এক.
বেলা দশটা৷ স্কুলটা সবে মাত্র ছুটি হয়েছে৷ বর্ষার কয়েক পলসা বৃষ্টি ইতিমধ্যে রাস্তাটা ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরাও ব্যাঙের সাথে তাল মিলিয়ে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে। অনেকে আবার মায়ের বকুনির ভয়ে মনের তীব্র বাসনা হৃদয়েই দাফন করছে৷
অসংখ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরো ব্যতিক্রম ধর্মী একজন হলো জারিন৷ সবে মাত্র চতুর্থ শ্রেণিতে পা দিয়েছে৷ কিন্তু অন্তর্মুখী হওয়ার দরুন মস্তিষ্কটা বহু আগেই পরিণত রূপ লাভ করেছে। কোনো কাজ করবার পূর্বে অন্তত কয়েকবার নিজের কল্পনায় সেটা সাজিয়ে নেয় ও৷ বিপদাপদ আচ করতে পারলে সেদিকে আর ঘুণাক্ষরেও ফিরে তাকায় না৷ ঘটে বুদ্ধির সবটুকুই আছে বলা যায়৷
অল্প কয়েকদিন হলো শহরতলীতে নতুন এসেছে ওরা। বড়জোর সপ্তাহ দুই হবে৷ এই বয়সে দু' সপ্তাহ কয়েক ডজন বন্ধু বানানোর জন্য যথেষ্ট সময়৷ কিন্তু ঐযে জাতের দোষ! নিজের অন্তর্মুখিতা বন্ধু বানাতে দেয়নি৷ পারলে ও ক্লাসে একা বসতে পারলেই খুশি৷ কিন্তু নিয়মকানুন এসবে বাধ সাধে৷
বৃষ্টির মধ্যে আনমনে বসে আছে জারিন৷ ওর মা এখনও আসেনি৷ আসলেই বেরুতে পারবে৷ চিন্তার মরুতে জারিন যখন বহুদূর তখনই সায়মা তার ব্যাঘাত ঘটিয়ে ডাক দিয়ে বলল,“তাড়াতাড়ি ওঠো৷ বাসায় যেতে হবে।”
সায়মা জারিনের একমাত্র বান্ধবী৷ ঠিক বান্ধবীও বলা যায় না৷ সহপাঠীই বলা যুক্তিযুক্ত। একই বেঞ্চে বসার কারণে দু'জনের মাঝে কথাবার্তা হয়৷ তবে সেটা এতদিন পর্যন্ত ক্লাস সংক্রান্ত বিষয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। এখনও জারিন নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কোনো কিছু ওর সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো মনখোলা হয়নি৷ অন্তর্মুখী মানুষদের যেমন সময় লাগে আরকি৷
সায়মার ডাকে ভ্যাবাচেকা খেয়ে সামলে নিয়ে জারিন বলল, “তোমার বাসায় তুমি যাবে৷ আমায় ডাকছ কেন?”
উত্তরটা সায়মাকে দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে ওর মা বলল, “তোমার আম্মু একটা কাজে আটকে গেছে৷ এজন্য তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে৷ আমাদের বাসা থেকে তোমার আম্মু এসে নিয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর৷”
“আমি কীভাবে বুঝব যে, আপনি আমাকে কিডন্যাপ করে অন্য কোথাও বিক্রি করে দিবেন না?” জারিন অপ্রস্তুত প্রশ্ন করে বসল।
“আরে বোকা! কিডন্যাপ কি কেউ এভাবে বলে-কয়ে করে নাকি?” হাসতে হাসতে উত্তর দিল সায়মার মা।
“ওহ হ্যাঁ, তাই তো৷ আগে থেকে বললে তো কিডন্যাপ হয় না৷” কথা শেষ না করে জিভে কামড় দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল, “তারমানে আপনি কিডন্যাপ করেন?”
দমফাটা হাসি শেষ করে সে বলল, “আমি বাচ্চাদের কিডন্যাপ করে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে আসি। তোমাকেও নিয়ে আসব। ভালো হবে না?”
সায়মা তার মা ও জারিনের কথা চালাচালি একেবারেই না নিতে পেরে বলে ওঠলো, “আম্মু চল তো৷ ও থাক এখানেই৷ ছেলেধরারা এসে নিয়ে যাবে৷ তখন ভালো হবে৷”
ছেলেধরারা মেয়ে কেন নেবে? এই প্রশ্নই করতে যাচ্ছিল জারিন৷ অবস্থা বেগতিক দেখে সায়মার মা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও, তোমার আম্মুর সাথে কথা বলো৷ এরপর চলো৷”
দুই.
ভেজা জামা-কাপড় নিয়ে বাসায় পৌঁছাল তারা৷ জারিনের ঠাণ্ডার প্রচণ্ড সমস্যা আছে৷ মায়ের বকুনি দূরে থাক৷ নিজের শরীরের কথা ভেবেই দ্রুত গামছা চেয়ে চুলগুলো মুছে নিল। কাপড়টাও পালটে নেয়া দরকার৷ আপাতত অন্যের বাসায় এই ভেজাল মাথায় নিতে চাচ্ছে না ও৷ তাই ঠাণ্ডার মধ্যেই ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়ল।
গোছল সেড়ে রুমে ঢুকলো সায়মা। গায়ে ছোটছোট টেডি বেয়ার আঁকা লাল রঙের একটা জামা৷ ডান হাতে একটা টেডি বেয়ারের পোষাক৷ জামায় কয়েকটা হলদেটে টেডি বেয়ারের মাঝে ছোপ ছোপ লাল দাগ৷ ভালোভাবে পরোখ করলে বোঝা যায় জামাটা আদি কালের। অন্তত বাসায় কোনো নতুন মানুষ আসলে এত পুরাতন জামা কেউ পরে না৷
জারিন সেদিকে লক্ষ্য না করে সায়মার হাতে থাকা টেডি বেয়ারের দিকে লক্ষ্য করল। সুতার কাপড় ও তুলার টেডি বেয়ার বিশ্ব জোড়া খ্যাতি লাভ করলেও সায়মার হাতে অন্যকিছু৷ মনে হচ্ছে টেডি বেয়ারের রেইনকোট৷ কিন্তু সায়মার যদি একটা রেইনকোট থাকেই তাহলে সে এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আসতে যাবে কেন?! প্রশ্নটা জারিনের মনে উঁকি দিতেই সায়মা ডেকে বলল, “চলো, আমরা এখন পুতুল দিয়ে খেলি৷ আমার অনেকগুলো পুতুল আছে৷ খেলা শেষে তোমার যেটা পছন্দ সেটা নিয়ে যেও৷”
“না, আমি তোমারটা নিব কেন?” সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করল জারিন৷
“আমার বাবার পুতুলের দোকান আছে৷ আমার অনেকগুলো পুতুল৷ তাই তোমাকে দিয়ে দিব একটা। তোমার যেটা পছন্দ সেটা আরকি৷”
জারিন মনে মনে খুশিই হলো ওর কথা শুনে৷ সায়মা ওকে নিয়ে ওর শোবার ঘরে নিয়ে৷ রুমটা বিভিন্ন সাইজের অসংখ্য টেডি বেয়ারে ঠাসা৷ বেশিরভাগ পুতুলই কেমন যেন অদ্ভুতভাবে ডিজাইন করা৷ দেখে মনে হচ্ছে, হাতে করা নিজস্ব কাজ। দেখতে ভালো না লাগলেও যত্নের ছাপ বেশ ভালোই পরিস্ফুটিত হচ্ছে৷ তাই ভদ্রতার খাতিরে জারিন আর এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
জারিনকে বসতে দিয়ে সায়মা বলল, “তুমি একটু বসো৷ আমি এক্ষুণি আসছি৷” এই বলে সায়মা রুম থেকে বের হওয়ার সময় দরজাটা জোরে শব্দ করে টান দিল৷ দরজার পাশে থাকা বড় সাইজের একটা বিশাল পুতুল জারিনের গায়ের ওপর এসে পড়ল৷ জারিনের এতক্ষণে বুঝতে পারছে ওর শক্তি দিয়ে পুতুলটা সরানো যাচ্ছে না। বরং পুতুলটা ক্রমশ ওকে চেপে ধরছে৷ চিৎকার করে ডাকতে চাইছে সায়মাকে৷ কিন্তু এতক্ষণে দেরি হয়ে গেছে৷ বিছানায় থাকা আরও গোটা বিশেক পুতুলের মাঝে প্রতিনিয়ত নিজেকে ও হারিয়ে ফেলছে।
বেঁচে থাকার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করল জারিন৷ বিছানা হাতড়াতে একটা কাপড়ের টুকরো পেল হাতে৷ কাপড়টা ওদের স্কুলের ইউনিফর্ম৷ নেমপ্লেটের নাম আর ক্রমিক নম্বরটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে জারিন৷ ক্রমিক নম্বর বাইশ৷ নাম লামিয়া৷ জারিন জানে গত তিন সপ্তাহ আগে লামিয়া নামের একটা মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। লামিয়ার ক্রমিক নম্বরটাও বাইশ৷ আর ওরটা লামিয়ার পরেই তেইশ নম্বরে৷ জারিন যতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা টের পেল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ ক্রমিক নম্বর হিসেবে সায়মার জায়গা একুশে৷ সায়মার পাশের জনকেই চরম পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে৷
…
দুই মিনিট পর দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো সায়মা। জারিনকে রুমে না পেয়ে শূন্যে কথা ছুড়লো, “ধুর, আমার সাথে কেউ খেলতেই চায় না!”
সায়মার কথা শুনে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকৃতির টেডি বেয়ারটা নিজের মুখে উত্তর থেকে দক্ষিণে একটা হাসির রেখা টানল৷
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:১৭