somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্য পেইন্টার

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"এক"

প্রচণ্ড এক আর্ত-চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল হাসানের। ধড় মড় করে উঠে বসল। কি ঘটেছে বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল। আওয়াজটা পাশের রুম থেকে এসেছে। নিশ্চয়ই মারুফ চিৎকার করেছে!

ঝট করে বিছানা ছেড়ে উঠল হাসান। তার বন্ধু মারুফের এই সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। প্রায়ই রাতের বেলা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠে। কয়টা বাজে? বড়জোর ৬টা হবে। এত সকালে মারুফ কি দুঃস্বপ্ন দেখল?

দরজা খুলে পাশের রুমে উঁকি দিল হাসান। মারুফ তার বিছানায় বসে আছে। বুকের কাছে দুই হাঁটু ভাজ করে রাখা। তাকিয়ে আছে বেডের পাশে স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো ছবি আকার ক্যানভাসের দিকে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কিছু একটা দেখছে।

হাসান বসল মারুফের গা ঘেঁষে। “কি হয়েছে রে? চিৎকার করছিস কেন? খারাপ কোন স্বপ্ন দেখেছিস?”

মারুফ মুখে কিছু বলল না। আঙ্গুল তুলে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করল। হাসান সেদিকে তাকাল। ক্যানভাসে আটকানো মিডিয়াম সাইজের আর্ট পেপারে তুলির আচরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটা জীবন্ত ছবি। হাসানের তুলি যেন কথা বলে! এত চমৎকার ছবি আঁকার ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের থাকেনা! সে হয়ত বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভাল পেইন্টারদের মধ্যে একজন হতে পারত। কিন্তু বিশেষ কারণে নিজের ছবি আঁকার এই প্রতিভা লুকিয়ে রেখেছে সবার কাছ থেকে।

“ছ... ছবিটা ভাল করে দেখ”!
হাসান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখল। নদীর জলে একটা মেয়ে চিত হয়ে ভাসছে! মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষতচিহ্ন। বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা মৃত। “একটা মেয়ের লাশ ভাসছে নদীতে! এখানে আর দেখার কি আছে?”
“তুই দেখতে পাচ্ছিস না হাসান! ভাল করে দেখ!” মারুফের কণ্ঠে তাগাদা দেওয়ার সুর।
আরও ভাল করে ছবিটা বোঝার চেষ্টা করল হাসান। আচমকা ব্যাপারটা নজরে পড়ল তার! মুখটা ক্ষতবিক্ষত হলেও ঠিকই চেনা যাচ্ছে! নদীর জলে লাশ হয়ে ভাসতে থাকা মেয়েটি আর কেউ নয়! শেফালী! তার বাগদত্তা।
“এ তুই কি ছবি এঁকেছিস মারুফ? কেন এঁকেছিস?”
“আ... আমি জানিনা... আমি কিচ্ছু জানিনা..." মারুফের কণ্ঠে আতংক। "সম্ভবত গতকাল রাতে ব্ল্যাক আউট হয়েছিল। তখন এঁকেছি। এই মাত্র ঘুম ভেঙে চোখে পড়ল”।

হাসানের দৃষ্টিতেও আতংক ফুটে উঠেছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে শেফালীর মৃত ছবি আঁকা দেখে এত ভয় পাওয়ার কি আছে? কিন্তু আর কেউ না জানুক, অন্তত হাসান জানে- মারুফ ভবিষ্যৎ আঁকতে পারে! তার আঁকা প্রত্যেকটা কাল্পনিক ছবির ঘটনা ভবিষ্যতে সত্য হয়!

"দুই"

“Operant conditioning is a method of learning that occurs through rewards and punishments for behavior. এর মানে হচ্ছে কোন আচরণের বিপরীতে পুরষ্কার বা শাস্তি দেয়ার ফলে আমার যে শিক্ষা গ্রহণ করি তাই হচ্ছে অপারেন্ট কন্ডিশনিং। উদাহারন স্বরূপ বলা যায়- একটা বাচ্চা শিক্ষকের শাস্তি এড়াতে হোমওয়ার্ক করে, আবার একজন কর্মচারী প্রমোশনের আশায় সুন্দরভাবে কাজ করে...”

কথা শেষ করতে পারল না ঢাবির সাইকোলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. আশরাফ রবিন। এক ছাত্র হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে বসল, “স্যার, ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিংটা আরও একটু বুঝিয়ে দিলে ভাল হয়”।
মেজাজ খারাপ হল ড. রবিনের। তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করল। “এতক্ষণ যে জিজ্ঞেস করলাম সবাই বুঝেছ কিনা, তখন বলনি কেন?”
ছেলেটা আর কিছু বলছে না। পিছন দিক থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল, “স্যার, ও ফ্রুট নিনজা খেলছিল”।

ক্লাসভর্তি সবাই হো হো হেসে উঠল। রবিনও না হেসে পারল না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা বিরাট অসন্তুষ্টি কাজ করছে। এই যুগের ছেলে মেয়েরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান। এদের বোঝার ক্ষমতা তাদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ কিন্তু বোঝার আগ্রহ অর্ধেকেরও কম!
ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং এর আলোচনাটা আবার শুরু করতে যাবে এমন সময় মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠল। ডিপার্টমেন্ট এর চেয়ারম্যান বলে দিয়েছেন ক্লাসে শিক্ষকরা যেন মোবাইল সাইলেন্ট রাখে। কিন্তু রবিন প্রায়ই সেটা করতে ভুলে যায়।

পকেট থেকে বিরক্তচিত্তে মোবাইল বের করল সে। কলটা কেটে দিতে গিয়ে খেয়াল হল ফোন করেছে বন্ধু ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ইকবাল খান। নিশ্চয়ই নতুন কোন কেস! আশরাফ রবিনের চোখে মুখে এক ধরনের ঔজ্জ্বল্য ধরা পড়ল। ছাত্র পড়ানোর মত একঘেয়েমি থেকে হয়ত একটু মুক্তি মিলবে এবার!

“আমার জরুরী একটা ফোন এসেছে। সবাই বই দেখে পড়াটা বুঝার চেষ্টা কর, আমি কথা বলে আসছি...” বলেই ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো রবিন। পিছনে শুনতে পেল ইতিমধ্যে সব স্টুডেন্ট হই হুল্লোড় শুরু করেছে। হায়রে নেক্সট জেনারেশন, পড়াশোনায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই এদের!

রিসিভ করল সে, “হ্যালো, ইকবাল?”
“হ্যা, খুব বিজি সময় কাটছে নাকি রে?” ওপাশ থেকে প্রশ্ন করল ইকবাল।
“সেটা ডিপেন্ড করছে তুই কি ধরনের কাজের জন্য ফোন করেছিস তার উপরে। যদি আড্ডা দেয়ার উদ্দেশ্য থাকে তাহলে আমার হাতে একদম সময় নেই, কিন্তু যদি নতুন কোন কেসে হেল্প দরকার হয় তাহলে আই হ্যাভ অল দা টাইম অফ দা ওয়ার্ল্ড”।
“ঠিক কেস না। একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটেছে। একজন যুবক এসেছিল আমার কাছে, সে বলল তার বন্ধু নাকি ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে পারে”!
“ওয়াও! ইন্টারেস্টিং তো”! রবিনের কণ্ঠে আগ্রহ প্রকাশ পেল।
তবে ওপাশ থেকে ইকবাল খানের কণ্ঠস্বর অনেক বেশি নিরুৎসাহী! “আমার মনে হচ্ছে সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার স্যাপার। এই ধরনের একটা বিষয় শুধু মুখের কথার ওপর বিশ্বাস করে কেস হিসেবে নেয়া পসিবল না। মনে হচ্ছে পুরোটাই গাঁজাখুরি। তবে তোর যদি আগ্রহ থাকে তাহলে আমি ছেলেটাকে তোর নম্বর দিয়ে দিতে পারি। তুই বোঝার চেষ্টা কর ব্যাপারটা আসলে কি”!
“দিয়ে দে, এমনিতেই বোরিং সময় কাটছে। লাইফে একটু উত্তেজনা দরকার”।

"তিন"

“আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনার বন্ধু মারুফ ভবিষ্যৎ দেখতে পায়?” চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার ফাঁকে জিজ্ঞেস করল রবিন। হাসানের সাথে বসেছে ডিপার্টমেন্টের টিচার্স লাউঞ্জের এক কোনায়।
“ঠিক তা নয়। মারুফ আসলে ভবিষ্যৎ আঁকতে পারে” হাসানকে যখন ইন্সপেক্টর ইকবাল বলেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজির একজন শিক্ষকের সাথে দেখা করে কথা বলার জন্য, সে ভেবেছিল হয়ত বয়স্ক কেউ হবেন! কিন্তু রবিনকে দেখে সে যার পর নাই অবাক হয়েছে। কত আর বয়স হবে? ত্রিশ? বত্রিশ? এই বয়সে পি এইচ ডি শেষ করে, নামের পাশে ডক্টর বসিয়ে, একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর হয়ে গেছে!
“কি ধরনের ভবিষ্যৎ?” আবার প্রশ্ন করল রবিন।
“ধরেন সে একজন সুস্থ মানুষের মৃত অবস্থার ছবি এঁকেছে, তাহলে লোকটা দুদিন পর আসলেও মরে যাবে”!
“আরও একটু খোলাসা করে বলা যায়?” আরেকবার কাপে চুমুক দিল রবিন।
“মানে... গোঁড়া থেকে শুরু করব?” হাসানের হাতের কাপে চা ঠাণ্ডা হচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই।
“হুম, তাহলে তো ভালই হয়”!
“ঘটনার শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে...

মারুফকে বলা চলে চাইল্ড জিনিয়াস। ৪ বছর বয়সেই তার ছবি আঁকার প্রতিভার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কারো কাছে শেখেনি অথচ যে বয়সে বাচ্চারা কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং আঁকত, তখন মারুফ হুবহু মানুষের চেহারার স্কেচ আঁকতে পারত। আমরা প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামে বসবাস করতাম, তাই মারুফের এই প্রতিভার কথা খুব বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু আমরা তখনও জানতাম না মারুফের এই প্রতিভা আসলে অভিশপ্ত!

আমাদের বয়স যখন ৮ তখন সর্ব প্রথম এই অভিশাপের প্রমাণ মিলল। একবার কালবৈশাখী ঝড়ের সময় আমার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সবাই দল বেঁধে গ্রামের আমগাছ গুলোর নিচ থেকে আম কুড়িয়ে বস্তা বোঝাই করে ফেরার পথে জালাল দেখে ফেললো। জালাল আমাদের চেয়ে বয়সে দু তিন বছরের বড়, সে ছিল গ্রামের মেম্বারের ছেলে। বাবার ক্ষমতার জোরে সেও ক্ষমতা দেখিয়ে বেড়াত। আমাদের কাছ থেকে জালাল সবগুলো আম কেড়ে রাখল। সেদিন মারুফ অনেক কেঁদেছিল।

পরদিন স্কুলে মারুফ আমাকে একটা ছবি দেখাল। অংক খাতার পিছনের দিকে আঁকা। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা ছেলে বেকায়দা ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে আছে, বুঝা যাচ্ছে তার হাত পা ভাঙা। ছেলেটার মুখ দেখে বুঝলাম এটা জালাল। সেই ছবি সারা স্কুলময় ছড়িয়ে গেল। আমরা সবাই খুব হাসলাম। জালালের অপর বাচ্চারা প্রায়ই সবাই ক্ষেপে আছে, কিন্তু কারো পক্ষে তার টিকি ছোঁয়ার সাধ্য নেই। তাই সবাই মারুফের আঁকা ছবির মধ্যেই সান্ত্বনা খুঁজে পেলাম!

কিন্তু পর দিন একটা আমগাছের নিচে জালালকে হাতা পা ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। আমরা সবাই তাজ্জব বনে গেলাম! মারুফের আঁকা ছবিতে জালালকে যেভাবে দেখেছি ঠিক সেই ভাবেই সে পড়ে আছে। বাচ্চাদের মধ্যে একটা আতংক সৃষ্টি হল। সবাই ভাবল মারুফের মধ্যে অদ্ভুত কোন ক্ষমতা আছে, সে যা আঁকে তাই সত্যি হয়ে যায়। বাচ্চারা মারুফের সাথে মেশা বন্ধ করে দিল। মারুফের কাছের মানুষ বলতে কেবল একজন রইল। সে হল আমি।

এর পরের ঘটনাটাতো আরও ভয়াবহ! একদিন আমি আর মারুফ গ্রামের বাজারে গিয়েছিলাম। বাজারে নরহরি কাকার মিষ্টির দোকান ছিল। নরহরি কাকার দোকানের মিষ্টি ছিল আমাদেরর অঞ্চলে বিখ্যাত। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত মিষ্টি খাওয়ার জন্য। এমন অপূর্ব স্বাদ!

প্রায় সময়ই দুপুরবেলা দোকানে কাস্টমার থাকেনা। নরহরি কাকা এসময় চেয়ারে বসে ঝিমাতে থাকেন। গায়ের ছেলে মেয়েরা এই সুযোগে দোকানে ঢুকে গপাগপ গোটা দশেক মিষ্টি খেয়ে পালিয়ে যায়। সেদিন আমি আর মারুফ সুযোগটা কাজে লাগালাম। নিঃশব্দে দোকানে ঢুকে পড়ে চার পাঁচটা করে মিষ্টি পেটে চালান করে দিলাম। কিন্তু বিপত্তি ঘটাল মারুফ। তার হাত লেগে একটা মিষ্টির ডালা থেকে চামচ পড়ে গেল মাটিতে। শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল নরহরি কাকার। পালানোর সুযোগ পেলাম না আমরা, তিনি পাকড়াও করে ফেললেন দুজনকে। তারপর দোকানে বেঁধে রেখে আমাদের বাড়িতে খবর পাঠালেন।

বাড়িতে ফিরে দুজনেই বাবার হাতে বেদম পিটানি খেলাম। লজ্জায় বাইরে বে হওয়ার উপায় ছিলনা। গাঁ ভর্তি লোকজন সবাই দেখলেই চোর চোর বলে ক্ষ্যাপাত। ভীষণ রাগ হল নরহরি কাকার ওপর। ধরে যখন ফেলেছিলেন, দুই চারটা চড় থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দিলেই তো পারতেন। বেঁধে রেখে বাড়িতে খবর পাঠিয়ে সারা গ্রামের লোকজনকে জানানোর কি দরকার ছিল?

একদিন মারুফ আমাকে তার হাতে আঁকা একটা ছবি দেখাল। ছবিটা দেখে আমি তো বমিই করে ফেললাম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে নরহরি কাকার এক চোখের ওপর কাঁটা চামচ গাথা। চোখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে গাল ভেসে যাচ্ছে। মারুফ কে নিষেধ করে দিলাম আর কখনও যেন এমন ছবি এঁকে আমাকে না দেখায়। এদিকে মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছিল! আগের বার মারুফের আঁকা ছবিটি সত্য হয়েছিল। যদি এবারো হয়?

হলও তাই! একদিন পরই নরহরি কাকাকে ঐ অবস্থায় পাওয়া গেল। নরহরি কাকা অন্যান্য দিনের মত দুপুরবেলা দোকানে বসে ঝিমাচ্ছলেন, কে যেন সে সময় তার দোকানে ঢুকে পড়ে চোখে কাঁটা চামচ গেঁথে দিয়েছে! ওহ কি ভয়াবহ ব্যাপার! অবশ্য মারুফের দ্বিতীয়বার ছবি আঁকার এই বিষয়টা আমরা কাউকে জানালাম না, নিজেদের মধ্যে গোপন রাখলাম। এর পর এমন আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।

“বড় কারো সাথে এ বিষয়ে কখনও কথা বলেন নি?” কথা শুনতে শুনতে চা খাওয়া শেষ করেছে রবিন।
“না। আমরা দুজনে ভেবেছিলাম এটা হয়ত মারুফের এক ধরনের ক্ষমতা, সে ভবিষ্যৎ আঁকতে পারে। কিন্তু এরকম আরও কিছু ঘটনা ঘটার পর বুঝতে পারলাম আসলে ব্যাপারটা তা নয়। এটা ক্ষমতা নয়, এটা একটা অভিশাপ! মারুফ ভবিষ্যৎ আঁকতে পারেনা, মারুফ যা আঁকে তাই ভবিষ্যৎ হয়ে যায়”!
“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”
“কারণ মারুফ এখন পর্যন্ত কোন পজিটিভ ফিউচারের ছবি আকেনি” হঠাৎ খেয়াল হতেই হাতে ধরা চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিল মারুফ। মুখে বিস্বাদ লাগল, একদম ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। “হয় সে কোন দুর্ঘটনা, কারো মৃত্যু অথবা নৃশংস কোন ঘটনার ছবি আঁকে”।
“যখন বুঝতে পারল ব্যাপারটা আসলে অভিশাপ, তখন মারুফ কি করল?”
“মারুফ ছবি আঁকা ছেড়ে দিল” আরও একবার চুমুক দিতে গিয়েও দিলনা, কাঁপটা নামিয়ে রাখল হাসান। ঠাণ্ডা চা খাওয়া আর না খাওয়া একই কথা! “সে এখন শুধু মাঝে মধ্যে নিজের মনের আনন্দের জন্য ছবি আঁকে। কিন্তু ছবি গুলো কাউকে দেখায় না”।
“তাতে কি সমস্যা দূর হয়েছে?”
“না হয়নি। মাঝে মধ্যে অতি উত্তেজনায় মারুফের ব্ল্যাক আউট হয়। তখন সে অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। কলম, পেন্সিল, রং, তুলি, কাগজ- যাই হাতের কাছে পায় তাই নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করে! এবং এই ছবি গুলো ভবিষ্যতে সত্যি প্রমাণিত হয়! কিন্তু ব্ল্যাক আউটের পর্যায়টা পার করে এলে মারুফের আর কিছুই মনে থাকেনা। সে কখন এই ছবি এঁকেছে, কেন এঁকেছে- কিছুই বলতে পারেনা”!
“আপনারা এখন থাকেন কোথায়?”
“ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় দুজনের গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছিলাম। তারপর থেকে একসাথেই আছি দুজনে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি। এখন ঢাকার মহাখালীতে একটা দুই রুমের ফ্ল্যাট নিয়েছি। আমি একটা সরকারি চাকরী করছি, মারুফ তেমন কিছু করেনা, মাঝে মধ্যে ফ্রি ল্যান্সর হিসেবে টুকটাক ডিজাইনের কাজ করে করে”।
রবিন পকেট থেকে রুমাল বের করল, চশমার কাঁচ গুলো একটু পরিষ্কার করা প্রয়োজন। “একসাথেই তো আছেন! কিন্তু আপনি কি কখনও মারুফকে ব্ল্যাক আউট অবস্থায় ছবি আঁকতে দেখেছেন?”
“না, দেখিনি!”
“এখন পর্যন্ত মারুফের যত গুলো আঁকা ছবি পরবর্তীতে সত্য হয়েছে তার একটাও কি আঁকার সময় আপনি দেখেছেন?”
এক মুহূর্ত চিন্তা করল হাসান। তারপর বলল, “ঠিক মনে করতে পারছি না আসলে... মারুফকে অনেকবার ছবি আঁকতে দেখেছি... কিন্তু তার আঁকা যে ছবিগুলো ভবিষ্যতে সত্যি হয়, তার একটাও আঁকার সময় সম্ভবত দেখিনি”!
রবিন তার চশমার কাচগুলো রুমাল দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করার ফাকে বলল, “এখন বলুন, এতদিন পর কেন বিষয়টা মানুষের কানে তুলছেন? এতদিন তো ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলেন, আজ হঠাৎ পুলিশের শরণাপন্ন হওয়ার কারণ?”!
“কারণ?” এক মুহূর্ত সময় নিলো হাসান কারণটা বলতে। “কারণ আমি চাইনা মারুফ শেষ যে ছবিটি এঁকেছে তা সত্যি হোক”।
“কি আছে সেই ছবিতে?”
“আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। আপনি চাইলে দেখতে পারেন”। বলে ডান কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের চেইন খুলল হাসান। একটা আর্ট পেপার বের করে বাড়িয়ে ধরল রবিনের দিকে।

রবিন ছবিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠল! একটা মেয়ের ক্ষত বিক্ষত লাশের ছবি, পানিতে ভাসছে। এত্ত জীবন্ত ছবি, মনে হচ্ছে যেন প্রফেশনাল ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবিতে ইফেক্ট দেয়া হয়েছে! বলে না দিলে কেউ বিশ্বাস করবে না হাতে আঁকা! কি অসাধারণ এক প্রতিভা! এই ছেলের আঁকা ছবি যদি প্রচার পায় তাহলে নিঃসন্দেহে সে বিশ্বের সেরা চিত্রশিল্পীর আখ্যা পাবে! দেশের এই রকম একটা প্রতিভা লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে কেন?

হাসান বলে চলেছে, “ছবিতে যে মেয়ের লাশ দেখছেন তার নাম শেফালী। মেয়েটি আমার হবু স্ত্রী, ইডেন কলেজে পড়ে”।
“আপনার বন্ধু মারুফ নিশ্চয়ই মেয়েটিকে চেনে?” প্রশ্ন করল রবিন।
“হ্যা, মেয়েটি সম্পর্কে মারুফের কাজিন হয়”।
একমুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করল রবিন। তারপর প্রশ্ন করল, “এখন পর্যন্ত এমন কোন ঘটনা ঘটেছে কি যেখানে মারফ যে ছবি এঁকেছে তাই ঘটেছে, কিন্তু মারুফের আঁকা ছবি দেখে যেভাবে ঘটবে বলে মনে হয়েছে ঠিক সেভাবে ঘটেনি?”
“হ্যা, হয়েছে”।
“একটু উদাহারন দিতে পারবেন?”
একটু ভেবে নিয়ে বলল হাসান, “আমার একটা পোষা কুকুর ছিল, খুব আদরের। একদিন মারুফ ছবি আকল কুকুরটার লাশ গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় পানিতে ভাসছে। পরবর্তীতে গলায় দড়ি বাঁধা অবস্থায় কুকুরটির লাশ পাওয়া গেছে ঠিকই কিন্তু পানিতে নয়, পাওয়া গেছে পুকুর পাড়ে, একটা গাছের নিচে। এমন ঘটনা আরও দুই একবার ঘটেছে। কিন্তু আসল ব্যাপার হল সে যা আঁকবে তা সত্য হবেই। হুবহু মিলছে কিনা সে তো বড় বিষয় নয়”!
“বড় বিষয় নয় সত্যি, কিন্তু এক্কেবারে ফেলে দেওয়ার মত কথাও নয়”! বলল রবিন। “আপনার চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আর এক কাপ দিতে বলব?”
“না থাক। এমনিতেই চা খেতে ইচ্ছে করছে না আর”।
“আপনি তাহলে আজ আসুন মিস্টার হাসান” একটু পরেই একটা ক্লাস নিতে হবে রবিনের, হাতে সময় নেই। “পুরো বিষয়টা নিয়ে আমি আজ রাতে একবার বসব, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা লাগবে। আপনি বরং কাল ডিবি পুলিশের অফিসে আসুন , সেখানে ইন্সপেক্টর ইকবাল খানের সামনেই পুরো বিষয়টার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করব। আপনার বন্ধু মারুফের সাথেও একটু দেখা করা প্রয়োজন, তবে ওনার সাথে কথা বলার আগে একটু পরিস্থিতিটা বুঝে নেয়া যাক”!
“যা করার তাড়াতাড়ি করুন স্যার। কারণ দেরি হয়ে যাচ্ছে”!
“হ্যা, আমরা যা করার করব” আশ্বাস দিল রবিন। “এই সময়টা আপনি একটু আপনার হবু স্ত্রীর দিকে খেয়াল রাখুন।

"চার "

“তোর কথা গুলো আষাঢ়ে গল্পের মত শোনাচ্ছে রবিন” ইন্সপেক্টর ইকবাল খানের কণ্ঠে নির্ভেজাল বিস্ময়।

ইকবাল খান আর রবিন স্কুল বন্ধু। দুজনে পড়েছেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন বিসিএস পরীক্ষায় ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করে হয়েছিল সাব ইন্সপেক্টর। পরবর্তীতে ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার কারনে প্রোমোশন পেয়ে চলে এসেছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে। অন্যজন কানাডা থেকে পিএইচডি করে এসে হয়েছে নিজের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। তবে দুজনের মধ্যে একটা বিষয়ে প্রচুর মিল লক্ষ করা যায়! দুজনেরই সবচেয়ে পছন্দের কাজ হচ্ছে ক্রাইম সলভ করা।

“আমি ঠিকই বলছি” রবিনের বলার ধরনে কোন হেঁয়ালি নেই। অর্থাৎ যা বলছে তা বিশ্বাস করে। “মারুফের আঁকা ছবিগুলো ভবিষ্যতে সত্য প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি আসলে কোন অলৌকিক ঘটনা নয়। মারুফ নিজেই এর জন্য দায়ী”।
“এখানে মারুফ কীভাবে দায়ী হয়?” ইকবাল খানের বিস্ময় কাটছে না। দুজনে বসে আছে ইকবাল খানের অফিসে। হাসানেরও আসার কথা ছিল কিন্তু এখনও এসে পৌঁছায়নি। “একটু ঝেড়ে কাশ না প্লিজ”!
“সব বুঝিয়ে বলছি, তার আগে বলি কীভাবে বুঝলাম ব্যাপারটা যে অলৌকিক নয়”!
ইকবাল খান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
রবিন বলছে, “মারুফ যে ঘটনার দৃশ্য আঁকে তা সব সময় হুবহু মিলে যায় না। হাসানের মুখ থেকেই শুনেছি বেশ কয়েকবার এর ব্যতিক্রম হয়েছে। এটা যদি কোন অলৌকিক ক্ষমতা হত তাহলে প্রত্যেকবার হুবহু মিলে যাওয়ার কথা! ব্যতিক্রম যেহেতু হচ্ছে তাহলে ব্যাপারটিকে আর অলৌকিক ক্যাটাগরিতে ফেলা যাচ্ছেনা। দুই একটা ঘটনা সত্য হলে ব্যাপারটিকে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেয়া যেত। কিন্তু মারুফ যা আঁকে তা প্রত্যেকবারই ঘটে। হুবহু না হোক, ছবির ঘটনা সত্যি হয়। তারমানে কি দাঁড়াচ্ছে? পুরো ব্যাপারটা আসলে প্রি-প্ল্যানড”।
“তুই বলতে চাচ্ছিস মারুফ প্রথমে ছবি আঁকে তারপর সেই ছবির ঘটনা সত্যি করার জন্য কাউকে পাঠায়?” ইকবাল খানের প্রশ্ন।
“কাউকে পাঠায় না। সে নিজেই কাজগুলো করে”।
“তুই কীভাবে এতটা শিওর হচ্ছিস?”
“এখন পর্যন্ত হাসান মারুফকে কখনও ছবি আঁকতে দেখেনি। এমনকি ছবির ঘটনা সত্য হওয়ার সময়টাতেই সে কখনও উপস্থিত থাকেনা। অর্থাৎ মারুফ একটি ছবি আঁকে, সেটা হাসানকে দেখায়, তারপর হাসানের অলক্ষ্যে গিয়ে কাজটি করে আসে”।
“কিন্তু এতে লাভ কি বল?”
“আমার মনে হয় মারফ কোন লাভ লোকসানের হিসেব করেনা। অদ্ভুত কোন মানসিক রোগ আছে তার। কিছু মানুষের সামনে নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে দেখিয়ে তৃপ্তি পাচ্ছে সে”।
“তাহলে শেষ ছবিটার ব্যাখ্যা কি ?” ইকবাল খান রবিনের থিওরিটা পুরোপুরি মেনে নিতে পারছে না। “মারুফ নিশ্চয়ই তার বন্ধুর হবু স্ত্রীকে পাশবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলতে চাইবে না! তার উপর মেয়েটি সম্পর্কে মারুফের কাজিন হয়”!
রবিন হাসল, বলল, “বন্ধু আমরা এখানে সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে ভুগছে এমন পেসেন্টের কথা বলছি। এরা কখনও কাজের ফলাফল নিয়ে চিন্তিত নয়! তুই আমি যেমন যেকোনো বিষয় নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারি ওরা সেটা করেনা। হয়ত মারুফ কোন ডুয়েল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছে। সচেতন মন যে ছবি আঁকে, অবচেতন মনে সে কাজটি করে আসে। কিন্তু সচেতন মনে সেই খবর পৌঁছায় না! এখন মারুফের সাথে কথা বলতেই আমি নিশ্চিত হতে পারব তার সমস্যা কি!”

আরও কিছু হয়ত বলত রবিন কিন্তু হঠাৎ ইকবাল খানের ফোন বেজে ওঠায় কথার রেশ টানতে হল তাকে। ফোন করেছে হাসান। ইকবাল রিসিভ করল, হ্যা”লো! ডিবি ইন্সপেক্টর ইকবাল বলছি”।
“স্যার, আমি হাসান বলছি” হাসানের কণ্ঠে প্রচণ্ড অস্থিরতা টের পাচ্ছে ইকবাল।
“হ্যা, মিস্টার হাসান। আপনার না আজ আসার কথা ছিল?”
“স্যার, আমি আসছিলাম। পথে খবর পেলাম আমার বাগদত্তা স্ত্রী শেফালী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে”।
“বলেন কি?” আঁতকে উঠল ইকবাল।
“জি স্যার। হাসপাতালে এসে জানতে পারলাম মারুফ শেফালীকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির নিচে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। পুলিশ মারুফকে গ্রেফতার করেছে”।

ফোন কেটে দিয়ে কয়েক মুহূর্ত হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল ইকবাল। তারপর রবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বন্ধু, তোর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে...”

"পাঁচ"

অন্ধকার একটা কক্ষ। জানালা বা ভেন্টিলেটর নেই যে একটু আলো চুইয়ে এসে ভেতরে ঢুকবে। এক মাত্র দরজাটিও বন্ধ। কক্ষের ভেতর আসবাব বলতে একটি ছোট টেবিল ও চেয়ার। চেয়ারের ওপরে বসিয়ে রাখা হয়েছে একজন আসামীকে। তার দু হাত চেয়ারের সাথে হ্যান্ড কাফ দিয়ে আটকানো। সামনে ছোট্ট একটি সাদার রঙের টেবিল। মাথার একটু ওপরে ১০০ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। বাল্বের চারদিকে প্লাস্টিকের শেড লাগানো থাকায় আসামির মুখের কাছে অংশটুকু আলোকিত হয়ে থাকলেও সমস্ত ঘর অন্ধকার। তাছাড়া সিলিং ফ্যান না থাকায় কক্ষের ভেতর এক ধরনের ভ্যাঁপসা গরম অনুভূত হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড রকমের অস্বস্তিকর এক পরিবেশ।

মারুফ ভেবেছিল এমন ইন্টারগেশন কক্ষের অস্তিত্ব শুধু নাটক সিনেমাতেই দেখা যায়। বাস্তবে এমনটা হওয়া সম্ভব নয়, অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তো অবশ্যই নয়। কিন্তু আজ তার ধারনাটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসামির চেয়ারে বসে আছে সে নিজেই। ইন্টারোগেশন করছে ইন্সপেক্টর ইকবাল খান।

চোখের সামনে সারাক্ষণ আলো ধরে রাখার ফলে মারুফের চোখে জ্বালা ধরে গেছে। সামনে টেবিলটা ছাড়া রুমের এতরে আর কিছুই নজরে আসছে না তার। ফলে ইন্সপেক্টর ইকবাল খানের প্রশ্নগুলো মনে হচ্ছে যেন অদৃশ্য কেউ করছে!

“মারুফ, যা বলছি তার জবাব দিন” ইন্সপেক্টর ইকবাল খানের কণ্ঠ। “বলুন কেন কাজটি করেছেন?”
“আমি অনেকবারই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করেন নি” থমথমে গলায় বলল মারুফ।
“আমরা সত্যিটা জানতে চাচ্ছি”।
“যা বলছি এটাই সত্যি। আমি চেয়েছিলাম শেফালীর মৃত্যুটা সহজ হোক। অনেক কঠিন মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে তার জন্য”।
“আপনার কেন এমন মনে হচ্ছে?”
“কারণ আমি তার ক্ষত বিক্ষত লাশের ছবি এঁকেছি। কেউ একজন তাকে প্রচণ্ড নির্যাতন করে মেরে লাশটা পানিতে ফেলে দিয়েছে। আমার আঁকা ছবি কখনও ভুল হয়না। আজ পর্যন্ত হয়নি, ভবিষ্যতেও হবেনা”।
“কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে ভেতরে অন্য কোন ব্যাপার আছে”! কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলল ইকবাল খান। “এমন কি হতে পারেনা যে আপনি যার অনিষ্ট কামনা করেন, তাকে নিয়ে আজগুবি সব ছবি আঁকেন, তারপর সেই ছবির ঘটনাকে বাস্তবে রূপ দিতে জঘন্য সব কাজ করে বেড়ান”!
“কি বুঝাতে চাচ্ছেন আপনি?”
“আপনি যেখানে শেফালীকে গাড়ির নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। সেখান থেকে খুব কাছেই একটা জলাশয় আছে। দুর্ঘটনার পর শেফালীকে নিয়ে পানিতে ফেলে দিলে আপনার ছবির ঘটনা কিন্তু সত্যি হয়ে যেত”!
“কক্ষনো না”! দৃঢ় কণ্ঠে বলল মারুফ। “আমি শেফালীর সাথে এমন কাজ করতেই পারিনা”।
“কেন পারেন না?”
“কারণ... কারণ...” কিছুক্ষণ আমরা আমতা করে চুপ হয়ে গেল মারুফ।
“কারণটা আমি বলছি মিস্টার মারুফ”! নাটুকে ভঙ্গিতে এক মুহূর্ত থেমে থাকল ইকবাল খান। তারপর বলল, “কারণ আপনি আপনার খালাত বোন শেফালীকে পছন্দ করতেন। আপনার বন্ধু হাসানের সাথে তার বিয়ের বিষয়টি আপনি মেনে নিতে পারেন নি। এদিকে হাসান বিশ্বাস করে আপনি ভবিষ্যৎ আঁকতে পারেন। সেই সুযোগই আপনি নিতে চেয়েছিলেন”।
“আমি যদি শেফালীকে পছন্দ করি তাহলে তাকে মারতে চাইব কেন?”
“ভালবাসা শুধু গড়তে জানেনা মারুফ! ধ্বংস করতেও জানে”!
“আপনারা মারাত্মক ভুল করছেন ডিটেকটিভ...”
“আমরা ভুল করছি কিনা সে হিসাব করার জন্য আপনাকে এখানে আনা হয়নি” বলল ইকবাল খান। “আমি শুধু জানতে চাই আপনি শেফালীকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির নিচে ফেলে মারতে চেয়েছিলেন কিনা”!
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। মারুফ সংক্ষেপে বলল, “হ্যা”।
“ব্যাস। আর কিছু জানার নেই আমার” বলল ইকবাল খান। “আপনাকে দেখে আমার লজ্জা হচ্ছে মিস্টার মারুফ! ছবি আঁকার কি অসাধারণ প্রতিভা আপনার মাঝে। সেটা এভাবে অপব্যবহার করে চলেছেন?”
“আপনারা ভুল করছেন”! হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল মারুফ। “ছবিগুলো আমি সচেতন ভাবে আঁকি না। মাঝে মধ্যে আমার ব্ল্যাক আউট হয়, তখন কি ছবি আঁকি তা পরবর্তীতে মনে থাকেনা...”
মারুফের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে না ইকবাল খান। দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে তখন পিছন থেকে মারুফ প্রায় চিৎকার করে বলল, “শেফালীকে বাঁচান প্লিজ! অনেক বড় বিপদ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য”।
“শেফালী এখন বিপদমুক্ত, কারণ আপনি আটক আছেন আমাদের হাতে” বলেই বেরিয়ে এলো ইকবাল।

ইন্টারোগেশন রুমের ঠিক বাইরেই অপেক্ষা করছিল রবিন। ইন্টারকমে ভেতরের সব কথপকথন শুনেছে সে। ইকবাল বেরিয়ে আসতেই বলল, “কি সিদ্ধান্ত নিলি?”
“এটেম্পট টু মার্ডারের কেস করে দিব” ইকবাল খানের চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে আছে। “রিপোর্টে ঠাণ্ডা মাথার একজন সাইকো হিসেবে দেখাব মারুফ মুক্তাদির কে”।
“কিন্তু সত্যি যদি সে অবচেতন মনে কাজগুলো করে থাকে? সত্যি যদি তার মধ্যে কোন ডুয়েল পারসোনালিটি সংক্রান্ত সমস্যা থেকে থাকে? তাহলে তো তার যায়গা জেলখানা নয়, মানসিক হাসপাতাল”!
“তুই কি হলিউডের ফিল্মের জগতে বসবাস করিস?” ইকবাল খানকে দেখে মনে হল রেগে যাচ্ছে! “এইটা বাংলাদেশ। এইসব ডুয়েল পারসোনালিটির মামলা এখানে শুধু গল্পেই সম্ভব। একজন বিকৃত চিন্তা ভাবনার আসামীর মানসিক চিকিৎসা করাটা আমাদের জন্য বিলাসিতা! মারুফের অপরাধের বিচার প্রচলিত নিয়মেই হবে, কোন স্পেশাল কন্সেনট্রেশন দেয়া যাবেনা। কেস ক্লোজড!”

(আগামী পর্বে সমাপ্য)
১৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×