জিন-এর ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার আগে আরেকটা উদাহরণ দেই। ডায়াবেটিস হলে অনেকে ইনসুলিন নেন ইনজেকশনের মাধ্যমে, ইনসুলিন কিন্তু আমাদের শরীরে এমনিতেই তৈরী হয়। ইনসুলিন একটি জটিল রাসায়নিক যৌগ (ছবি-1ঃ ইনসুলিন মনোমার), কিন্তু আমাদের শরীর এত জটিল অনু কিভাবে তৈরী করে? উত্তর হচ্ছে আমাদের অগ্নাশয়ের কোষগুলো স্রেফ একটা সুত্রের বই থেকে স্টেপ বাই স্টেপ কপি করে। কিভাবে ইনসুলিন বানাতে হবে সে সুত্র বিস্তারিত ভাবে আমাদের ক্রোমোসোম - 11 তে আছে। কিন্তু সুত্রটা কি ভাষায় লেখা? আমরা যদি আমাদের বাংলা লেখা গুলোর দিকে খেয়াল করি আমরা দেখব গোটা পঞ্চাশেক বর্ণ দিয়েই আমরা যে কোন শব্দ, শব্দ দিয়ে বাক্য, অনুচ্ছেদ , শেষমেশ যে কোন আকারের গ্রন্থ লিখি। কোষগুলোর ক্ষেত্রে বর্ন মাত্র চারটি, adenine(A), cytosine(C), guanine(G), thymine (T), প্রত্যেকেই তুলনামুলক ভাবে সরল রাসায়নিক পদার্থ (এক্ষেত্রে nucleotide, ছবি-2)। সহজ ভাষায় এদেরকে বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে (যেমন শব্দের মধ্যে বর্ণ সাজাই) যে বড় স্ট্রাকচার তৈরী হয়, তাকে বলতে পারি জিন (গ্রন্থের ক্ষেত্রে সেকশন)। অনেক গুলো সেকশন মিলে যেমন হয় একটা চাপ্টার , তেমন জিন গুলো দলবদ্ধ হয়ে তৈরী হয় ক্রোমোজোম, এরকম 23 জোড়া ক্রোমোজোম (ছবি - 3) মিলে তৈরী করেছে মানুষের জেনেটিক গ্রন্থ। শরীরের বেশীর ভাগ কোষে এই গ্রন্থটি আছে, জীব হিসেবে আমাদের বেচে থাকার সমস্ত সুত্র এখানে লিপিবদ্ধ। কোষের মধ্যে সুত্র দেখে প্রয়োজনীয় রাসায়নিক যৌগ তৈরী করার ফ্যাক্টরী আছে (Ribosome), এখানে বিস্তারিত বর্ননায় যাব না। যাহোক যখন প্রয়োজন হয় রাইবোজম জিন থেকে সুত্র নিয়ে ইনসুলিন তৈরী করে (ছবি 4,5)। ডায়বেটিক রোগীরা বাইরে থেকে যে ইনসুলিন নিয়ে থাকেন, কিছুদিন আগেও তা শুকরের শরীর থেকে নেয়া হতো, এখন জেনেটিক কৌশল ব্যবহার করে ইনসুলিন তৈরী করা হয়। মানুষের ইনসুলিন তৈরীর সুত্র (জিন) নিয়ে ব্যক্টেরিয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, এরপর ব্যাক্টেরিয়া (অনিচ্ছাকৃতভাবে) ঐ সুত্র ব্যবহার করে ইনসুলিন তৈরী করতে থাকে। আরও জানতে চাইলে গুগল সার্চ দিন।
যাহোক, শুধু ইনসুলিন নয়, আমাদের শরীরের যত উপাদান আছে সবগুলোই কোন না কোন জিনে আছে (বইয়ের কোন না কোন পাতায়)। এখন কথা হচ্ছে যদি সুত্রে কোন ভুল থাকে তাহলে কি হবে? তাহলে কি ভুল উপাদান তৈরী হবে? এমনকি হতে পারে যে শুধু অল্প কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই ভুল সুত্র আছে? দুঃখজনক হলেও সত্যি সুত্রে ভুল থাকতে পারে, সেক্ষেত্রে ভুল উপাদান তৈরী হবে, আমরা কেউ কেউ ভুল সুত্র নিয়ে জন্মগ্রহন করি। টাইপ-1 ডায়বেটিক রোগীদের মুল কারন জেনেটিক কোডের (সুত্র) গন্ডগোল। কিন্তু কারও কারও সুত্রে ভুল ঢুকল কিভাবে, বাকীদের তো ভুল নেই, তাহলে কি একেকজনের সুত্র একেকরকম? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে চমৎকার একটা উপসংহার টানতে সাহায্য করবে, তবে আপাতত উত্তরের জন্য mutation এর ওপর আলোকপাত করি।
মিউটেশন হলো জেনেটিক কোডের পরিবর্তন, এই পরিবর্তন বিভিন্ন ভাবে হতে পারে, যেমন কোষ বিভাজনের (একটা কোষ ভেঙ্গে দুটো হয়, সমস্ত জেনেটিক কোডও দুই কপি করতে হয়) সময় কপি করতে ভুল হলে, রেডিয়েশনের প্রভাবে (যেমন সুর্যের আলো, এক্স রে, পারমানবিক বোমা, দুঘটনা, ইত্যাদি শক্তিশালী রেডিয়েশনের উৎস), ভাইরাসের প্রভাবে ইত্যাদি। মিউটেশন প্রতি মহুর্তেই আমাদের শরীরে হচ্ছে, প্রতিদিন যে কোন একটা কোষে 50,000 থেকে 5,00,000 এ ধরনের ভুল হতে পারে (ভয় পাবেন না আমাদের সর্বমোট 3 বিলিয়ন base আছে, ভুল সে হিসেবে মাত্র 0.0002% ক্ষেত্রে), তবে কোষে অবশ্য একটা রিপেয়ার মেকানিজমও আছে, কিন্তু ভুলের পর কোষ যদি একবার বিভাজিত হয় তাহলে ঠিক করা কঠিন। আমাদের শরীরে ক্যান্সারের কারণ এ ধরনের মিউটেশন, আবার নতুন প্রান যখন তৈরী হয় তখন যদি সুত্রে বড় সড় ভুল হয়, বিকলাঙ্গ প্রানী তৈরী হতে পারে (এখন নিশ্চয়ই পরিস্কার হয়েছে পারমানবিক বিস্ফোরনের পরে, যেমন চেরনোবিল, কেন ক্যান্সার এবং বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল)।
মিউটেশন সম্পুর্নrandom, যে কোন জিনে হতে পারে। সমস্ত মিউটেশনই খারাপ নয়। অনেকক্ষেত্রে আমাদের শরীর ইচ্ছে করেই মিউটেশন করে, যেমন ডিম্বানু বা শুক্রানু তৈরীর সময়। আরও ভালভাবে বোঝার জন্য গত কয়েক বছর ধরে নতুন ধরনের ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যে যক্ষা আমাদের আক্রমন করছে সে প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।
বেশীর ভাগ ঔষধেই এই যক্ষার নিরাময় হয় না, অথচ একসময় তো হতো, এমন কেন হলো? আপনি খেয়াল করে থাকবেন ডাক্তাররা যখন এন্টি বায়োটিক দেয়, তখন সব সময় বলে রোগ সেরে গেলেও কোর্স সম্পুর্ণ করতে। যক্ষার নব্য উপদ্্রবের সাথে রোগীদের কোর্স সম্পুর্ণ না করা জড়িত। ঘটনাটা এমন ধরা যাক কোন রোগীর শরীরে 100 টা জীবানু ছিল, এর মধ্যে একটা জীবানুর এমন একটা মিউটেশন হলো (হয়ত স্রেফ কোষ বিভাজনে, বা রেডিয়েশনের মাধ্যমে, ...) যা ঔষধকে প্রতিরোধ করতে পারে, রোগী দশদিন ঔষধ খাওয়ার পর 100 টা জীবানু কমে 10 টা হলো, তবে আমাদের মিউট্যান্ট জীবানু মরে নি, ঔষধে যেহেতু এর কোন ক্ষতি হয় না, আর রোগীর স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে যাওয়ায় মারতে পারে নি। যাহোক রোগী এখন যদি ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে কিছুদিনেই জীবানু সংখ্যা আবার 100 হবে, সবাই সমান ভাবে বেড়ে থাকলে আমাদের মিউট্যান্ট জীবানু এখন 10টি হবে, এমতাবস্থায় রোগী দ্্বিতীয় বারের মতো এন্টি বায়োটিক নিল, ধরে নিলাম ঐ 10টি জীবানু ছাড়া বাকী জীবানু ঔষধের কারনে মারা যাবে, কিন্তু এর পর আর যতই এন্টি বায়োটিক নেয়া হোক না কেন, জীবানু আর কমানো যাবে না, ক্রমশ ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবানু সংখ্যায় শত শত হয়ে বিস্তার করতে থাকবে। জন্ম হলো টিবি ব্যাক্টেরিয়ার নতুন স্ট্রেইন।
উপরের অনুচ্ছেদ থেকে দুটো নীতি স্পষ্ট , মিউটেশনের কারনে জীবের নতুন স্ট্রেইনের উদ্ভব ঘটতে পারে, যদি অনেক রকম স্ট্রেইন থাকে, তাহলে যে স্ট্রেইন শক্তিশালী সেটা টিকে যাবে, অন্যটা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এই নীতি দুটো ডারউইন দেড়শ বছর আগে প্রস্তাব করেছিলেন, জেনেটিক্স না জেনেই, এখন মাইক্রোস্কোপের নীচে চোখের সামনেই এটা ঘটতে দেখা যায়, ডারউইনের সুত্র তখন ছিল থিওরী, হাইপোথিসিস, কারো কারো কাছে ফিকশন, এখন তা হচ্ছে ফ্যাক্ট। পরের লেখায় বিস্তারিত লিখব।
পাদটীকাঃ আমরা যে ভাবি আমরা 50% মায়ের জিন পেয়েছি আর 50% বাবার আসলেই কি তাই, মোটেই না, সামান্য হলেও মিউটেশনের জন্য আমাদের জেনেটিক কোডের কিছু অংশ আমাদের নিজের, যা এর আগে কারও কখনও ছিল না, সে অর্থে আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা স্ট্রেইন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০০৬ দুপুর ১২:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


