somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৈশ্বিক আর্থিক সংকট এবং বাংলাদশে

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নত বিশ্বে সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট (যার রেশ এখনও চলছে এবং চলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন) বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে একটি বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়েছে যার প্রভাব উন্নত ও উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির ওপর পড়তে শুরু করেছে । সম্প্রতি এক খবরে প্রকাশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাব মতে বর্তমানে আর্থিক সম্পদের ক্রমাগত দর পতনের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হতে পারে প্রায় ৫০,০০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । আর্থিক সংকট থেকে বিশ্বকে উদ্ধারের পরিকল্পনা তৈরির জন্য এপ্রিল ২,২০০৯ তারিখে লণ্ডনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জি-২০ দেশসমূহের শীর্ষ সম্মেলন । এ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ বিশ্ব অর্থনীতিতে আস্থা, গতি ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মাধ্যমে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। এছাড়া, বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ।

আর্থিক সংকট থেকে শুরু হতে পারে অর্থনৈতিক মন্দা, যদিও তা অবশ্যম্ভাবী নয়। যেমন , ১৯২৯-এ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোতে যে মহা অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছিল তার আগে ব্যাংকিং খাতে সংকট দেখা গিয়েছিল । তবে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন এর উল্টোটাই ঠিক অর্থাৎ অর্থনৈতিক মন্দাবস্থাই আর্থিক সংকটের কারণ। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ বোর্ড মেম্বার লরেনজো বিনি স্মাঘির (২০০৮) মতে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের জন্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক বাজারকে দায়ী করলে চলবে না, কারণ এ বাজারে বিনিয়োগকারী হিশেবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোও ছিল। তার মতে বিগত কয়েক বছর যাবৎ বিশ্বে চলমান অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতাই ছিল আর্থিক সংকট শুরু হওয়ার পূর্বলক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল নিম্ন সঞ্চয় , ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা, অতিমাত্রায় ঝুঁকি গ্রহণ, অতি স্ফীত আর্থিক বাজার, গৃহায়ন খাতে ও পুঁজি বাজারে সৃষ্ট বুদবুদ যা একসময় ভেংগে পড়ে। সাধারণভাবে, বাজারে মাত্রাতিরিক্ত ঋণপ্রবাহ এবং অর্থিক সম্পদের মূল্য এর অন্তর্নিহিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত ফুলে ফেঁপে ওঠার কারণেই আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয়। দীর্ঘ সময়ের জন্য শিথিল আর্থিক নীতি এবং অধিক তারল্য এ অবস্থাকে উৎসাহিত করেছে বলে অনেকে মনে করেন, যদিও আর্থিক সংকট পূর্বানুমান করা কঠিন ।
আর্থিক সংকট বলতে আমরা কি বুঝি ? সাম্প্রতিক বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের (২০০৭-০৯) চিত্রটা কী ছিল ? কী কারণে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট শুরু হয় ? এ থেকে বিশ্ব কী শিক্ষা নিতে পারে ? বাংলাদেশের জন্য এর তাৎপর্য কী ? এ প্রশ্নগুলো অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে । বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে কী ভাবছেন আজকের লেখায় এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
আর্থিক সংকট বা আর্থিক বিপর্যয় শব্দটি খুব সুনির্দিষ্ট অর্থের পরিবর্তে অনেকটা শিথীলভাবে ব্যবহৃত হয় । যেমন : ব্যাংকিং সংকট, ঋণ সংকট, পুঁজি বাজারে ধস, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে সংকট, কোন দেশের সরকার কর্তৃক বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা প্রভৃতিকে বুঝায় । এ সংকটগুলো আলাদাভাবে হতে পারে আবার পর্যায়ক্রমে বা পাশাপাশিও হতে পারে । উদাহরণস্বরূপঃ ১৯৮০ সনে ল্যাটিন আমেরিকার দেশসম–হে সৃষ্ট ঋণ সংকট, ১৯৯২-৯৩ সনে ইউরোপিয়ান এক্সচেঞ্জ রেট মেকানিজম ওপর আক্রমন থেকে সৃষ্ট সংকট, ১৯৯৭-৯৮ সনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর্থিক বিপর্যয় যা শুরু হয় , ১৯৯৮ সনে রাশিয়ার সরকারের ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতা ও রাশিয়ার মুদ্রা রুবল এর দাম পড়ে যাওয়া প্রভৃতি ।
আর্থিক সংকটের চিত্র
বিশ্ব আর্থিক সংকট অনভূত হতে শুরু হয় মোটামুটি ২০০৭ সনের জুলাই হতে । পূর্ববর্তী বছরসমুহে যুক্তরাষ্ট্রে অনুসৃত শিথীল মুদ্রা নীতি ও ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ব্যয় সহায়তা করে সম্পদ ও পণ্যের মূল্য ফুলে ফেপে উঠতে । একদিকে নিম্নতর সুদের হার এবং অপরদিকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী আবাসন খাতের ম–ল্য বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত আবাসন খাতে ফটকা কারবারে । ব্যংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও স্বল্প মেয়াদি লাভের আশায় এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয় । ফলে অতি আশাবাদ থেকে আবাসন খাতে সৃষ্টি হয় বুদবুদ । ২০০৭ এর মাঝামাঝি থেকে বিনিয়োগকারীগণ পূর্বের তুলনায় উচ্চতর সুদের হার ও ক্রমবধিষ্ণু আবাসন মূল্যের অনিশ্চয়তা থেকে অনুভব করতে শুরু করে যে যুক্তরাষ্ট্রের সাব-প্রাইম মর্টগেজ (অর্থাৎ নিম্নমানের বন্ধকী ঋণ) সংশ্লিষ্ট সিকিউরিটিসমূহ বিশেষত বন্ধকী সম্পদ আবৃত সিকিউরিটিসমূহ অতিমূল্যায়িত। বাজারে বন্ধকী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা ও সম্পত্তি অধিগ্রহণের খবর শোনা যায় । ফলে বাজার এ ধরনের সিকিউরিটির জন্য বেশি প্রিমিয়াম দাবী করল এবং সাধারণভাবে ঋণ ঝুঁকির বিশ্লেষণ বা ক্রেডিট ¯স্প্রেড বেড়ে গেল । সাধারণভাবে, ক্রেডিট ইনস্ট্রূমেন্টসমূহের বাজার মূল্য পড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকিং খাতে লাভের অংক ও নেট ওয়ার্থ কমে যেত শুর করল । ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতে সৃষ্ট বুদবুদ মিলিয়ে যেতে শুরু করে যা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য খাতে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের জামানতকৃত বন্ধকী ঋণ এর ওপর বাজারের আস্থা কমে যেতে শুরু করে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত দেশের আর্থিক বাজারে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে অর্থাৎ তারল্য সংকট দেখা দেয়।
তারল্য সংকটে পড়ে যুক্তরাজ্যের মাঝারি আকারের ব্যাংক নর্দান রক ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ডের কাছে নিরাপদ আশ্রয় চায়। শুরু হয় ব্যাংক দৌড় (bank run) বিশ্ব আর্থিক বাজার হয়ে পড়ে অস্থির । মার্চ ২০০৮ এ পতন হয় বন্ধকী ঋণ জামানতীকরণের ব্যবসার সাথে জড়িত যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইবধৎ ঝঃবধৎহং এর। একই মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অধিগ্রহণ করে সে দেশের বন্ধকী ঋণ সরবরাহকারী সবচেয়ে বড় দুটি আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান। সেপ্টেম্বর ২০০৮ Lehman Brothers এর দেউলিয়া হওয়ার ফলে আর্থিক বাজারের সংকট আরও ঘনীভূত হতে শুরু করে ব্যাপক আকারে । শুরু হয় আস্থার সংকট এবং ফলে তারল্য সংকট । যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়ের খবর আসতে শুরু করে । Lehman Brothers এর দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ইনসিওরেন্স কোম্পানি এআইজি ও সেভিংস এন্ড লোন ইনস্টিটিউট সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয় আর্থিক দুরবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য। সাব-প্রাইম মর্টগেজ সংশ্লিষ্ট সিকিউরিটিতে এদের বিনিয়োগ ছিল ।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে আর্থিক দুরবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য শোনা যেতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের সরকারের নানারকম উদ্ধার পরিকল্পনা । যুক্তরাষ্ট্র সরকার গ্রহণ করে ব্যাপক উদ্ধার পরিকল্পনা যার ওতায় মন্দ ঋণের বোঝা কমানোর জন্য এবং বাজারে তারল্য সরবরাহ করার জন্য ৭০০ বিলিয়ন ডলারের তহবিল সৃষ্টির ঘোষণা দেওয়া হয় । যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক খুব দ্রুত সুদের হার কমাতে শুরু করে । ২০০৭ এর মাঝামাঝিতে ফেড রেট ৫.২৫% হতে কমিয়ে ২০০৮ এর শেষে প্রায় শুন্যতে নামিয়ে আনা হয়। বিনিয়োগকারীগণ নিরাপদ বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ৩ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের হার কমে এসে দাঁড়ায় প্রায় শুন্য হারে। বিশ্ব বাজারে তারল্য সংকট দূর করতে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৮ এর ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক, ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক, ব্যাংক অব জাপান এবং সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক একটি সমন্বিত কর্মস–চী ঘোষণা করে । এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি এণ্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন মাত্রাতিরিক্ত ফটকাম–লক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য সিকিউরিটি আগাম বিক্রয় (short selling) নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।
সেপ্টেম্বর ২০০৮ হতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাতের সংকট বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়ে এবং কিছু ব্যাংক সেসব দেশের সরকার কর্তৃক সাময়িকভাবে অধিগ্রহণ করা হয়। যুক্তরাজ্য সরকার সে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় পুঁজি বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করে । অন্যদিকে, সিংগাপুর, হংকং, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সরকার তাদের দেশের ব্যাংক ডিপোজিটের ওপর নিশ্চয়তা প্রদানের ঘোষণা দেয় । জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান ও ভারত নিজ নিজ দেশে আর্থিক বাজারে তারল্য সরবরাহের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে ।

কী কারণে এই বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ?
কী কারণে এই বৈশ্বিক আর্থিক সংকট শুরু হয় তার ব্যাখ্যা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দিবেন বং আর্থিক সংকটের কারণ ব্যাখ্যার জন্য অর্থনীতিবিদগণের বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে । কোন কোন অর্থনীতিবিদের মতে মোটামুটি ৩০ বছর বা ৫০ বছর পর পর বিশ্ব বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী এক অর্থনৈতিক চক্রের কারণে। আবার কেইনসীয় অর্থনীতির ধারক অর্থনীতিবিদ .... মনে করেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে এসব দেশ চক্রাকারে আর্থিক সংকট মোকাবেলা করবে । একটি অর্থনৈতিক মন্দার পর ঋণ পাওয়া কঠিন হবে এবং ঋণগ্রহীতাগণ শুধু প্রয়োজন মেটানোর জন্য ঝুঁকিমুক্ত ঋণ গ্রহণ করবে । অর্থনীতি যখন একটু একটু করে চাঙ্গা হতে শুরু করবে ঋণগ্রহীতা তখন ঝুঁকি নিয়ে লাভের আশায় ঋণ গ্রহণ করবে। এভাবে আশাবাদীতা থেকে ঝুঁকি নিয়ে অধিক ঋণ গ্রহণ শুরু হবে এবং অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়বে । এসময় অধিক হারে মুনাফা লাভের প্রবণতা নিচুমানের ঋণ প্রদানকে উৎসাহিত করবে এবং একসময় মন্দ ঋণের পরিমান বাড়তে থাকবে এবং অতিরিক্ত আশাবাদীতায় ছেদ পড়বে । অর্থনীতি আবার সংকুচিত হবে । এভাবে চক্রাকারে অর্থনীতির ওঠানামা চলতে থাকবে ।

ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এর মতে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট ঘনিভূত হওয়ার মল কারণ বিগত দশ বছরে প্রকৃত অর্থনৈতিক কার্যকলাপের তুলনায় আর্থিক বাজারে ফটকা কারবার ও জুয়া খেলার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় প্রকৃত অর্থনৈতিক ঝুঁকি থেকে আরক্ষা করা মুখ্য উদ্দেশ্যে না হয়ে গৌণ হয়ে পড়ে ।

বিগত দুই দশকে একদিকে প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ ভোগ প্রবণতা এবং এর সাথে দ্বৈত ঘাটতি (বাজেট ঘাটতি এবং বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি), অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিশেষত উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর উচ্চহারে সঞ্চয় এবং বৈদেশিক লেনদেনের উদ্বৃত্ত থেকে সৃষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ দিয়ে সে ঘাটতি পূরণ করা হয় । ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সৃষ্ট হয় ভারসাম্যহীন অবস্থা । এ বিষয়টি অর্থনীতিবিদগণ বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতার সাথে যোগ হয়
আর্থিকীকরণ(Financialization)। আর্থিকীকরণ হচ্ছে এমন এক অবস্থা যেখানে ঋণভিত্তিক অর্থায়ন পুঁজিভিত্তিক অর্থায়নকে ছাপিয়ে যায় এবং আর্থিক বাজার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমের চেয়ে আর্থিক বাজারে ফটকা কারবার বেশি লাভজনক মনে হয়।

আর্থিক সংকটের আরেকটি কারণ হিশেবে বলা হয়ে থাকে আর্থিক পণ্যের এর জটিল বিন্যাসের কারণে এর প্রকৃত ঝুঁকি অনুধাবনে বাজারে অংশগ্রহণকারীদের ব্যর্থতা । যেমন: বন্ধকী ঋণকে পুনঃমোড়কীকরণের মাধ্যমে উচ্চতর আয়ের পণ্যে পরিনত করে তৃতীয় পক্ষের নিকট বিক্রয়। আয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আর্থিক পণ্যের ঝুঁকিকে মোড়কীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার ফলে এর প্রকৃত ঝুঁকি নিয়ে ঋণদাতা তেমন মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করে নি।
আরও বলা যায় বাজারে অপ্রতিসম তথ্যের (asymmetric information)কারণে বিনিয়োগারীগণ রেটিং এজেন্সিগুলোর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন । রেটিং এজেন্সিগুলো যেসব সিকিউরিটির ক্রেডিট রেটিং করা দুরুহ তাও করতে থাকে। ফলে নৈতিক ঝুঁকির কারণে রেটিং এজেন্সিগুলো যথাযথ ক্রেডিট রেটিং দিতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়ে গেছে ।

ওপরের সবগুলো কারণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে । এক সময় বাজার আস্থা হারায় আর্থিক ব্যবস্থার ওপর এবং এই আস্থাহীনতার কারণে দেখা দেয় তারল্য সংকট যা আর্থিক সংকটকে ত্বরান্বিত করে ।

বিশ্বের জন্য শিক্ষা
রিজার্ভ ব্যাংক অব ইণ্ডিয়ার গভর্নর ড. ডি. সুবারাও অক্টোবর ২০০৮ এ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক মিটিং-এ বৈশ্বিক আর্থিক সংকট থেকে যে শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন তা মোটামুটি এরকম-
১. ব্যাংকিং নীতিমালা ও তদারকী ব্যবস্থাকে ব্যাংকিং ব্যবসায়ে উদ্ভাবন ও নতুন মডেলের চেয়ে এগিয়ে থাকতে হবে ।
২. কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকারে রাজস্ব বিভাগ এবং আর্থিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকারী ও তদারককারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কাজের সহযোগিতা ও সমন্বয় সাধন করতে হবে।
৩. দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান উদ্ধারে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে ।
৪. বিভিন্ন স্ট্রাকচারড প্রডাক্ট ও ডেরিভেটিভস এর দুর্বলতাসমুহ কাটিয়ে ওঠার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর মার্ভিন কিং আর্থিক সংকট মোকাবেলার জন্য জি-২০ দেশসমূহের একটি সমন্বিত কর্মসূচীর ওপর গুরত্ব আরোপ করেছেন । বর্তমান আর্থিক সংকট থেকে বিশ্ব একটি বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছে যে সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভরসাম্যহীনতা অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীনতাকে নির্দেশ করে যা আর্থিক সংকটের পূর্বাভাস দেয় । বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় আরও বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে ।
আরেকটি বিষয় অনুধাবন করা যাচ্ছে যে ঋণভিত্তিক অর্থায়ন ( সাব-প্রাইম মর্টগেজ এবং এর সাথে জড়িত বিভিন্ন স্ট্রাকচারড প্রডাক্ট ডেরিভেটিভস) আর্থিক সংকট সৃষ্টির পেছনে একটি বড় কারণ । এর চেয়ে ঝুঁকি শেয়ার করার মাধ্যমে পুঁজি ভিত্তিক অর্থায়ন অনেকটা নিরাপদ । আব্বাস মিরাখর তার এক সা¤ক্স্রতিক লেখায় উলে্খ করেছেন বিশ্ব এখন ইসলামী অর্থায়নের কৌশল এবং প্রথাগত অর্থায়নে অভিনবত্ব আনার মাধ্যমে পুঁজি ভিত্তিক অর্থায়নের দিকে ঝুঁকছে ।

বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্য
কিছুদিন আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যংক বলেছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ২০০৮-০৯ সনে বাংলদেশের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে ৫.৬%-এ দাঁড়াতে পারে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমান অনুযায়ী ৬.৫%। এ দিকে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও বলছে বিশ্বব্যাপী মন্দা বাংলদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ও প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং ২০১১ এর আগে এ মন্দার প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা কম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এর প–র্বানুমান অনুযায়ী বাংলদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০০৯ ও ২০১০ পঞ্জিকা বছরে যথাক্রমে ৫.০% ও ৫.৫% হবে, যা বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী আরও কম ।

বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টর ও ব্যাংকিং সেক্টরের বিদেশ হতে ধার গ্রহণের ক্ষমতা এবং বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত থাকায় বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের প্রভাব বাংলাদেশের আর্থিক খাতে তেমন পড়েনি । তবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার কারণে বাংলাদেশের পণ্য ও শ্রমের চাহিদা কমে যাবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে । এমতাবস্থায় , অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন । আশার কথা সরকার বৈশ্বিক মন্দা মোকাবেলায় কর্মপন্থা নির্ধারনের জন্য ইতোমধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে । এ টাস্ক ফোর্স অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সুপারিশ গ্রহণ করে যেসব কাজ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা, মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুদের হার কমানো, বিনিময় হারের সক্রিয় ব্যবস্থাপনা যাতে অবম–ল্যায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, গ্রাম এলাকায় ঋণপ্রবাহ জোরদার করা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোতে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ। সরকার ইতোমধ্যে মন্দা মোকাবেলা করার জন্য রপ্তানি ও কৃষি খাতে ভর্তুকী প্রদানের ঘোষণা করেছে ।
বাংলদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যাংকসমূহের ঋণ ও বিনিয়োগের গুণগত মান যেন পড়ে না যায় সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখছে । এছাড়া, বাসেল-২ এর নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের মূলধন পর্যাপ্ততা ও জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং পাশাপাশি নিজেদের তদারকী দক্ষতা উন্নত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ।
বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কোন বুদবুদ সৃষ্টি হচ্ছে কীনা তা আগাম বুঝার জন্য বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য, স্টক মার্কেট ও আবাসন খাতে মূল্যের গতিধারা প্রভৃতি বিশেষ গুরত্বের সাথে বিশে-ষণ করে দেখার প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ কাজটি করতে পারে । আমাদের দেশে আবাসন খাতের একটি নির্ভরযোগ্য মূল্যসূচক তৈরির বিষয়টি বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখে যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টেও এসেছে ।

এছাড়া, বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে বিভিন্ন ইসলামিক সিকিউরিটি ইস্যু ও লেনদেনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো তৈরির বিষয়টি সরকার ভেবে দেখতে পারে । তবে সম্প্রতি আমাদের দেশে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংক খোলার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা যেন প্রকৃত শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকিং হয়, সাইনবোর্ড সর্বস্ব নয়, তাও লক্ষ রাখা দরকার ।

(লেখক ব্যাংকার, ফোন: ০১৮১৭৫১৮৬৬২)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:২২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×