somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: পাপ - ৮ (শেষ)

২৭ শে জুন, ২০১০ রাত ৮:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


স্থান, জয়নগর । নবাবগঞ্জ থেকে ১০ মাইল দুরে । এখানে রাস্তাঘাট ভাল। কিন্তু বাস চলে না। প্রধান বাহন হলুদ টেম্পু আর ম্যাক্সি। জয়নগর বাজার টেম্পুস্ট্যান্ডের উল্টোদিকে “জননী ফার্মেসী”তে সোলায়মান বসে। নিজের দোকান। মা যখন বিছানায় পড়েছিল তখন সে ক্লাস টেনে পড়ে। থানা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে মায়ের এক শুভানুধ্যায়ী কিছু টাকা আর ফার্মেসীর লাইসেন্স যোগাড় করে দিয়েছিলেন।

মৌরিদের বাসা বাজার রোডের কাছেই ছিল । এই ফার্মেসীতে প্রায় প্রতিদিন আসতে হতো । কলিম শেখের একটি ছেলের জন্য আফসোস ছিল। এই আধুনিক সমাজেও ছেলে কে ধরা হয় বংশের বাতি। ব্যাংকের অভিজ্ঞতায় দেখেছে কোন ক্লায়েন্টের ছেলে হলে সে ব্যাংক পর্যন্ত মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির হয়। মৌরির বাবার সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। বরং একটি কষ্টকর ঘটনা জানতে পারলো মৌরির কাছে গতকাল।

প্রতিবেশীরা মিসেস কলিমকে বলেছিলো এবার তার ছেলে হবেই। ছেলে হলে নাকি চেহারা কালো হয়। মিসেস কলিম শেখের চেহারা সৌভাগ্যক্রমে কালো দেখাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ হাইপ্রেশারে শঙ্কটাপন্ন হলে ৩৪ সপ্তাহে সিজারিয়ান বাচ্চা হয়। হসপিটালে হাসি ছিলনা, ডাক্তার বললেন, আল্লাহ মা-মেয়ে দুজনকেই সুস্থ রেখেছেন। কিন্তু ড্রাউনিং সিন্ড্রোমের বেবীর অনেক বেশি যত্ন লাগে।

মৌরি বলেছিল, সেই থেকে সোলায়মান ভাই আমাদের বাড়ির অংশ । কখনো ১১ টা কখনো রাত ৩টায় মনি অজ্ঞান হয়ে যেত। আম্মা চিৎকার করে কোরান শরীফ তেলওয়াত করতে থাকতো। কিন্তু যে বাসায় ছেলে নাই, বোঝেনইতো । আব্বা তখন প্রায় পাগল। সোলায়মান ভাই রাত জেগে নিজের কোলে করে বেবিতে থানা স্বাস্থ কমপ্লেক্সে ছুটতো।নিজের হাতে তেল মালিশ করতো হাতে পায়ে। হাসপাতালের বারান্দায় যখন দাড়িয়ে থাকতো, তখন বুঝতে কষ্ট হলো না, উনার মন কত নরম।

মনিকে বাঁচানো যায় নি। কোন এক ভোর বেলায় দেখলাম আমার বোনটি পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে। সোলায়মান ভাই নিজের বোনের মত জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। বলেছে, আমার কপাল কেন এমন, যাকে ধরি সেই চলে যায়?

সোলায়মানের সততা আর তার দায়িত্ববোধ অনেকক্ষণ ভাবিয়েছে আসাদুজ্জামান কে। সেই বয়সে কি তিনি পারতেন এই রকম বোঝা নিতে? পড়াশোনা করেছেন বাবার পয়সায়। চাইলেই টুর্নামেন্ট খেলা, চাইলেই আড্ডা, চাইলেই সহপাঠি মেয়েদের নিয়ে কবিতা। আহা! এই মফস্বল শহরে আর কয় টাকার ব্যবসা হয়? প্রতিদিন কয় টাকার ওষুধ বিক্রি হয়, আর কত টাকাই নগদ আসে । সে কল্পনায় দেখছে সেই টাকা নিয়ে হাসিমুখে সে বাড়ি ফিরেছে একটি কিশোর, সে শয্যাশায়ী মাকে খুশি করতে বলছে, মা, একটা ভাল খবর আছে। এখন থেকে ডাক্তার মাইনুদ্দিন চাচা প্রতি মঙ্গলবার রোগী দেখবেন বলেছেন । উনার অনেক রোগী। এবার আমাদের আর চিন্তা নাই । মা বলেছে, যাই করিস বাপ, কারো পয়সা মারিস না । গরীব থাকলে থাকবি । আল্লাহ পরকালে ফিরত দিবে । কারো হক মেরে সুখে থাকা যায় না।

আসাদুজ্জামান ভাবছিলেন। মানুষ এত নীচ হয় কি করে। সংসার করে। আবার পরনারীর জন্য স্ত্রীসন্তানকে তুচ্ছ করে। তার দ্বিতীয় সত্তাটি বললো, তুমি আর এমন কি তফাৎ? তোমার মেয়ের জন্মদিন গেছে, তুমি একটি বারও মনে কর নি অথচ এখানে একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য দিনের পর দিন জানালায় বসে থাক। নারী সৌন্দর্যের দেখার অজুহাতে কী করনা? লোকমানের মত পরিস্থিতি থাকলেও তোমারও ভদ্রতা কী হতো কে জানে।

সোলায়মান বলেছিল যে তার বাবা মরেনি । তার একটা খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। একদিন সে ফার্মেসীতে বসে ছিল। প্রচুর লোক ছিল। ভিড় ঠেলে একজন সাদাশ্মশ্রুর বৃদ্ধ বলেছিল, আপনিই কি লোকমান হাওলাদারের ছেলে?
-জি
-আমি অনেক খুজে এখানে এসেছি । লোকমান সা'ব আমার পরিচিত । একই গ্লাস ফ্যাক্টরীতে কাজ করতাম । সে এখন খুব অসুস্থ। সোলায়মান একটু স্তব্ধ হয়েছিল।
- খুব খারাপ অসুখ। শরীরে পচন ধরেছে। মনে হয় আয়ু শেষ। আমাকে বলেছে, জয়নগরে খোঁজ করতে। যদি ছেলেটা বেঁচে থাকে তাকে বলো আমি মরার আগে একটি বার দেখতে চাই। তোমার মায়ের নাম কি মায়মুনা? উনি কই?
-জি, উনি তো জান্নাতবাসী
- তোমার বাবা রাতের বেলা চিৎকার করে কান্দে, বড় পাপ করেছি মায়মুনা, বড় পাপ!

বাবা যত অপরাধ করে বাবা বাবাই। তুমি যাও নি? সোলায়মানকে জিজ্ঞেস করতেই সে বললো
- যে লোক সন্তান জন্ম দিয়ে সেই সন্তান রাস্তায় ফেলে চলে যায় সে কীসের বাপ? যে লোক তার নিজের সুখের জন্য সংসারে লাথি দিয়ে চলে যায়, সে তার পাপের ফল সে ভোগ করছে, করুক । লোকটি ঠিকানা দিয়েছিল । কিন্তু যাইনি ।

শুধু প্রশ্ন ছিল উপরওয়ালার কাছে, আমার মায়ের কী পাপ ছিল? সে কী পেয়েছে জীবনে?
আমার যে বড় মা, যে চরমদু:খে পৃথিবী থেকে চলে গেল তার কী পাপ ছিল? আর এই যে আমি, এখনো লোকে নাক সিটকায় বেজন্মা বেশ্যার বাচ্চা বলে আমার কী পাপ ।

আমার যদি পাপ না থাকতো তবে কেন মৌরির বাসায় এমন ব্যবহার পাই।

সোলায়মানের সঙ্গে মৌরির সম্পর্কের কিছুদিনের মধ্যেই তার মা টের পেয়েছিল ।কলিম শেখ এত ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে গাদ্দার, নিমহারাম, লোভী, রাস্তার ছেলে হয়ে আস্পর্ধা ..ইত্যাদি বলে গালি দিয়েছিল। মৌরির গায়ে হাতও তুলেছিল । এর পরই জয়নগর থেকে বাড়ি বদল করে মৌরিকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেন।

আসাদুজ্জামান মনে হয় দুজনের সম্পর্কটা মেনে নিচ্ছিলেন। তিনি গতকাল সোলায়মানকে মুরুব্বীয়ানা ভঙ্গীতে বলেছিলেন,
- মৌরি এখনো অনেক ছোট। আমি এমন কিছুতে সাহায্য করতে পারবো না যাতে তার ক্ষতি হয়। তবে কী কারণে এসেছ বললে সুবিধা হয়।
-আঙ্কেল, মৌরি আপনাকে বিশ্বাস করে। তার ইচ্ছা আপনার কাছ থেকে আমাদের দুজনের সম্পর্কের সম্ভাবনা জানা।
সোলায়মান, একটু সতর্ক ভাবে দেখলো। মৌরি নেই আশেপাশে। তার পর হঠাৎ তার হাত চেপে বললো
-আমি রাশিফলে বিশ্বাস করিনা । কিন্তু এসেছি একটা আশায় । আপনি একটা কথা রাখবেন?
- কী, আসাদুজ্জামান ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি।
- মৌরিকে একটা মিথ্যে বলবেন । বলবেন আপনি আমার হাত দেখেছেন । আমার রাশির সাথে তার বিশাল গড়মিল। দু’জনের সম্পর্ক হলে ভয়ানক বিপদ হবে। অনেক কঠিন ফাড়া । আপনাকে সে অনেক বিশ্বাস করে । আপনার কথা সে শুনবে ।
মৌরি আমার মায়ের মত সরল। সে আমার জন্য অনেক ফিল করে। লুকিয়ে আমার ফার্মেসীতে খাবার দিয়ে আসে। ভাঙা গলায় বলতে থাকলো, আঙ্কেল, আমার রক্তে চরিত্রহীন লোকমান হাওলাদার আছে। যদি আমার ভুল হয়!
মেয়েটার অনেক গুণ, অনেক মায়া। তার অনেক বড় ঘরে বিয়ে হোক। একটা বেশ্যার ছেলে, একটা দোকানদারের বউ সে কেন হবে?

আমি স্পষ্ট কিছু বলিনি। সোলায়মান চলে গেছে । মৌরি লুকানো থেকে উঠে এসে বললো, ভাইয়া, কী দেখলেন?
আসাদুজ্জামান ধীরস্থিরভাবে বললেন, আজকে না, অনেক কথা, কাল সময় করে বলবো ।

পরদিন ব্যাঙ্কে অনেক কাজ করতে হলো। টাকা জালিয়াতির রহস্য উদঘাটিত হয়েছে । একজন পুরানো কর্মকর্তা পয়সা খেয়ে এ ধরনের কাজে সহায়তা করেছে একাধিক বার । বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় - পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী লোক । পুলিশ এসে এরেষ্ট করে নিয়ে গেছে ।

বিকেলে ফিরছিলেন । দেখলেন মৌরি মাঠের পাশে দাড়িয়ে। সে হয়তো অপেক্ষা করছে গতকালের খবরটা জানার জন্য ।
আসাদুজ্জামান কথা এড়াতে চাইলেন,
-পড়াশোনা কেমন চলছে?
-ভাইয়া, বেশি ভাল না । মৌরি ঠোট চেপে হাসছিল । এই কয়দিনে সে বন্ধুর মত সহজ হয়ে গেছে । আসাদুজ্জামান হেসে বললেন,
-আমি একটা মজার জিনিস খেয়াল করেছি তোমার আম্মা আর তুমি – তোমরা দুজনেই আমাকে ভাই ডাকছ । হা হা । তুমি আমাকে বরং আঙ্কেলই বলো ।
- আজকে রাতে আমি তোমাদের বাসায় যাব । দুপুরে তোমার চাচীর সঙ্গে কথা হয়েছে । এই ছুটিতে ঢাকায় আমাদের বাসায় তোমাদের দাওয়াত । গল্প করা যাবে । এক সঙ্গে সবাই মিলে ফ্যান্টাসী কিংডমে বেড়াতে যাব । আমার বাচ্চারা তোমাদের পেলে দারুণ খুশি হবে ।




পর্ব ১: Click This Link
পর্ব ২: Click This Link
পর্ব ৩: Click This Link
পর্ব ৪: Click This Link
পর্ব ৫: Click This Link
পর্ব ৬: Click This Link
পর্ব ৭: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:২৩
১৮টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×