ছেলেটার গায়ে হাফ হাতা জামা । রোগা স্বাস্থ । মাথায় ঝাকড়া চুল । চোখগুলো বয়সের তুলনায় স্থির । সালাম দিয়ে ভারী গলায় বলে উঠলো,
-আমার নাম সোলাইমান । মৌরি আপনার কথা বলে খুব । বলেছে আপনি খুব ভাল মানুষ । আপনি ভবিষ্যত বলতে পারেন।
সন্দেহ থাকলো না ছোকড়াটার সঙ্গে মৌরির কী সম্পর্ক। একটু আগ পর্যন্ত মেয়েটাকে ফুলের মত নিষ্পাপ মনে হতো । কিন্তু কিসের কি, এ একটা যাতা ইঁচড়ে পাকা মেয়ে।
কলিম শেখেরা ব্যস্ত থাকে কী করে জমি কিনবে বাড়ি বানাবে । এদিকে মেয়েরা কী করছে তার কোন খেয়াল থাকে না । সুন্দরী হোক বা অসুন্দরী হোক, আস্কারা দিলে মেয়েরা বখাটে ছেলের হাত ধরে পালাবেই ।
মুখে এই বিরক্তিটা গোপন করে, আসাদুজ্জামান সিরিয়াস ভাবে উত্তর দিলেন
- আমি হস্তরেখাবিদ না । আমার যা মনে হয় বলি । মাঝে মাঝে কাজে লাগে । আপনি আপনার সমস্যাটা বিস্তারিত বলেন দেখি সাহায্য করতে পারি কিনা ।
- ঠিক আছে । ছেলেটা খুশি হয়ে বললো, আঙ্কেল, আমাকে তুমিই বলবেন । মৌরি ছেলেটাকে রেখে গেটের দিকে হেটে চলে গেল । যাতে ছেলেটা মন খুলে কথা বলতে পারে ।
ছেলেটার হাসে কম । গম্ভীর ভঙ্গীতে ভণিতাছাড়াই শুরু করল
-আমার বাবা লোকমান হাওলাদার একজন চরিত্রহীন নোংরা মানুষ ।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম । কাউকে নিজের বাবা সম্মন্ধে এমন করে বলতে শুনিনি।
-দাদা ইংরেজ আমলে জয়নগরে হাওলাদার রাইস মিল প্রতিষ্ঠা করেন। এ তল্লাটে ধান হয় প্রচুর । দাদা মারা যাবার পর বাবার হাতে প্রচুর টাকা আসে । বাবা সেই টাকা দিয়ে বন্ধুদের গরু জবাই দিয়ে খাইয়ে উড়িয়েছে । রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো। নেশা বড় খারাপ জিনিস।
- কোন লোককে শুনেছেন, তার স্ত্রীর মৃত্যুশয্যায় বন্ধুদের নিয়ে মদ খেতে বের হয়েছে?
- আমি নিরব থাকি ।তার পর বলি আমি শুনছি । তুমি বলো ।
- স্বাধীনতার পরে বাবা এক মেয়েকে ঘরে তুলে নিয়ে আসে যে মেয়ে চার দেয়ালের খুপড়ির ভিতর অচেনা পুরুষদের সেবা দিয়ে গেছে।
ঠিক তার পরদিন তার প্রথম স্ত্রী ময়মুনা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে । নিরুত্তাপভঙ্গীতে সে বলে যায় ।
-কিন্তু দুর্ভাগ্য বড় মা মরে নাই । আঠারদিন জীবিত ছিল । ছটফট করেছে । বাবা এক ডাক্তারকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছিল যাতে মামলা মোকদ্দমা না হয় ।
অবশেষে বড় মা চলে যায় । একটু চুপ থেকে, আমার দিকে চেয়ে বললো,
- এই যে বারবণিতা রমনী সে আমার মা । যখন আমার বয়স হয় নি, পথে লোককে গালি দিতে শুনতাম, বেশ্যার বাচ্চা । মাকে এসে বললে মা জড়ায়ে ধরে হুহ করে কেঁদে দিয়েছে । বলেছে, বাবারে, বড় হ । বুঝবি ।
-আমার বাবা মাকে বিবাহ করে মদের নেশার ঘোরে । মা’ আমি বড় হলে একদিন বলেছিল, যার জন্য এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল সে তাকে পঁচিশ টাকায় বানিয়াশান্তার পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয় । তারপর গরুর পালের মত নিয়ে আসা হয় এই ইংলিশ রোডের এক বাড়িতে।
বিয়ের পর মাকে প্রায়ই গালিগালাজ সহ্য করতে হতো । বাবা তাকে তালাক দিতে চাইতো । পরে কী মনে হল, চাষের তিন কাঠা জমিতে একটা ছাপড়া ঘর তুল আলাদা করে দিয়েছে মাকে। সময় অসময়ে মাকে হয়তো দরকার হতো।
এ লম্বা ইতিহাস, বললে শেষ হবে না। আপনার সময় নষ্ট করতে চাই না । আসাদুজ্জামান কৌতুহল ঠেকাতে পারলেন না । বললেন,
- না না, অসুবিধা নাই । তুমি বলতে থাকো । মৌরি বোধ হয় চলেই গেছে । তাকে দেখা যাচ্ছে না ।
-গর্ভে আমি আসার পর, মা আমাকে আকড়ে তার জীবন নতুন করে শুরু করে । এদিকে মদ আর মেয়েতে পয়সা ফুরাতে সময় লাগলো না । দেনায় পড়লেন লোকমান হাওলাদার। একদিন রাইস মিল বিক্রি করে ঢাকায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন ।
- তোমার মা কী করলেন?
- মা বাড়িতে কিছুদিন বাড়িতে বাড়িতে কাজ করেছে, ইটের খোলায় ছিল, শেষে থানা স্বাস্থে আয়া হিসাবেও ছিল চার বছর ।
পতিতাদের কেউ কাজ দেয়, বলেন? সবাই আড়ালে ইঙ্গিতে পয়সা সাধে।
মা নামাজ পড়তো । কিন্তু বাড়ি থেকে শবে বরাতের সিন্নি মসজিদে পাঠালে মসজিদ থেকে ফিরায়ে দিত । বলতো, তোর মায়ের পাপ তওবা করেও মুছবে না ।
অথচ কেউ কী খেয়ে বেচে আছি দেখে নি । এক চাচার কাছে শুনেছিলাম বাবা টিকাটুলিতে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে । হয়তো বিয়েও করেছে । মা কথায় কথায় বলতো,
-বাপরে মেয়ে মানুষ নিয়া খেলিস না । মনে রাখিস এরা তোর মায়ের জাত, তাদের পেট থেকে জীবন্ত মানুষ বের হয় ।
মায়ের কথা বলতে গেলে সবাই আবেগাপ্লুত হয় । ছেলেটাও একদমে কথা বলে একটু থেমে গেল । ওর মা বেচে নেই ।
(চলবে...)
পর্ব ১: Click This Link
পর্ব ২: Click This Link
পর্ব ৩: Click This Link
পর্ব ৪: Click This Link
পর্ব ৫: Click This Link
পর্ব ৬: Click This Link
পর্ব ৭: Click This Link
পর্ব ৮: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১০ সকাল ৯:৪৬