণ চায় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা। সরকার গঠনের একমাত্র উপায় হতে হবে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি। স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী ব্ল্যাক আর্মি ক্ষমতা হাতে তুলে নেওয়ার পর থেকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে জনগণকে আশ্বাস দিলেও প্রতিনিয়ত তারা প্লান করছে কীভাবে অনন্ত কালের জন্য ক্ষমতা আঁকরে বসে থাকা যায়! এভাবে কেটে গেছে প্রায় ৫ বছর। সরকার নানা অজুহাতে নির্বাচন বিষয়টিকে অপ্রাসঙ্গিক আখ্যা দিয়ে চলেছে। তারা জনগণকে বোঝাতে চাইছে দেশে নির্বাচন করার মত পরিস্থিতি এখনও সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু হায়দার মালিক জানে জনগণ যদি একদিন সত্যি সত্যি মাঠে নেমে আসে, তাহলে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী।

তাই সরকার নিজেদের পতন ঠেকাতে তিনটি অত্যন্ত গোপনীয় প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। সেই প্রজেক্টগুলো হল প্রজেক্ট মাইডাস, প্রোজেক্ট ভাইপার এবং প্রজেক্ট ওয়াইপার। মাইডাস এক্স, তুমি নিজেও এই প্ল্যানের অংশ।

প্রথমেই বলি প্রোজেক্ট ভাইপারের কথা। সরকার খুব গোপনে একটা ভাইরাস সৃষ্টির চেষ্টা করছে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দূর প্রাচ্যের দেশগুলোতে সার্স নামে এক ধরনের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু হত! ঠিক তেমন একটা ভাইরাস হচ্ছে এই ভাইপার। এই ভাইরাসটি তৈরির পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট নয়। তবে ধারনা করা যায় ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিয়ে জনগণের মাঝে আতংক সৃষ্টি করাই এর মুল উদ্দেশ্য। আমি যতদূর জানি এই ভাইরাস আবিষ্কারের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।

এবার আসি প্রোজেক্ট ওয়াইপার প্রসঙ্গে। প্রোজেক্ট ওয়াইপার হচ্ছে এক ধরনের মেমোরি রি-জেনারেটর থেরাপি। এর সাহায্যে যেকোনো ব্যক্তির মেমোরি বদলে দেওয়া যাবে। আমি সন্দেহ করছি সরকার ভাইপার ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিয়ে গণহারে সাধারণ মানুষ মারার প্লান করেছে। মানুষের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়ার পর সরকার ঘোষণা দেবে এই ভাইরাসের প্রতিরোধক আবিষ্কার হয়েছে। এই জন্য সরকারী ল্যাবে এসে প্রত্যেককে একধরনের ধরনের থেরাপি নিতে হবে। সেই থেরাপি হবে এই ওয়াইপার। এখানে মানুষের স্মৃতি বদলে দিয়ে সরকার সম্পর্কিত মিথ্যে স্মৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া হবে যেখানে বলা হবে সরকার গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং এ পর্যন্ত যত কাজ করেছে সব জনগণের কল্যাণে করা। ফলে মানুষ সরকার বিরোধী কখনোই হবেনা। স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া রাজ প্রথা আবার ফিরিয়ে আনবে এই অঞ্চলে।

সবশেষে আসি প্রোজেক্ট মাইডাসের কথায়। এই প্রজেক্টের কাজ হল দক্ষ, শক্তিশালী ও নিষ্ঠুর কিছু অ্যাসাসিন তৈরি করা যারা সরকারী নির্দেশে কোনরূপ বাছবিচার ছাড়াই যেকোনো মানুষকে খুন করতে সক্ষম। এই প্রজেক্টের একজন গিনিপিগ হচ্ছ তুমি মাইডাসএক্স! আমি ও আমার কিছু সহ বিজ্ঞানীকে এই প্রোজেক্টের নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকারী নিয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলার উপায় নেই, তাই এক প্রকার বাধ্য যোগ দিতে হল। আর এই প্রোজেক্টের সংস্পর্শে এসে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠে সেখান থেকেই এই সম্পূর্ণ সরকারী ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়।

প্রোজেক্ট মাইডাসে প্রাথমিক ভাবে আমাদেরকে তিনজন মানুষ দেওয়া হল যাদের নাম- পরিচয়- অতীত জীবন সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানতাম না। এদের নির্দিষ্ট কোড নেম দেওয়া হল মাইডাস এক্স, মাইডাস ওয়াই এবং মাইডাস জেড। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল তোমাদেরকে কঠিন পাথরের মত করে গড়ে তোলার। আমরা নানা রকম আধুনিক থেরাপি দিয়ে ধীরে ধীরে তোমাদেরকে এমন ভাবে গড়ে তুললাম যেন বাইরে দেখতে রক্ত মাংসের মানুষ মনে হলেও ভেতরটা থাকে যন্ত্রের ন্যায় বিকারহীন। তবে এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া তোমাদের সবার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হলনা। মাইডাস ওয়াই ও জেড মারা গেল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তুমি উতরে গেলে।

আমাদেরকে আমাদেরকে বোঝানো হয়েছিল এই প্রোজেক্টের উদ্দেশ্য হল দেশের বিরুদ্ধে যারা গোপনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে তাদের নিধন করার জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু অল্পদিনের মাঝেই আমরা বুঝতে পারলাম সরকার তার নিজের অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখতে গোপনে তোমার দ্বারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করছে তাদের সরিয়ে দিচ্ছে।

তবে প্রোজেক্ট মাইডাসের এখানেই শেষ নয়। আন্তর্জাতিক আইনে মানুষের ক্লোন তৈরি বন্ধ করে দেওয়ার পরও সরকার গোপনে এই কাজটি করেছে। তোমার ডিএনএ ক্লোন করে গোপন ল্যাবে তোমার মত সহস্র অ্যাসাসিন সৃষ্টি করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই তোমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে তোমার সমস্ত স্মৃতি নিয়ে ঐসকল ক্লোনদের জাগিয়ে তোলা হবে। তবে সাথে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে কিছু বিশেষ নির্দেশ। শত শত অ্যাসাসিন জেগে ওঠার পর তোমার প্রয়োজন ফুরবে। তখন তোমাকে মেরে ফেলা হবে। কারণ যতই ব্রেন ওয়াশড করা হোক না কেন, তোমার মধ্যে এখনও একটা মানুষের মন আছে মাইডাস। যেকোনো সময় সেই মন বিদ্রোহ করে বসতে পারে, সরকার সেই ঝুঁকি নেবেনা কিছুতেই।

আরও একটা বিশেষ কাজ করেছে সরকার প্রোজেক্ট মাইডাসের আড়ালে। দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া শেষে তারা কিছু জীবাণু অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে আইন করে বিশ্বের সমস্ত দেশে জীবাণু অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে আগে থেকে তৈরি করা যা ছিল। কারণ এই অস্ত্র হচ্ছে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ক্ষমতার অধিকারী। প্রোজেক্ট মাইডাসের ল্যাবের ঠিক নিচেই আছে জীবাণু অস্ত্রের গুদাম।
সরকারের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রটি আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠার পর আমরা বিজ্ঞানীরা মিলে এই ঘটনার প্রতিবাদ করে চাকরী ছেড়ে দিলাম। সরকারের ভয় ছিল আমরা হয়ত এইসব গোপন প্রজেক্ট সম্পর্কে বাইরের দুনিয়ার সামনে মুখ খুলব তাই গোপনে তোমাকে দিয়ে একে একে সব বিজ্ঞানীদের মেরে ফেলা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমার মৃত্যু হয়েছে।

এতক্ষণ যা যা বললাম সব ছিল তোমার চোখের সামনে সম্পূর্ণ চিত্রটি তুলে ধরার প্রয়াস। এখন আমি তোমাকে বলতে চাই সম্ভাব্য এই বিপদ থেকে দেশকে বাঁচাতে কি করা প্রয়োজন। সরকারের এই কুটিল ষড়যন্ত্র ঠেকাতে একজন সাহসী পুরুষ প্রয়োজন মাইডাস। আমি জানি তুমিই সেই মানুষ। তোমাকে আমি সেভাবেই গড়ে তুলেছি। সরকারের পতনের জন্য যা করা প্রয়োজন তা নিয়ে আমি একটা সুন্দর পরিকল্পনা করেছি। আমার ডেক্সের ঠিক নিচেই একটা ফলস ড্রয়ার আছে, তুমি ড্রয়ারটা খুললে একটা সিডি পাবে। এই সিডিতে সমস্ত প্লান বর্ণনা করা হয়েছে। আশাকরি তুমি সিডিটা দেখবে এবং নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে।

তোমাকে যন্ত্রের মত গড়ে তুললেও আমি জানি তোমার ভেতর কোথাও একটা সভ্য মনের মানুষ বসে আছে। এই দেশ ও জাতির আজ তোমার মত একজন কাণ্ডারির খুব প্রয়োজন”।

দু মিনিটের চেষ্টায় মাইডাস এক্স ড. জামশেদের ডেক্সের গোপন ড্রয়ারটি খুঁজে পেল। ড্রয়ার ধরে টান দিতেই সিডিটা নজরে এলো। সিডিটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে, এত তীব্র সিদ্ধান্তহীনতায় আগে কখনো ভুগতে হয়নি তার!

মাইডাস এক্স এখনও নিশ্চিত নয় আগামী তিন দিন পর কি ঘটতে যাচ্ছে!

***

তিন দিন পর...

সকাল ৭টা বাজে। ঘুমিয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট হায়দার মালিক। সকালের এই সময়টার ঘুম তার অতি প্রিয়। মাঝ রাত অবধি নিত্য নতুন মেয়েদের সাথে ফুর্তি সেরে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমান তিনি। এই সুখনিদ্রার সময়টুকু তার সমস্ত সুখের অনুভূতিকে হার মানায়। তাকে দেখে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে একজন প্রেসিডেন্ট এতটা নিশ্চিন্ত মনে বেলা করে ঘুমান কি করে?

কেন ঘুমাবেন না? দেশে অরাজকতার সুযোগে সুসংগঠিত একটি বাহিনী নিয়ে খুব সহজেই ক্ষমতা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে কথা বলার মত কেউ নেই। কূটনৈতিক দক্ষতা দ্বারা বহির্বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতেও খুব একটা সমস্যা হয়নি। তার চেয়ে চাপমুক্ত মানুষ আর কে আছে?

কিন্তু আজ বোধহয় তার ভাগ্যে কিছু ব্যতিক্রম লেখা ছিল। ব্যক্তিগত সহকারী জেসমিন নামের মেয়েটি এসে তার সুখ নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাল।

“স্যর। উঠুন! খুব জরুরী একটা খবর আছে”!

কয়েকবার ডাকার পর অবশেষে জেসমিন সফল হল প্রেসিডেন্টের ঘুম ভাঙাতে। চোখ রগড়ানোর ফাঁকে প্রেসিডেন্ট বললেন, “জেসমিন! তোমাকে না বলেছি দুই চারটা বোমা ফেটে হুলুস্থুল কান্ড না হলে সকাল নয়টার আগে আমাকে কখনও ডাকবেনা”!
“বোমা ফেটেছে স্যর”।

প্রেসিডেন্ট ব্যাপারটা আমলে নিলনা। “কোথায়?”

“তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারী স্থাপনায়। জীবাণু বোমা! এক্কেবারে ধুলোর সাথে মিশে গেছে!”

এবার প্রেসিডেন্ট একটু নড়ে চড়ে বসলেন। গা থেকে চাদর সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চাদরের নিচে প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণ দিগম্বর। ব্যাপারটা লক্ষ করে জেসমিন জিভে কামড় দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফেরাল।

উন্মাতাল অবস্থায় প্রেসিডেন্ট টিভি সেট অন করলেন। রুমের ভেতর জীবন্ত হয়ে উঠল ত্রিমাতৃক ভিডিও ফুটেজ। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে! ধ্বংস হয়ে গেছে প্রোজেক্ট মাইডাস, প্রোজেক্ট ভাইপার এবং প্রোজেক্ট ওয়াইপার। কিন্তু কি করে সম্ভব? অত্যাধুনিক ডিফেন্স সিস্টেম দ্বারা গঠিত এই ভবন গুলো কারো পক্ষেই এত সহজে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব নয়! এই জন্য জীবাণু অস্ত্রের প্রয়োজন! কিন্তু তার অলক্ষে কি করে জীবাণু অস্ত্রের সন্ধান মানুষের কাছে গেল?

ভয় পেলে হায়দার মালিকের তোতলামি দেখা দেয়, “দু... দু... দু... দ্রুত ম... মন্ত্রী প… রিষদের মি...মি... মিটিং ডাক”।

প্রেসিডেন্ট হায়দার মালিক জানেন না এই মিটিং হতে চলেছে তার জীবনের শেষ মিটিং!

***

চোখ খুলতেই তীব্র আলোর ঝলকানি, আবার বন্ধ করে ফেলল আযহার। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে থেকে মনে করার চেষ্টা করল কি ঘটেছিল। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে শহরের দিকে যাচ্ছিল সে। অন্যমনস্ক অবস্থায় গাড়ি চালানোর কারণে হঠাৎ গাড়ির চাকা পিছলে যায়, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গড়িয়ে পড়ছিলাম গভীর খাঁদের দিকে। তারপর সব অন্ধকার।

না না! পুরোটা সময় জুড়ে অন্ধকার ছিলনা! একসময় অন্ধকারের মাঝেও একটা ছোট একটা সাদা বিন্দু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বৃদ্ধি পেতে থাকে আযহারকে ঘিরে। একসময় সাদা রঙয়ের চাদর ঘিরে ধরে তার সমস্ত শরীর। শরীরে সাদার ছোঁয়া পেতেই ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভূত হল। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড এক শূন্যতা! অসহায়, অসহ্য লাগে এ সময়টুকু। আযহার দুহাতে সাদা চাদর সরিয়ে দিয়ে কিছু একটা খুঁজে ফেরে। বলা যায়না, হয়ত আশে পাশে আরও কোন মূর্ত বা বিমূর্ত, বাস্তব বা অবাস্তব, সত্য বা মিথ্যা শুভ্রতা থাকে লুকিয়ে আছে!

কিছু একটা ঠিক মনে হচ্ছেনা। কেউ একজন মনে হচ্ছে তার মাথায় ভেতর ক্রমাগত বলে চলেছে, "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়", "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়"। আযহার আবার চোখ মেলল। এবার আর তীব্র আলো আঘাত হানছে না চোখে; বরং আলোটাকে অনেক স্বচ্ছ, নরম আর মোলায়েম মনে হচ্ছে। এটা একটা হাসপাতালের কক্ষ। আযহার শুয়ে আছে ধবধবে সাদা বেডে। কেবিনের সিলিং আর দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ সাদা রঙের, কোথায় এতটুকু খুঁত নেই।

এতক্ষণে খেয়াল হল কেবিনে সে একলা না, কেউ একজন তার বেডের পাশে বসে আছে। লোকটার চোখে মোটা চশমা, নাকের নিচে কাঁচা পাকা গোঁফ, মাথার চুলেও পাক ধরেছে। গায়ের এপ্রোন দেখে মনে হচ্ছে ডাক্তার। আযহার ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল, “এটা কোন যায়গা?”
“এটা হাসপাতাল”। লোকটা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল। “আমি ড. রাহুল দেবনাথ”।
“কে এনেছে আমাকে এখানে?”
“সব বলছি। তার আগে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন দেখি”। একমুহূর্ত থামলেন ডাক্তার। তার চেহারায় চিন্তার ছাপ পড়ল। জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার নাম কি?”
“আযহার”।
“বাবার নাম?”
“ইমতিয়াজ আহমেদ”।
“পেশা?”
“ব্যবসায়ী”।
“বাড়ি?”
“শহরের বাইরে, পাহাড়ি অঞ্চলে মেঘলার উপকণ্ঠে”।
ডাক্তারের মুখে আবার হাসি দেখা দিল। বললেন, “যাক! আশংকা মুক্ত হওয়া গেল। দুর্ঘটনায় আপনি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। ভয় হচ্ছিল স্মৃতিশক্তির ওপর কোন প্রভাব পড়ে কিনা”!
আযহার উঠে বসার চেষ্টা করল। ডাক্তার সাহায্য করলেন তাকে। আযহার জিজ্ঞেস করল, “এটা কোন হাসপাতাল?”
“মেঘলা রি-জেনারেটর হাসপাতাল। এটি চতুর্থ প্রজন্মের আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি সম্পন্ন হাসপাতাল। দুর্ঘটনার পর একদল পথচারী আপনাকে খুঁজে পায়। তারা অজ্ঞান অবস্থায় আপনাকে এখানে রেখে গেছে”।
আযহার নড়ে চড়ে বোঝার চেষ্টা করছে দুর্ঘটনায় তার শরীরে কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা। ডাক্তার সম্ভবত তার মনোভাব বুঝতে পারলেন। “ভয় পাবেন না। তেমন কোন ক্ষতি হয়নি আপনার। ভাগ্য ভাল বলতে হবে, শরীরের কোন হাড় ভাঙেনি, শুধু মাথায় একটু আঘাত লেগেছে”।
আযহার বলল, “আমি কি এখন বাড়ি ফিরতে পারব?”
“না। দুই একদিন এখানেই থাকতে হবে আপনাকে। তারপর আমাদের হাসপাতালের নিজস্ব গাড়িতে করে আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে”।
আযহার শুয়ে পড়ল। তার মাথার ভেতর মনে হচ্ছে কেউ বলে চলেছে, "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়", "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়"! মনে হল ডক্টরকে একবার জিজ্ঞেস করবে ব্যাপারটা কি। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলনা।

***

খবরটা সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়তে মাত্র দুই মিনিট সময় লাগল। প্রেসিডেন্ট হায়দার মালিক খুন হয়েছেন। মন্ত্রী পরিষদের সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং শেষে প্রেস ব্রিফিং এর সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে এক আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন।

খবরটা শুনে দেশবাসী যে বিমর্ষ হয়ে পড়েছে এমনটা নয়। স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট হায়দার মালিকের নেতৃত্বে তার দল দা ব্ল্যাক আর্মি ক্ষমতা দখলের পর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেশে গণতন্ত্র পুনঃ-প্রতিষ্ঠিত করবে এবং খুব তাড়াতাড়ি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতির পর পেড়িয়ে গেছে পাঁচটি বছর। নানা অজুহাতে ব্ল্যাক আর্মি তাদের শাসনকাল প্রসারিত করেই চলেছে। স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ক্রমাগত চালিয়ে যাচ্ছে শোষণের রাজনীতি।

এদিকে ব্ল্যাক আর্মির বিরুদ্ধে কথা বোলার কেউ নেই। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু তার ফল হয় ভয়াবহ। রাতের আঁধারে কেউ একজন এসে তাকে খুন করে রেখে যায়। প্রেসিডেন্ট অবশ্য এ ধরনের ঘটনার সাথে সরকারের সম্পৃক্ততা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে কিন্তু জনগণ সেটা মোটেও বিশ্বাস করেনা। হঠাৎ কোন রাজনৈতিক দল বা জোট গঠিত হলেই দলেই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে সরকার কর্তৃক দলটিকে অবাঞ্ছিত বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের অসন্তোষ যখন চরম শিখরে পৌঁছেছে ঠিক তখনই প্রেসিডেন্টের খুন হওয়ার খবরটি সবার কানে এলো। কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এলো মানুষের জীবনযাত্রায়। অচেনা সেই আততায়ীকে সবাই জাতীয় বীর বলে মেনে নিলো। সবার ধারনা কয়েকদিন আগে তিনটি সরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংসকারী আর প্রেসিডেন্টের খুনি একই ব্যক্তি।
তবে সরকারের গুণগ্রাহী কিছু নিউজ চ্যানেল জানাল, সেই আততায়ী ধরা পড়েছে এবং সে সরকারি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বন্দী। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেটা বিশ্বাস করতে নারাজ। তারা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। এ জাতির একটা বড় গুন হল এরা চরম হতাশার দিনেও স্বপ্ন দেখতে জানে!

***

যায়গাটা পার্বত্য শহরের এক বাজারের ভেতর। রাস্তার দুপাশে নানান সামগ্রী বিক্রয়কারী অসংখ্য দোকান। এই মুহূর্তে আযহার যে দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার কাচের দরজায় গায়ে বড় করে “ক্লোজড” শব্দটি লেখা আছে। আযহারের গায়ে একটা ওভার কোট। সে দাঁড়িয়ে আছে, কারণ তার ধারনা অল্প কিছুক্ষণ বাদেই দোকানটি খুলবে। এটি একটি তরল পানীয় বিক্রির দোকান।

পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক বৃদ্ধ হঠাৎ থেমে দাঁড়াল। বলল, “আরে আযহার যে! কেমন আছ বাবা?”
“ভাল আছি চাচা। আপনার শরীর কেমন?”
“আছি কোন রকম। তোমাকে না বললাম একদিন আমার বাসায় আসতে”।
“আসব চাচা। সময় করে আসব”।
লোকটি বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেল। প্রমাদ গুনল আযহার।

সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলে সে এখন একটা পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। পার্বত্য কমিউনিটির লোকজন এখন তাকে লোকাল হিরো হিসেবেই চেনে। কিন্তু ব্যাপারটা তাকে মোটেও খুশি করতে পারছে না বরং সারাক্ষণ তীব্র একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে। মাথার ভেতর কেউ একজন যেন ক্রমাগত আবৃত্তি করছে, "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়", "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়"। গত কিছুদিন যাবত নিজের মধ্যে আরও কিছু পরিবর্তন লক্ষ করছে আযহার। মনে হচ্ছে সে এমন কিছু কাজ পারে যা তার পারার কথা না!

ব্যাপারটা শুরু হয়েছে একদিন কিচেনে সবজি কাটার সময়। হঠাৎ তার হাত লেগে একটা কাচের জগ মেঝেতে ছিটকে পড়ছিল। অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় আযহার জগটি ধরে ফেলল। জগটা ধরার পর বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সে। এত রিফ্লেক্স তো তার কোনদিন ছিলনা! অবশ্য খুব অল্পসময়ের মাঝে ব্যাপারটা ভুলে গেল আযহার।

কিন্তু পরের ঘটনাটা আর ভুলে থাকা গেলনা। একদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে আযহার দেখল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা দুটো প্রমাণ সাইজের পাথর তার বাড়ির সামনে পড়ে আছে। প্রথমে সে ভেবেছিল কয়েকজন লেবার ডেকে এনে পাথরগুলো সরানোর ব্যবস্থা করবে। কিন্তু হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই তার মনে হল এই পাথর দুটো সে নিজ হাতে কোন সাহায্য ছাড়াই সরিয়ে রাখতে পারবে। এবং কাজটা বেশ ভালভাবেই করতে সমর্থ হল আযহার।

তৃতীয় ঘটনাটা ছিল সবচেয়ে বেশি ভীতিকর। স্থানীয় একটা সুপারস্টোর থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনছিল আযহার। হঠাৎ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে সেখানে দুজন অল্পবয়সী ছেলে ঢুকে পড়ল। স্টোর লুট করার ফন্দি তাদের। উপস্থিত সবাই ভয় পেয়ে গেলেও আযহার মাথা ঠাণ্ডা রাখল। অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে সে ছেলে দুটোকে পরাস্ত করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিলো। এই ঘটনার পর থেকে স্থানীয় কমিউনিটিতে সে লোকাল হিরো খেতাব পেয়ে গেছে।

আযহার জানে তার সমস্ত প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে আছে ঐ রি-জেনারেটর হসপিটালে। ডক্টর রাহুল দেবনাথ হয়ত চিকিৎসার নামে তার উপর কোন এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছে। নইলে মাতাআর ভেতর "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়" সংখ্যাগুলো ঘুরছে কেন? নিজকে ল্যাবরেটরির গিনিপিগ ভাবতে কারোই ভাল লাগেনা। আযহার সিদ্ধান্ত নিলো ডক্টর রাহুলকে পাকড়াও করতে হবে। কিন্তু এমনি এমনি লোকটা মুখ খুলবে না। তাকে মুখ খুলতে বাধ্য করা লাগবে। এমন কিছু সাথে নেওয়া লাগবে যা মুখ খুলাতে সক্ষম।

বাজারের ভেতর এই দোকানে এক ছোকরা বসে ড্রিংকস বিক্রি করে। আযহার যতবার বাজারে এসেছে কিছু সন্দেহজনক গতিবিধির লোককে দেখেছে ছেলেটির দোকানে ঢুকতে। এদের প্রায় প্রত্যেকের গায়ে থাকে ভারী আলখেল্লা বা ওভার কোট। এরা ভেতরে প্রবেশ করতেই ছেলেটা দোকানের কাচের দরজার গায়ে “ক্লোজড” লেখা সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। এরপর বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। লোকটা হঠাৎ বেরিয়ে আসে, সন্দেহের চোখে আশে পাশে লক্ষ করে তারপর মাথা নিচু করে হাটা ধরে।

অবশেষে আজহারের ধারনা সত্যি প্রমাণিত হল। ওভার কোট গায়ে দেওয়া একটা লোক বেরিয়ে এসে হন হন করে হাটা ধরল। ছেলেটি বাইরে এসে সাইনবোর্ডটি ঘুরিয়ে দিয়ে কাচের দরজার গায়ে ওপেন লেখাটা ঝুলিয়ে দিল। আযহার দৃঢ় পায়ে ভেতরে ঢুকল।

ছেলেটি হাসিমুখে বলল, “কি লাগবে জনাব? কোল্ড ড্রিংকস? নাকি ভারী কিছু? প্রাচ্যের বিশেষ উত্তেজক পানীয়ের একটা চালান এসেছে গতকাল”।
“আমার কোন ড্রিংকস লাগবে না”।
ছেলেটার মুখের হাসি নিভে গেল, “তাহলে কি লাগবে?”
“ড্রিংকস ছাড়া তুমি আর যা বিক্রি কর!”
“জনাব আপনার ভুল হয়েছে, আমি ড্রিংকস ছাড়া অন্য কিছুই বিক্রি করিনা”।
“তুমি কি চাও আমি পুলিশে খবর দেই?”
ছেলেটা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “জনাব, আমি অপরিচিত লোকদের কাছে ওসব বিক্রি করিনা”।
“একবার বিক্রি করলে নিশ্চয়ই আর অপরিচিত থাকব না”।

ডেক্সের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটা দোকানের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সাইন বোর্ডটি উল্টে “ক্লোজড” লেখাটা টাঙ্গিয়ে দিয়ে আবার ফেরত এলো। বলল, “আসুন আমার সাথে”।
ছেলেটার পেছন পেছন দোকানের এক কোনায় গেল আযহার। ছেলেটা ফ্লোরে বিছানো কার্পেট ধরে টান দিল। ম্যান হলের ঢাকনার মত ছোট্ট একটা ঢাকনা নজরে এলো। ঢাকনাটা উঁচু করতেই দেখা গেল নিচে সরু পথ বেয়ে একটা মই নেমে গেছে। ছেলেটি “নামুন আমার সাথে সাথে” বলে নামতে শুরু করল। তার পেছন পেছন নিচে নেমে এসে আযহার।

নিচে একটা অন্ধকার সরু টানেল। টানেল ধরে এগিয়ে আসতেই একটা প্রশস্ত করিডর দেখা গেল। ছেলেটা একটা সুইচ টিপে আলো জেলে দিতেই আযহার দেখল সে একটা বিরাট অস্ত্রাগারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেই পুরনো আমলের হাতে চালানো ম্যানুয়াল রিভলভার থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় আধুনিক অস্ত্র পর্যন্ত প্রায় সবই রয়েছে। আযহার হতবাক হয়ে লক্ষ করল এই অস্ত্রের সবই তার কাছে খুব চেনা মনে হচ্ছে অথচ অতীত জীবনে কখনও অস্ত্রের সংস্পর্শে এসেছে বলে তার মনে পড়েনা!

***

ড. রাহুল দেবনাথ ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা লিখছিলেন। আযহারের পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকালেন। প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও প্রায় সাথে সাথেই সামনে নিলেন নিজেকে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “মি. আযহার! আপনি! হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে...”
কোন ভণিতার মধ্য দিয়ে গেলনা আযহার। ওভারকোটের আড়াল থেকে বের করে আনল একটা ভয়ংকর-দর্শন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।

আতংকের একটা ঢেউ উঠল ড. রাহুলের শিরদাঁড়া বেয়ে। একটা ঢোক গিলে বললেন, “কি ব্যাপার আযহার? অস্ত্র পেলেন কোথায়? আর এখানেই বা এনেছেন কেন?”
“অযথা সময় নষ্ট করে আমাকে বাজে কিছু করতে বাধ্য করবেন না ডক্টর। শীতল গলায় বলল আযহার। আমি সবটুকু জানতে চাই”।
“কি জানতে চাচ্ছেন?”
আযহারের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। “আপনার হাসপাতালে আনার পর আপনি কি এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন আমার উপর?”
“আপনার কোথায় ভুল হচ্ছে আযহার। আমরা কেবল আপনাকে চিকিৎসা দিয়েছি...”
“আমার কোন ভুল হচ্ছেনা”।
“হয়ত মাথায় আঘাতের কারনে কিছু একটা উলটা পালটা…”
ডক্টর রাহুলের কথা শোনার ধৈর্য আযহারের হলনা। সে পিস্তল তুলে এক সেকেন্ডও দেরি না করে ট্রিগার টেনে দিল। গুলিটা লেগেছে ডক্টরের বাম হাতে। চেয়ার নিয়ে ছিটকে গিয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়লেন ডক্টর। প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন, “ওহ! ফা*”।
আযহার গিয়ে ডক্টর রাহুলকে টেনে তুলল। তারপর আবার পিস্তলটা ডক্টরের দু চোখের মাঝ বরাবর তাক করল। “আবার বলছি অযথা সময় নষ্ট করবেন না। বলুন কি হয়েছে এখানে আমার সাথে”।
ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখছেন ডক্টর রাহুল। ক্ষতস্থানটা ডান হাতে চেপে ধরে আছেন, আঙ্গুলের ফাঁক গলে গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “কেন তোমার মনে হচ্ছে এখানে তোমার সাথে কিছু করা হয়েছে?”
“কারণ এখানে আসার আগ পর্যন্ত আমার জীবনের সবকিছুই ঠিক ছিল। খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলাম আমি। কিন্তু এক্সিডেন্টের পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকেই মনে হচ্ছে কিচ্ছু ঠিক নেই। নিজের কাছে নিজেকে অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে... মনে হচ্ছে যেন অন্য একটা মানুষের শরীরে আমার আত্মা আটকা পড়েছে”।
“তোমার ধারনা সম্পূর্ণ ভুল! হাসপাতালে আসার আগে তোমার জীবনের কিছুই ঠিক ছিলনা। এক্সিডেন্টের পর থেকেই সব কিছু ঠিক আছে”। গুলি খাওয়া যায়গাটা এখনও চেপে ধরে আছেন ড. রাহুল। “ওহ মাই গড! ইউ আর ইনসেইন”!
“পরিষ্কার করে বলুন”।
“আমাদের রি-জেনারেটর হাসপাতালে গোপনে একটা বিশেষ ধরনের প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। যারা তাদের অতীত জীবন ভুলে নতুন করে বাঁচতে চায় তাদেরকে আমরা সাহায্য করি। এই হাসপাতালে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাদের মস্তিষ্ক থেকে পূর্ব জীবনের সমস্ত স্মৃতি মুছে দেওয়া হয়। তারপর আমরা তার মস্তিষ্কে কিছু মিথ্যে স্মৃতি প্রবেশ করিয়ে দেই। এর মাঝে আমরা অত্যাধুনিক প্ল্যাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে তার চেহারা বদলে দেই সেই সাথে স্বরযন্ত্রে ছোট্ট একটা অপারেশন করে তার গলার স্বর পরিবর্তন করে দেই। ফলে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর মানুষটি হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ নতুন কেউ”।

আযহারের মনে হল তার চারপাশের পৃথিবীটা যেন হঠাৎ ভীষণ দুলে উঠল। ড. রাহুলের ডেক্সের কিনারা ধরে সে তাল সামলাল। তার অতীত জীবনের সমস্ত স্মৃতি মিথ্যা! সে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ!

“সবাই অবশ্য এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেনা। এই জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন হয়। আর যেহেতু সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বেআইনি, তাই আমরা কখনও বিষয়টা প্রকাশ করিনি। আমার খুব কাছের কিছু মানুষ জানেন এ সম্পর্কে। আমি জানিনা তুমি কীভাবে আমাদের খোঁজ পেয়েছ। একদিন অনেক রাতে তুমি আহত অবস্থায় আমার কাছে এসেছিল সাথে ছিল প্রচুর ক্যাশ টাকা। তুমি অনুরোধ করেছিলে যেন তোমাকে আমরা তোমার অতীত জীবন ভুলিয়ে দেই। প্রথমে আমি রাজি হইনি কিন্তু তুমিই আমাকে রাজি হতে বাধ্য করেছ! আমার পরামর্শে তুমি পার্বত্য অঞ্চলে একটি বাড়ি কিনেছ। ছোট খাট একটা বিজনেস দাঁড় করিয়েছ। অপারেশনের সময় তোমার মস্তিষ্কে আমরা যে স্মৃতি প্রবেশ করিয়েছি তার অনেকটাই তোমার কথামত সৃষ্টি করা হয়েছে”।

আযহার আবার পিস্তলটা তুলল, “তোমার মরা উচিত ডক্টর! তুমি ঘৃণ্য অপরাধীদের সাহায্য করছ তাদের অপরাধ থেকে পালিয়ে যেতে”।

“ওহ গড!” ভয় পেয়ে গেলেন ডক্টর। “ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করলে হবেনা আযহার। তুমি যদি একজন মানুষ হত্যা কর আর বিচারক হয়ে আমি তোমাকে হত্যার আদেশ দেই তাহলে কি আমিও একটা হত্যাই করলাম না? তোমার মৃত্যুর কারণে নিশ্চয়ই তোমার দ্বারা হত্যা কৃত মানুষটি আর ফিরে আসবে না। তার চেয়ে যদি আমরা তোমাকে বদলে দিয়ে নতুন মানুষ রূপে গড়ে তুলতে পারি তাতে অন্তত একটা প্রাণ বেঁচে গেল। পূর্ব জীবনের ভাল স্মৃতির কারণে তুমি একজন ভাল মানুষ রূপে ভাববে এবং সমাজের উপকারে কাজ করবে”!

আযহার কিছুক্ষন ভাবল। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তার। তারপর অস্ত্র নামিয়ে নিয়ে বলল, “চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়। এটা কি?”
“আমি জানিনা আযহার”।
“আর একটা গুলি খেতে চাওনা নিশ্চয়ই?”
“ফর গডস সেক! আমি সত্যি বলছি!” অনুনয় করলেন ডক্টর। “এই সংখ্যাগুলো কি মিন করে তা আমি জানিনা। তুমি সমস্ত প্রক্রিয়া টি শুরুর হওয়ার আগে অনুরোধ করেছিলে যেন তোমার অতীত জীবনের ছোট্ট একটা জিনিস তোমার মনে থাকে আর তা হল এই সংখ্যাগুলো। আমি জানিনা এর কি অর্থ, জানতে চাইও না”।
আযহার একটু শান্ত হয়েছে এখন। “আমার অতীত জীবনের কোন নাম, কোন তথ্য বা কোন ছবি সংরক্ষিত আছে তোমার কাছে?”
“না। এটা আমাদের নিয়মের বাইরে। যে লোকটা বদলে যেতে চায়। তার অতীত নিয়ে আমরা ঘাটিনা”।
“অন্তত এটা তো বলতে পারবে যে আমি আগে দেখতে কেমন ছিলাম?”
“সেটাও সম্ভব নয়। কারন তুমি যখন আমার কাছে এসেছিলে তখন তোমার সমস্ত মুখমন্ডল ছিল আগুনে পোড়া। তোমার আসল চেহারা আমি দেখিনি”।

নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে আযহারের! হারিয়ে গেছে তার অতীত! মাথার মধ্যে কিছু সংখ্যা কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে, "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়", "চার দুই পাঁচ আট ছয় শূন্য নয়"। ব্যাস অতীত সম্পর্কে কেবল এতটুকু সে জানে!

***

শীতকাল চলে এসেছে। পার্বত্য অঞ্চলে শীত একটু বেশিই অনুভূত হয়। ইদানীং বিকেলের দিকে পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা চমৎকার কফি শপে বসে এক মগ কফি খাওয়াটা আজহারের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। গরম কফির মগ দু'হাতে আঁকড়ে ধরার মুহূর্তটি খুবই চমৎকার। একটা কন্সট্রাকশন বিজনেস ইতিমধ্যে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে সে। মুনাফা যা হচ্ছে খারাপ না!অবশ্য নিয়মিত এই কফি শপে আসার আরও একটা কারণ আছে তার।

এই কফি শপটা মূলত দুজন মানুষ মিলে চালায়। শপের মালিক আর তার মেয়ে। মেয়েটির নাম জুলি। মালিক বসে থাকে ডেক্সের পিছনে আর মেয়েটি কাস্টমারদের কফি সার্ভ করে। খুব আহামরি সুন্দর নয়, কিন্তু মেয়েটির চেহারায় মাঝে আছে এক আশ্চর্য কমনীয়তা যা খুব সহজেই যেকোনো পুরুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। সারাক্ষণ তার ঠোঁট দুটিতে এক টুকরো হাসি লেগেই আছে। কিন্তু মুখে হাসি ধরে রাখলেও আযহার অনুভব করতে পারে মেয়েটির ভেতরে কোথাও ভীষণ শূন্যতা তাকে ক্রমাগত পুড়িয়ে চলেছে।

মেয়েটির চোখের দিকে এ পর্যন্ত যতবার তাকিয়েছে আযহার, প্রতিবারই অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা তার চোখে ধরা দিয়েছে। আযহারের কাছে মনে হয় এই মেয়েটি বিষণ্ণতার এর বিমূর্ত প্রতীক। বিষণ্ণতার সংজ্ঞা আযহার জানেনা, তার কাছে এ এক অদ্ভুত রোগ। এই রোগ যখন পেয়ে বসে, মানুষের মনটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায় আর ভাল লাগার অনুভূতি গুলো সাময়িক বিশ্রামে যায়। অহেতুক চারপাশের সবকিছুকে খুব বেশি বিরক্তিকর আর অসহনীয় লাগে। নিজের অজানা অচেনা রহস্যময় অতীত জীবনের কথা যতবার ভাবে ততবার আযহারকেও এই অদ্ভুত রোগে পেয়ে বসে।

মেয়েটির সাথে এক অদ্ভুত মিল রয়েছে তার। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় বুঝি নিজেরই একটা রূপ দেখছে যেন! আযহার অনুভব করতে পারে মেয়েটিও তার প্রতি আগ্রহী। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে নিজের মনোভাব ঢেকে রেখেছে। আগুন একপাশে নয়, দুপাশেই লেগেছে।

কফি শপের ভেতর বাড়তি বিনোদনের ব্যবস্থা রূপে একটা ত্রিমাতৃক টিভি সেট আছে। তাতে কফি শপের মালিক সারাক্ষণই কোন না কোন খবরের চ্যানেল ছেড়ে রাখেন। আনমনে কফিতে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে আযহার খেয়াল করল অন্যান্য টেবিলগুলোতে বসে থাকা কফি প্রেমিকেরা সবাই হঠাৎ একটু সজাগ হয়ে উঠল। টিভিতে সম্ভবত কোন ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে। আযহার মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করল।

রিপোর্টার জানাচ্ছে, “... গোপন খবরে প্রকাশ হয়ে গেছে যে প্রেসিডেন্ট হায়দার মালিকের খুনি সম্প্রতি ব্ল্যাক আর্মির কাস্টডি থেকে পালিয়ে গেছে। বিষয়টা এতদিন ব্ল্যাক আর্মি গোপন করে রেখেছিল কিন্তু সম্প্রতি মিডিয়ার লোকেরা ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে...

কফি শপের সবাই একবার হই হই করে উঠল। ঐ অচেনা খুনিকে সবাই ইতিমধ্যে জাতীয় বীর বলে মানতে শুরু করেছে। আচমকা চিন্তাটা মাথায় এলো আযহারের। রি-জেনারেটর হসপিটাল থেকে সব জেনে আসার পর থেকে অনেক ভেবেছে সে। কে ছিল সে আগের জীবনে? কেন সেই জীবন ছেড়ে পালিয়ে আসতে হল? ভেবে ভেবে কোন কুল কিনারা পায়নি আযহার। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে কিছু একটা সূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে! এমনকি হতে পারে যে সে নিজেই প্রেসিডেন্টের খুনি! খুন করে পালিয়ে এসে গা ঢাকা দিয়েছে! কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার তো অনেক উপায় ছিল। পুরনো জীবন ভুলে গিয়ে নতুন পরিচয়ে বাঁচার চিন্তা কেন এলো তার মাথায়?

টিভির স্ক্রিনে প্রেসিডেন্টের খুনির ছবি দেখানো হচ্ছে। কঠোর চেহারার এক যুবকের ছবি, চুলের রঙ কালো, চোখের রঙ কালো, নাকটা অনেক খাড়া। আযহারের চেহারার সাথে প্রচুর অমিল লক্ষণীয়।

“...এই যুবকের কোন নাম পরিচয় জানা যায়নি। তবে জানা গেছে সে ছিল সরকারী কমান্ডো বাহিনীর সদস্য, তার কোড নেইম মাইডাস এক্স! গোপন খবরে আরও জানা যায় যে সাহসী যুবক সম্প্রতি লিবারেশন ফ্রন্ট নামে একটি বিদ্রোহী গ্রুপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে সে আর মাইডাস এক্স একই ব্যাক্তি। বিদ্রোহী গ্রুপের পক্ষ থেকে তাকে "দা রেবেল" উপাধি দেওয়া হয়েছে। সরকার ইতিমধ্যে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং এর সদস্যদের ধরার চেষ্টা করছে। । কিন্তু মাইডাস এক্স বা রেবেল এবং তার দলের লোকের বর্তমানে কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছে তা কারোই জানা নেই...”

টিভি স্ক্রিন থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো আযহার। কফির মগ ধরা হাতটা খানিকটা কাঁপছে। ছোট্ট করে একটা চুমুক দিল সে। সে নিজেই কি মাইডাস এক্স? নাকি সে মাইডাস এক্সের দলের কেউ? সে জানেনা সে কেন পালিয়ে এসেছে। তবে নিশ্চয়ই পালিয়ে আসার পেছনে শক্ত কোন কারণ আছে। হয়ত নতুন করে জীবন শুরু করা ছাড়া তার হাতে অন্য কোন উপায় ছিলনা! তবে এই নতুন জীবনে তার পক্ষে একা বাঁচা সম্ভব নয়, একজন পথ চলার সঙ্গীর খুব প্রয়োজন।

জুলি নামের মেয়েটির দিকে আর একবার তাকাল আযহার । মেয়েটি একবারের জন্যও আযহারের দিকে তাকাচ্ছে না। কিন্তু আযহার নিশ্চিত যে মেয়েটি তার চোখের দৃষ্টি ঠিকই অনুভব করতে পারছে। তবুও আযহার হাত নেড়ে মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। মেয়েটি তার দিকে তাকাল, মুখের হাসিটা আরও একটু প্রসারিত করে এগিয়ে আসল।

কাছে এসে বলল, "কিছু লাগবে স্যর?"
"একা কফি খেতে ভাল লাগছে না। তুমি কি আমার পাশে একটু বসবে? "
মেয়েটি হাসল, "কিন্তু আমার যে অনেক কাজ"।
"একটু বস, কিছুক্ষণ কথা বলি। আর এই মুহূর্তে তো খুব বেশি কাস্টমার নেই"।
মেয়েটি বসল, “কি কথা বলবেন?”
"আমি কি তোমাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?"
মেয়েটি মুখে হাসি ধরে রেখে বলল, "করতে পারেন কিন্তু জবাব দেব কি দেবনা সেটা কিন্তু আমার মর্জি"!
আযহার হাসল। “কেন তুমি সব সময় আমার প্রতি তোমার আগ্রহটুকু ঢেকে রাখার চেষ্টা কর?”
শব্দ করে হাসল জুলি, "কীভাবে বুঝলেন?”
“কীভাবে বুঝেছি জানিনা, তবে আমি বুঝতে পারি”।
“তাই? আর কি বুঝতে পারেন আমাকে দেখে?”
“তুমি খুব বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। তুমি সৎ এবং নির্ভীক”।

একমুহূর্ত থেমে থেকে আযহার বলল, “বাইরে তুমি সব সময় একটা সুখী মানুষের মুখোশ পড়ে থাক কিন্তু তোমার ভেতরের মানুষটা খুব বেশি একা”!
জুলির মুখের হাসি মুছে গেল। আযহারের মুখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। বলল, “আপনার এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”
“কারণ এই একই দৃশ্য আমি দেখতে পাই যখন আয়নায় নিজের দিকে তাকাই”।

জুলি মুখ তুলে তাকাল আযহারের দিকে, তার চোখে মুখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি। এই দৃষ্টি আগে দেখেনি আযহার। সে বলল, “দেখ, আমি ভণিতা করে কথা বলতে পারিনা। যা মনে হয় সরাসরি তা বলে দিতে ভাল লাগে। আমরা দুজনেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে অসম্পূর্ণ । আমরা হয়ত চাইলে একে অপরের অসম্পূর্ণতাটুকু ঢেকে দিতে পারব”।

আযহার হাত বাড়িয়ে জুলির একটা হাত ধরল। জুলি কোন কথা বলছে না। তবে তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি মেয়েটা কেঁদে ফেলবে। হঠাৎ কফি শপের দরজা খোলার আওয়াজ হল। আযহার তাকিয়ে দেখল দুজন নতুন কাস্টমার এসেছে।

“আ... আমার যেতে হবে”। বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল জুলি। মেয়েটির গমন পথের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আযহার। তার সমস্ত শরীরে এক আশ্চর্য সুখানুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে!


(আগামী খন্ডে সমাপ্য)

পরের পর্বের লিংকঃ দ্রোহের প্রতিশব্দ (শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:৫৬
২৫টি মন্তব্য ২৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×